|
|
|
|
এখানে শান্তি |
পাহাড়ি ঝোরার পথেই ‘একলা’ চললেন মমতা |
অনিন্দ্য জানা • সুকনা |
দু’হাতে শাড়িটা গোড়ালি পর্যন্ত তুলে, হাওয়াই চপ্পল পায়ে মহানন্দার জলে নেমেই পড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নদীর সোঁতায় পাথরের ধারে উবু হয়ে বসে আঁজলা ভরে জল তুলে ছেটালেন চোখেমুখে। তার পর একটা মরা গাছের গুঁড়ির উপর ধপাস করে বসে পড়ে গলায় লঘু চাপল্য নিয়ে বললেন, “আহ্! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।”
ঘণ্টাখানেক হল সই হয়েছে পাহাড়-চুক্তি। একেবারে নীরবে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েক জন, মুখ্য বনপাল অতনু রাহা, এলাকার এডিএফও উৎপল নাগকে নিয়ে মমতা সটান ফিরে আসেন সুকনা বনবাংলোয়। কিন্তু গাড়ি থেকে না-নেমে ঢুকে পড়েন জঙ্গলের আরও গভীরে। রবিবার তিনি যেখানে গিয়েছিলেন, তাঁর পিছু ধাওয়া করেছিল নাছোড় সংবাদমাধ্যম। বিশাল গাড়ির কনভয় জঙ্গলে ঢোকায় খানিকটা ক্ষুণ্ণই হয়েছিলেন মমতা। সোমবার তাই তিনি কাউকে কিচ্ছু বলেননি। কার্যত একলাই গিয়ে পড়েছেন জঙ্গলের ‘কোর-এরিয়া’য়।
মমতা যে জঙ্গলে যাচ্ছেন, সেটা তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা আন্দাজও করতে পারেননি। তাঁরা বিষয়টা বুঝতে পারেন মমতা আচমকা সুকনা বনবাংলো ছাড়ার পর! বস্তুত, তাঁরা খানিকটা চিন্তাতেই পড়েছিলেন। আরও উদ্বিগ্ন ছিলেন উৎপলবাবু। কারণ যে এলাকায় মমতা যাচ্ছেন, অভয়ারণ্যের সেই অঞ্চলে দাঁতাল হাতি, চিতাবাঘ, সাপ এমনকী, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারেরও ডেরা।
দ্রুত আনা হল বন্দুকবাজ রক্ষী। দুই বিট অফিসারকে মোটরবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আগে আগে। মমতাকে বলা হল, “ম্যাডাম, একটু সাবধানে।” কিন্তু তিনি সে সব শুনলে তো! নিস্তব্ধ বনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অদ্ভুত সব শব্দ ভেসে আসছে। কয়েক পা গিয়েই গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়লেন। শ্যাওলা-ধরা রাস্তা। জোঁকের অসম্ভব উপদ্রব। হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে সেই রাস্তা ধরেই হাঁটতে শুরু করে দিলেন তিনি। এতটাই দ্রুত যে, পিছন পিছন প্রায় দৌড়তে হল রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী, রাজ্যের বনমন্ত্রী হিতেন বর্মণ এবং সফরসঙ্গী শিবাজি পাঁজাকে! |
|
মহানন্দার চরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বিকেলে। অনিন্দ্য জানা। |
কতটা হাঁটলেন এমনিতে ট্রেডমিলে দৈনিক অভ্যস্ত মমতা?
তা প্রায় চার কিলোমিটার তো হবেই। পায়ের নীচে শুকনো পাতা। শুকনো কজওয়ে। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু একটা ঝোরা। যা দেখে উচ্ছ্বসিত মমতা। কখনও একশো বছরের পুরনো শালগাছ দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। কখনও ফরেস্ট অফিসার খয়ের গাছের পাতা পেড়ে তাঁকে দেখাচ্ছেন, কী ভাবে হাতের তালুতে পাতাটা ঘষলে হাতের রং ক্রমশ লাল হয়ে যায়। সঙ্গে ব্যাখ্যা, “আগে মহিলারা এই পাতা থেকেই রং সংগ্রহ করে আলতা পরতেন।” চারদিকে শোনা যাচ্ছে পাহাড়ি ময়না-সহ বিভিন্ন পাখির ডাক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের নাম জানতে চাইছেন মমতা। প্রশ্ন করছেন, “এইসব গাছ থেকে অরণ্য-আইন বিঘ্নিত না-করে কোনও গবেষণা করা যায় না? আমরা যদি জঙ্গলের বাইরে কোনও রিসার্চ সেন্টার তৈরি করতে পারি?” কখনও শুনছেন, “কিছু দিন আগে এই জঙ্গলেই সন্দীপ রায় তাঁর রয়্যাল বেঙ্গল রহস্যের শু্যটিং করেছেন পারমিট নিয়ে।” তার পর মন্তব্য করছেন, “উনি এবং ওঁর স্ত্রী খুব ভাল মনের মানুষ।” তার পর রসিকতা করে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে-থাকা মুখ্য অফিসারকে বলছেন, “এখন যদি বাঘ এসে পড়ে আমাদের সামনে, তখন আপনি কী করবেন? কী করে আমাদের বাঁচাবেন?” কোমরের ওয়াকিটকির বোতামে হাত রেখে অফিসার বলছেন, “তা হবে না ম্যাডাম। বাঘ আসবে না।”
যাওয়ার পথে কোনও জন্তু চোখে পড়েনি। কিন্তু ফেরার পথে খানচারেক ময়ূর তিনি দেখতে পেলেন রাস্তার পাশে। মোবাইল ক্যামেরায় মমতা ছবি তুলে রাখলেন জাতীয় পাখির।
যে একলা ‘পদযাত্রা’ তিনি আচমকাই শুরু করেছিলেন, তা গিয়ে শেষ হল অবশেষে মহানন্দা নদীর ধারে। রবিবার বিকেলে এই নদীই মমতা পেরিয়েছিলেন গাড়ি করে। এ দিন পায়ে হেঁটে নেমে পড়লেন নদীর উপর। একেবারে তীরের কাছে একটা সরু ধারা। তার পর পাথরের চড়া। সেটা পেরিয়ে আরও চওড়া স্রোত। অবলীলায় প্রথম স্রোতটা পেরিয়ে (তাঁর পিছু নিতে গিয়ে পকেট থেকে মোবাইল জলে ছিটকে পড়ল অতনুবাবুর। বহু কষ্টে সেটা উদ্ধার করা গিয়েছে অবশ্য। কতটা কর্মক্ষম আছে, জানা হয়নি) খরস্রোতের ধারে চলে গেলেন মমতা। দূরে হিমালয় দেখা যাচ্ছে। চারদিক শান্ত। কোনও আওয়াজ নেই। বনমন্ত্রী হিতেনবাবুকে মমতা বললেন, “এখানে তো একটা চমৎকার ট্যুরিস্ট-স্পট করা যেতে পারে। আপনি দেখুন। কী কী পরিকাঠামো প্রয়োজন, আমায় লিখে জানান। এত ভাল একটা জায়গা। মানুষ তো দু’দন্ড শান্তির জন্য এখানে আসতেই পারেন।”
প্রায় আধঘন্টা কেটে গেল নদীর তীরে। ততক্ষণে অবশ্য চারদিকে খানিকটা হল্লা পড়েছে কোথায় গেলেন তিনি? চলনসঙ্গীদের কাছে অনবরত ফোন এবং এসএমএস আসছে। কলকাতা থেকে এসেছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনিও উদ্বেগে। কোথায় গেলেন তাঁর দলনেত্রী! উত্তর দেওয়ার উপায় ছিল না। কারণ গভীরতম জঙ্গলের মধ্যে মোবাইলের নেটওয়ার্ক অনবরত যাওয়া-আসা করছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ‘হারিয়ে’ গিয়েছেন যে!
মমতার অবশ্য তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ‘মুখ্যমন্ত্রী’ সম্বোধন করতেই তিনি ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, “ওফ্! আমি এটা একদম পছন্দ করছি না। আমি এখানে এসেছি জঙ্গল দেখতে।” কিন্তু দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নদীর মধ্যে দাঁড়িয়ে কখনও প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন? মমতা হাসলেন, “কেউ কখনও এ ভাবে নদীর মধ্যে কিছু জিজ্ঞাসাই করেনি তো!” তার পর রাজনীতিক, ছবি-আঁকিয়ে এবং কবিতা-লেখা মমতা বললেন, “পৃথিবীর সব শান্তির
জায়গা এখানেই।”
ঘটনা। পাহাড় আর সমতলে শান্তির মেলবন্ধন করতেই তো এসেছেন নতুন মুখ্যমন্ত্রী। |
|
|
|
|
|