প্রবন্ধ ২...
বন্দিমুক্তির সদিচ্ছা প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই
বশেষে বহু প্রতীক্ষিত সেই প্রক্রিয়া শুরু হল। ৪৬ জন রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি ও বিচার ব্যবস্থার নানা আইনকানুনের প্রক্রিয়া পেরিয়ে তাঁদের মুক্তি-পর্ব সমাধা হতে অবশ্য আরও কয়েকটি দিন লাগবে।
বস্তুত, তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারেই তৃণমূল কংগ্রেস জানিয়েছিল, ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং মানবাধিকারকে যথাযথ গুরুত্ব এবং প্রাধান্য দেওয়া হবে। রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে রিভিউ কমিটি গঠন করে দেখা হবে সত্যিই তাঁরা শাস্তি পাওয়ার মতো অপরাধ করেছেন? না কি, প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ক্ষমতায় আসার পরে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই রিভিউ কমিটি গঠন করেন মমতা। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আপাতত ৪৬ জনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু, গত কয়েক দিন ধরে কলকাতার নানা প্রান্তে এই বন্দিমুক্তির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যে ভাবে বিক্ষোভ চলছে, মুখ্যমন্ত্রীর বড়ির কাছে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে বা তাঁর কুশপুতুল পোড়ানো হচ্ছে, তাতে সন্দেহ হয়, কিছু গণ সংগঠন বা মানবাধিকার সংগঠন বুঝি বালিতে মুখ গুঁজে আছে। আইনি নানা প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির কথা তারা হয়তো ভুলে গিয়েছে। মাত্র মাস দেড়েকের এই সরকারের বিরুদ্ধে এখনই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভাঙার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা যায় কি?
ঘোষণা মাত্রই জেলখানার দরজা হাট করে খুলে বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেওয়া যায়? এ রকমটা হলে দেশে বিচারব্যবস্থার কোনও প্রয়োজনই থাকে না! স্রেফ সরকারি ঘোষণাই যথেষ্ট! প্রথমত, তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তেহারে কোথাও বলা ছিল না, তারা ক্ষমতায় এলেই সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিয়ে দেবে। বরং বলা হয়েছিল, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তা খতিয়ে দেখার কাজটি যে শুরু হয়ে গিয়েছে, ৪৬ জনের মুক্তির ঘোষণাই তার প্রমাণ।
দ্বিতীয়ত, সরকার যদি চায়ও, তা হলেও তারা চটজলদি বন্দিদের মুক্তি দিতে পারে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে আদালতের একটা বড় ভূমিকা আছে। আদালত যদি মনে করে, তবেই মামলা প্রত্যাহার করা যায়। যেমন, তামিলনাড়ুর কুখ্যাত চন্দন-দস্যু বীরাপ্পনের কথাই ধরা যাক। তামিলনাড়ু সরকার এক বার বীরাপ্পনের সঙ্গে শান্তিস্থাপনের লক্ষ্যে তার সঙ্গে চুক্তি করতে চেয়েছিল। সেই সময় বীরাপ্পনের হাতে অত্যাচারিত পরিবারের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট চন্দন-দস্যুর উপর থেকে মামলা প্রত্যাহারের আর্জি খারিজ করে দেয়। অত্যাচারিত পরিবারগুলির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সরকার এক দস্যুর সঙ্গে চুক্তি করবে বলে তাঁদের উপরে যে অত্যাচার হয়েছে তার বিচারের পথ কেন বন্ধ করা হবে? একই যুক্তিতে আনা একটি মামলায় ছত্তীসগঢ়ের মানবাধিকার কর্মী বিনায়ক সেনকেও জামিনে মুক্তি দিতে চায়নি হাইকোর্ট।
বিচারাধীন বন্দিদের ক্ষেত্রে সরকার সংশ্লিষ্ট বন্দির মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে। কিন্তু, আদালতের সম্মতিই শেষ কথা। আদালত যদি মনে করে, তবেই কোনও বিচারাধীন বন্দি মুক্তি পেতে পারেন। মামলা প্রত্যাহার করা যায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২১ ধারা অনুযায়ী। কিন্তু, ১৯৮০ সালের পর থেকে এই ধারা মোতাবেক মামলা প্রত্যাহার করাও ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্টও এ ব্যাপারে একাধিক নির্দেশিকা তৈরি করেছে। সরকারি কৌঁসুলিদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট মামলায় সরকারি কৌঁসুলিও সেই মামলা তোলার ব্যাপারে বাধা দিতে পারেন। যেমন, নকশালপন্থী নেতা আজিজুল হকের বিরুদ্ধে কাটিহার কোর্টে মামলা তোলার আর্জির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সরকারি কৌঁসুলি। তাঁর বক্তব্য ছিল, আজিজুল উগ্রপন্থী। পরে অবশ্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তবে, সাজাপ্রাপ্ত বন্দির ক্ষেত্রে তাঁর সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই সরকার রাজ্যপালের কাছে সংশ্লিষ্ট বন্দির মুক্তির ব্যাপারে আর্জি জানাতে পারে।
আবার জামিনে মুক্তি দিয়ে আলোচনার পথও খোলা যেতে পারে। বিশেষ করে মাওবাদীদের সঙ্গে মধ্যস্থতার পথ এতে আরও সুগম হবে। অসমেও আলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া-সহ বিভিন্ন নেতাকে জামিনে মুক্তি দিয়ে শান্তি আলোচনা হয়েছে। ধেমাজি-সহ কয়েকটি স্থানে হিংসাত্মক ঘটনায় তাদের ভুলও স্বীকার করেছে আলফা। এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। কিন্তু, অন্ধ্রপ্রদেশের উদাহরণ ভুললে চলবে না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডি নকশালপন্থীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু সেই আলোচনা শেষমেশ ভেস্তে যায়। নকশালপন্থী নেতারা তাঁদের জন্য ‘সেফ প্যাসেজ’ চেয়েছিলেন। সরকার রাজিও হয়। অন্তরীণ একাধিক প্রথম সারির নকশালপন্থী নেতা প্রকাশ্যে আসেন। কিন্তু, সে সময় ওয়ারাঙ্গলে ভুয়ো সংঘর্ষে নকশালপন্থীদের হত্যার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। এই রাজ্যে কী হবে তা ভবিষ্যৎই বলবে।
এই বঙ্গের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির সম্ভাবনা এই মুহূর্তে অত্যন্ত উজ্জ্বল। সেই ’৭৭ সালের পর থেকে এই সম্ভাবনা আর কখনওই এতটা উজ্জ্বল হয়নি। বন্দিমুক্তি কমিটি, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর) সমেত বিভিন্ন মানবাধিকার ও গণ সংগঠন লাগাতার বন্দিমুক্তির বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন ও দাবি তুলছে। সরব হয়েছে নাগরিক সমাজও। বিভিন্ন মহলের এই দাবিকে ইতিমধ্যেই মান্যতা দিয়েছে সরকার। শুধু তাই নয়, বন্দিমুক্তি ও জঙ্গলমহলে শান্তি ফেরানোর প্রশ্নে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চুক্তি করে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রমাণ রেখেছেন। অন্তত এখন, এই মুহূর্তে তিনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন বলে তাঁকে দোষারোপ করা যায় না।
সরকারি স্তরে সদিচ্ছার প্রমাণ আরও আছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বন্দিমুক্তির ব্যাপারে গঠিত রিভিউ কমিটির সদস্য সচিব কে হরিরাজন বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের জেলে যে কোনও ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা পেতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কাছে অবিলম্বে আবেদন করতে পারেন। এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী আদেশের জন্য ওই আবেদনের প্রতিলিপি আই জি (কারা) তথা রিভিউ কমিটির সদস্য সচিবের কাছে পাঠাতে পারেন। এই বিজ্ঞাপনের বার্তা খুবই স্পষ্ট।
১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়ে যে ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করেছিল, পরবর্তী কালে রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে নানা প্রতিহিংসামূলক আচরণে তাদের সেই পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি একেবারে মলিন হয়ে যায়। নির্বিচার ধরপাকড় থেকে শুরু করে বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে নানা কালা আইন প্রয়োগেও কখনও পিছপা হননি এই রাজ্যের ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা। সেই ’৮০-র দশক থেকেই বামপন্থীরা কখনও স্বীকার করেননি যে এই রাজ্যে কোনও রাজনৈতিক বন্দি আছেন। এমনকী, হালেও বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির ঘোষণাকে ‘বিপজ্জনক’ বলে আখ্যা দেন সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী।
যদি এ বারেও তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় না আসত, তা হলে কি বন্দিমুক্তির বিষয়টি এ ভাবে সামনে আসত? প্রথম দফায় ৪৬ জন বন্দির মুক্তি পাওয়ার কথা ঘোষণা করা হত?
একেবারেই নয়। তাই, বন্দিমুক্তির বিষয়টিকে নাগরিক সমাজের কয়েক জন ও মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সামলাচ্ছেন (ইতিমধ্যেই রিভিউ কমিটির চারটি বৈঠক হয়ে গিয়েছে), তাকে স্বাগত না জানিয়ে উল্টে অনশন-বিক্ষোভ করে পরিস্থিতি ঘোলা করে লাভ হবে কার? বিক্ষোভ দেখানোর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। প্রশ্নটা হল, সেই অধিকার প্রয়োগের ঠিক সময় কি এটাই?
Previous Item Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.