প্রবন্ধ ১...
নিঃশর্ত বন্দিমুক্তি কেন চাই
ঠাৎ রাজনৈতিক অবস্থান বদলকে সাধারণ ভাবে ভোল বদল বা রাজনৈতিক ডিগবাজি বলা হয়ে থাকে। দেখা গেছে, রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের এই ভোল বদল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিরোধী ভূমিকায় বামপন্থী নেতারা ষাটের দশকে সরবে যে সব অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন, বাম জমানায় অনেক ক্ষেত্রেই তা যে পরিবর্তিত হয়েছিল, সেই সত্য কোনও ক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতির ভোল বদলে একটি সাম্প্রতিকতম নিদর্শন হল, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির প্রশ্নে আমাদের সদ্য ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান বদল।
নির্বাচনী প্রচারকালে মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক বন্দি মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ কথা ঠিক যে, তিনি তখন মুক্তির শর্ত নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু এই রাজ্যের ঐতিহ্য বিবেচনা করে সকলেই ধরে নিয়েছিলেন যে তিনি নিঃশর্ত বন্দিমুক্তির কথা বলছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি নানা রকম শর্ত তুলে প্রতিটি কেস পর্যালোচনা করে মুক্তি দানের জন্য ‘রিভিউ কমিটি’ গড়েছেন। তার নির্দেশিকায় ৫ ও ৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক বন্দির জেলে সুব্যবহার, তাঁর সম্পর্কে জেল কর্তৃপক্ষের ধারণা, হিংসার প্রশ্নে তাঁর অবস্থান, মুক্তির পর তাঁর হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে যোগ দানের বা অন্য কাউকে প্ররোচিত করার সম্ভাবনা আছে কি না ইত্যাদি প্রশ্নই তাঁর মুক্তির জন্য কমিটির সুপারিশের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নেবে।
কারামুক্তির পরে। নকশাল নেতা সৌরীন বসু ও কানু সান্যাল। ১৯৭৯
এই নির্দেশিকা ধরেই রাজ্যে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে। বন্দিমুক্তি কমিটি ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি রাজ্যে ৪৩০ জন রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দাবি করলেও সরকারি তালিকায় রয়েছেন ২৬৭ জন। যাঁদের মধ্যে ৮৩ জন রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদা পেয়েছেন। আরও ১১ জনের ক্ষেত্রে তা আপাতত বিবেচনাধীন। এই ৮৩ জনের মধ্যে ৪৬ জনের আশু মুক্তির সম্ভাবনা মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। মুক্তিদানের প্রক্রিয়াটি অর্থবহ। যেহেতু এই ৪৬ জনেরই কেস অত্যন্ত লঘু, সরকারি আপত্তি না থাকলে এঁরা স্বাভাবিক ভাবেই জামিনে মুক্ত হবেন। মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনা হল, এঁরা জামিনের আবেদন করবেন, সরকার বিরোধিতা করবে না। মাতঙ্গিনী মহিলা সমিতির দেবলীনারা বা এ পি ভি আর সংগঠনের রাংতা মুন্সিরা কেন এই উদ্যোগের বিরোধিতায় নেমেছেন তা বোঝা কঠিন নয়। আক্ষেপ এটাই যে, রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি আন্দোলনের যে সব নেতা এত দিন নিঃশর্ত বন্দি মুক্তি দাবি করে এসেছেন, তাঁদেরই কেউ কেউ এখন এই প্রহসনের পক্ষে ওকালতিতে নেমেছেন। স্পষ্টতই মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে ‘জেনারেল অ্যামনেস্টি’র লাইনে ভাবছেন না। এটি দুর্ভাগ্যজনক।
অথচ রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে ‘সর্বজনীন সাধারণ মার্জনা’ এ দেশে কোনও নতুন ঘটনা নয়। সামন্ত আমলে বা ব্রিটিশ জমানাতেও এই রীতি চালু ছিল। বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের পরেই জেনারেল অ্যামনেস্টি ঘোষিত হয়। দলতন্ত্রে অভিযুক্ত বামপন্থীদের এই সিদ্ধান্তে নকশালপন্থীদের সঙ্গে সঙ্গে বহু কংগ্রেস নেতা-কর্মী জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। লক্ষণীয়, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন জনতা দলের ও কংগ্রেসের বন্দিমুক্তি প্রশ্নে অবস্থান তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জনতাশাসিত বিহারে আমার ৯টি কেস ছিল। ‘সাধারণ মার্জনা’ দিতে জনতা দল রাজি ছিল না। তাই আদালতে আমার কেস উঠলে বিহারের জনতা দল সরকার বিরোধিতা না-করায় আমি এক বছর পর ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাই। আমার হয়ে তখন বন্দিমুক্তি আন্দোলনের নেতা অধৃষ্য কুমার ও শরদিন্দু রায়কে পটনা-দুমকা দৌড় করতে হয়। কানু সান্যাল, সৌরেন বসু নিম্ন আদালতেও আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। নিঃশর্ত মুক্তিদানে কংগ্রেস সরকার রাজি ছিল না। ১৯৭৯ সালে কানুদা, সৌরেনদা হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পান। আজ যাঁরা মমতাদেবীর ‘রিভিউ কমিটি’র ওকালতি করছেন, এই ইতিহাস তাঁদের অজানা নয়। আসলে তাঁরা মমতাদেবীর চিন্তাভাবনার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। এই আত্মসমর্পণ বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা রূপে চিহ্নিত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
এই চিহ্নিতকরণ অবশ্য নতুন কিছু নয়। ১৯৭৭ সাল। পালাবদলের পর জনতা দল কেন্দ্রে আসে। রাজ্যে বন্দিমুক্তি আন্দোলন রাজ্যে তুঙ্গে। বন্দিমুক্তি নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরণ সিংহের নির্দেশে তিসহাজারি কোর্টে কেস দেখিয়ে আমাদের সাত জনকে সম্ভবত বন্দিমুক্তি প্রশ্নে আলোচনার জন্য দিল্লিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তিহার জেল থেকে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা কৃষ্ণকান্তজি। সঙ্গে সত্যনারায়ণ সিংহ। এই সাত জন হল কানু সান্যাল, সৌরেন বসু, জঙ্গল সাঁওতাল, সন্তোষ রাণা, সাধন সরকার, মিহির রাণা এবং আমি। কানুদা, সৌরেনদা, জঙ্গলদা এবং আমি শুধু কৃষ্ণকান্তের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বাকিরা দু’জনের সঙ্গেই কথা বলেন। আলোচনায় কৃষ্ণকান্তজি মারফত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই প্রস্তাব আসে যে, অতঃপর হিংসা পরিহার করার শর্ত মেনে নিয়ে বিবৃতি দিলে আমাদের সকলকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। আমরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করি। এর ফলে, আমাদের দ্রুত কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। এর পরের ঘটনার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। দিল্লি থেকে সত্যনারায়ণ সিংহ এমন একটি বিবৃতি দেন এবং এখানে বলা হয় যে, সত্যনারায়ণ সিংহের ওই বিবৃতিকে সমর্থন করে যাঁরা জেল সুপারের কাছে চিঠি দেবেন, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। এই ঘটনায় তৎকালীন বন্দিমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক পীযূষ দে-কে আমরা চার জন অনুরোধ করি যে, তিনি যেন এই প্রয়াসকে বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে চিহ্নিত করে অবিলম্বে বিবৃতি দেন। অনেকের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কায় পীযূষবাবু এই ধরনের বিবৃতি দিতে অপারগতা জ্ঞাপন করেন। বাধ্য হয়ে কানুদা, সৌরেনদা, জঙ্গলদা ও আমি পঞ্চম ট্রাইবুনালে কাঠগড়া থেকে বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে এই বিশ্বাসঘাতকতাকে ধিক্কার জানাই। সর্বোদয় নেতা ক্ষিতীশ রায়চৌধুরী জেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং হিংসা পরিহারের শর্তে মুক্তি ক্রয় করার বিষয়ে আমাদের মনোভাবের কথা জানতে চান। আমরা নির্দ্বিধায় তাঁকে জানাই যে, এই প্রস্তাব আমাদের মর্যাদা এবং রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের পরিপন্থী।
এই ইতিহাস দেখিয়ে দেয়, শর্তসাপেক্ষে বা পরোক্ষে মুচলেকা দিয়ে বন্দিমুক্তির চিন্তাভাবনাকে পরাজিত করেই নিঃশর্ত বন্দিমুক্তি অতীতে ঘটেছে। আমি জানি যে যাঁরা শর্তসাপেক্ষে মুক্তির কথা বলছেন, বন্দিদের জন্য শুভেচ্ছায় তাঁদের কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু তাঁরা বুঝতেই পারছেন না যে, এই প্রশ্নে মমতাদেবীর চিন্তাভাবনার কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ, রাজনৈতিক বন্দিদের মর্যাদাকে খাটো করা, নিঃশর্ত বন্দিমুক্তি আন্দোলনকে দুর্বল করা এবং একাংশের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে অপরাংশের, যাঁরা জেলে রয়ে গেলেন, কারারুদ্ধ থাকাকে ন্যায্যতা দেওয়া এক কথায়, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। তাঁরা কিছু বন্দির মুক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, রাজনৈতিক বন্দিদের মর্যাদা ও বন্দিমুক্তি আন্দোলনের ঐতিহ্যকে নাকচ করছেন। সরকারি ভাবনা হল, দীর্ঘ কারাবাসে রাজনৈতিক বন্দিরা নিজেদের পাল্টাতে বাধ্য হবেন। অভিজ্ঞতা বলে, এটা সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। আজকের রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্ত, স্বাধীন মানুষ হিসেবে নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনতে পারেন সেটাই স্থায়ী হয়, সমাজগ্রাহ্য হয়। নিঃশর্ত রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি সেই সুযোগকে উন্মোচিত করে। ইতিহাসের শিক্ষাও তা-ই। নিঃশর্ত মুক্তি এ কারণেই সমাজের পক্ষে শুভ হয়েছে। রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির গুরুত্ব এখানেই।
Previous Item Editorial Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.