|
|
|
|
বাড়ছে ক্ষমতা, প্রত্যাশার চাপে সতর্ক গুরুঙ্গ |
কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি |
সময়ের ব্যবধান তেইশ বছরের। ক্ষমতার ব্যবধানও অনেক।
১৯৮৮ সালের ২২ অগস্ট কলকাতায় রাজভবনে সুবাস ঘিসিং যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করেছিলেন, সোমবারের চুক্তিতে তার থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন বিমল গুরুঙ্গ। কিন্তু একই সঙ্গে মাথায় চাপল পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশার চাপ।
ঘিসিংয়ের গোর্খা পার্বত্য পরিষদের তুলনায় গুরুঙ্গের গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসনের (জিটিএ) দফতর অনেক বেশি। মিলছে আর্থিক সাহায্য এবং সেই টাকা স্বাধীন ভাবে, পছন্দসই খাতে খরচের ক্ষমতা। বাড়ছে অধিকার। এমনকী, সীমানা বাড়ার পথও খোলা থাকছে। আর এর ফলেই প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে আন্দোলনে বিধ্বস্ত পাহাড়বাসীর প্রত্যাশার পারদ প্রায় কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ছুঁয়ে ফেলেছে।
|
|
তাই তৃপ্ত হলেও অতি মাত্রায় সতর্ক বিমল গুরুঙ্গ। চুক্তি সইয়ের প্রাক্কালে মাত্র পাঁচ মিনিটের বক্তৃতায় একাধিক বার গুরুঙ্গকে বলতে শোনা গেল, “গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ বা গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন) যেন ঠিকঠাক কাজ করে, তার খেয়াল রাখতে হবে। তাতে নজর রাখতে হবে কেন্দ্র, রাজ্যকেও।”
বস্তুত, ’৮৮ সালে ঘিসিং যে ক্ষমতা পেয়েছিলেন, তার থেকে অনেকই বেশি ক্ষমতা আদায় করতে হবে এটাই ছিল গুরুঙ্গের চ্যালেঞ্জ। সে কথা অজানা ছিল না কেন্দ্র এবং রাজ্যেরও। তাই চুক্তিপত্রে ‘গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে তাঁরা যে সরছেন না’, সে কথা উল্লেখ করার আর্জি জানিয়েছিলেন গুরুঙ্গ। এবং তাঁর সেই আর্জি রক্ষা করা হয় পাহাড়ে গুরুঙ্গদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা মাথায় রেখেই। শেষ পর্যন্ত অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্বশাসিত সংস্থায় রাজি হয় মোর্চা, যা কিনা সুবাস ঘিসিং পাননি। বরং মূল দাবি থেকে সরেই গোর্খা পার্বত্য পরিষদ গঠনের চুক্তিতে সই করেছিলেন ঘিসিং। শুধু তাই নয়, কেন্দ্র ও রাজ্যের থেকে আলাদা করে কোনও আর্থিক প্যাকেজও আদায় করতে পারেননি ঘিসিং। তারা নানা খাতে যা বরাদ্দ করত, সেই কাজে খরচ করাই ছিল পার্বত্য পরিষদের কাজ।
সেই তুলনায় এ বারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে কার্যত পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে পাহাড়কে। যাতে পাহাড়বাসীই পাহাড় চালাতে পারবেন। কেন্দ্র ও রাজ্যের বরাদ্দ টাকায় পছন্দসই প্রকল্পে বিনিয়োগ করার স্বাধীনতাও পেয়েছেন গুরুঙ্গরা। ঘিসিংয়ের আমলে পার্বত্য পরিষদের ভূমিকা ছিল একটি জেলা পরিষদের মতো। তার অধীনে ছিল পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত। এ বার দার্জিলিঙে ফের চালু হবে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত। সেখানে জেলা পরিষদের উপরে কর্তৃত্ব থাকবে জিটিএ-সভার। যে সভা পরিচালিত হবে প্রায় বিধানসভার আদলেই। চুক্তি অনুযায়ী ওই সভার ৫০ জনের মধ্যে সরকার মনোনীত প্রতিনিধির সংখ্যা মাত্র ৫। ঘিসিংয়ের আমলে পার্বত্য পরিষদের ৪২ প্রতিনিধির মধ্যে ১৪ জনকে সরকার মনোনীত করত। অর্থাৎ, পাহাড়ের উন্নয়নের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণও আগের তুলনায় অনেক কমল। পার্বত্য পরিষদকে যেখানে ১৯টি ক্ষেত্রে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে গুরুঙ্গদের হাতে দেওয়া হয়েছে ৫৯টি দফতর। আগামী দিনে আরও কয়েকটি দফতর মেলার সম্ভাবনাও রয়েছে।
মোর্চার এক নেতা বললেন, “যে পরিমাণ আর্থিক প্যাকেজ ও সেই সঙ্গে তা খরচের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তার অর্ধেক পেলেও পাহাড়ে ২৫ হাজার যুবক-যুবতীর চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা।” বস্তুত, পাহাড়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে বেকারত্ব এখন বড় সমস্যা। এই ব্যাপারে অনেক আশা নিয়েই গুরুঙ্গদের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন যুবক-যুবতীরা। সেটা যে গুরুঙ্গ তথা মোর্চা নেতৃত্ব মাথায় রেখেছেন, তা ওই নেতার কথা থেকেই স্পষ্ট। |
|
এত স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে এমন প্রত্যাশার চাপ রয়েছে বলেই গুরুঙ্গ ও তাঁর অনুগামীরা অত্যন্ত মেপে কথা বলছেন। তার উপরে বিমল গুরুঙ্গের নাম উল্লেখ করে খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম দু’টি ব্যাপারে তাঁকে সতর্ক করে পরামর্শও দিয়েছেন। প্রথম পরামর্শ হল, পাহাড়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ধীরেসুস্থে পদক্ষেপ করতে হবে। যে কাজে কেন্দ্র ও রাজ্য অবশ্যই সব সময় সাহায্য করবে। দ্বিতীয় পরামর্শ, জিটিএ গঠন হওয়ার পরে সেই এলাকায় থাকা সব ভাষাভাষী, সব সম্প্রদায় যেন নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারেন, তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
তাই সতর্ক গুরুঙ্গ। সোমবার পাহাড়ের কোথাও বাজি-পটকা ফাটেনি। বিজয় উৎসবও হয়নি।
ঠিক হয়েছে, আজ, মঙ্গলবার প্রথম কার্শিয়াঙে বিজয় সমাবেশ করবেন গুরুঙ্গ। সেখানে চুক্তির ক্ষমতা-অধিকার-দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন। তার পর বুধবার কালিম্পঙে। শুক্রবার দার্জিলিঙে হবে বিজয় সমাবেশ। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার কথায়, “অনেক টাকা আসবে। অনেক ক্ষমতা। অনেক দায়িত্ব। বেচাল হলে মানুষ কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না। তাই বিজয় সমাবেশ থেকে সতর্ক বার্তাও দেওয়া হবে।”
এক দিন এমন আশ্বাসের কথা শুনিয়েছিলেন সুবাস ঘিসিং। তখন তিনি পাহাড়ের মুকুটহীন একচ্ছত্র সম্রাট। সেই ঘিসিং আজ জলপাইগুড়িতে এক ভাড়া বাড়ির বাসিন্দা। অন্য দিন ঘর থেকে বেরোলেও সোমবার বাইরে পা রাখেননি। বলেননি একটি কথাও। তাঁর সেই তেইশ বছরের পুরনো চুক্তিকে পিছনে ফেলে এ বার গুরুঙ্গের সঙ্গে পা মেলানোর পালা পাহাড়ের।
|
জিটিএ |
ডিজিএইচসি |
• সরকারের প্রতিনিধিত্ব অনেক কম, ৫০ সদস্যে ৫ জন
• ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের উপরে থাকবে জিটিএ
• ৫৯টি দফতর
• কেন্দ্র-রাজ্যের টাকা স্বাধীন ভাবে খরচের সুযোগ
• আসন বেড়ে হয়েছে ৪৫
• তরাই-ডুয়ার্সের কিছু অংশও আওতায় আসার পথ খোলা |
• সরকারের প্রতিনিধিত্ব বেশি ছিল, ৪২ সদস্যের ১৪ জন
• ডিজিএইচসি-র ভূমিকা ছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে জেলা পরিষদের
• ১৯ ক্ষেত্রে ক্ষমতা
• প্রকল্প অনুযায়ী টাকা দিত কেন্দ্র বা রাজ্য
• আসন ছিল ২৮টি
• আওতায় ছিল শুধু পাহাড়ি এলাকা |
|
|
|
|
|
|