|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ |
বিচারবিভাগের অতি-সক্রিয়তা লইয়া কেন্দ্রীয় সরকার আপত্তি জ্ঞাপন করিয়াছে। বেশ কিছু কাল ধরিয়াই কখনও জনস্বার্থ মামলার শুনানির সময়, কখনও স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া গ্রহণ করা বিভিন্ন মামলার রায় দিতে গিয়া বিচারপতিরা সরকারকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করিতেছেন। কালো টাকা উদ্ধার ও বিদেশে জমানো সেই টাকা উদ্ধারের প্রশ্নে কেন্দ্রের ‘গড়িমসি’র নিন্দা করিতে গিয়া সুপ্রিম কোর্ট এমনকী সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির মাথায় শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতিকেও বসাইয়া দিয়াছে। সরকার ক্ষুব্ধ। ক্ষোভ স্বাভাবিক। কালো টাকা উদ্ধারের তদন্ত কোন পথে, কী ভাবে অগ্রসর হইবে, তাহা কিন্তু আদালতের বিচার্য হইতে পারে না। ইহা সরকারের আর্থিক নীতির বিষয় এবং একটি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, যাহা একান্ত ভাবেই সরকারের এক্তিয়ার, আদালতের নয়। শীর্ষ আদালত এ ক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা করিয়াছে, কি না, সেই প্রশ্ন অত্যন্ত সঙ্গত। তদন্ত কমিটিতে যদি কোনও আইন-বিশেষজ্ঞকে রাখিতে হয়, সরকারই তাঁহাকে নিয়োগ করিবে, সুপ্রিম কোর্ট কোন অধিকারে দুই বিচারপতিকে কমিটির মাথায় বসাইয়া দেয়?
বহু বিষয়েই দেখা যাইতেছে, প্রশাসনের নিয়মমাফিক কাজগুলির সঞ্চালন-পদ্ধতিও বিচারপতিরা নির্ধারণ করিয়া দিতেছেন। বাবা রামদেবের ‘উপবাস-আন্দোলন’-এর সময়, তাঁহার সমবেত সমর্থকদের রামলীলা ময়দানের তাঁবু হইতে উৎখাত করার বিষয়টিও শীর্ষ আদালত ভাল চোখে দেখে নাই। এ ব্যাপারেও কড়া মন্তব্যে সরকারের সমালোচনা। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে, সরকার যন্তর-মন্তরে সুশীল সমাজের দুর্নীতি-বিরোধী সত্যাগ্রহ ভাঙিতে বলপ্রয়োগ করিতে পারে, ইহা ধরিয়া লইয়া আন্না হাজারে সুপ্রিম কোর্টের কাছে অবাধ সমাবেশ আয়োজনের আগাম অনুমোদন চাহিয়া বসিয়াছেন। এ সবই কিন্তু এক বিপজ্জনক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করিতেছে, যাহা শাসন বিভাগের পরিবর্তে বিচারবিভাগের হস্তেই শাসনকার্য চালনার দায়িত্ব তুলিয়া দিতে চায়। অথচ ভারতীয় গণতন্ত্রে তেমন কোনও বন্দোবস্তের অবকাশ নাই।
ভারতীয় সংবিধান-প্রণেতাগণ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিভাজন করিয়া গিয়াছেন। সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় গণতন্ত্রে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের এক্তিয়ারের সীমানা সুচিহ্নিত। শাসন বিভাগের কাজে অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটি থাকিলেও বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা দ্বারা তাহা পূরণ করার কোনও বিধান সংবিধানে নাই। অথচ বিচারবিভাগ, বিশেষত শীর্ষ আদালতের কাজেকর্মে উত্তরোত্তর সেই প্রবণতাই স্পষ্ট হইতেছে। ভারতের বর্তমান প্রধান বিচারপতিও কিন্তু তাঁহার মর্যাদাময় আসনে অভিষিক্ত হওয়ার পরেই এই অতিসক্রিয়তা হইতে বিরত হইয়া আপন এক্তিয়ারের মধ্যে বিচারপতিদের কাজ করিতে সতর্ক করিয়াছিলেন। অতি-সক্রিয়তা লইয়া বিতর্কটি ছিলই, যেমন এখনও আছে এবং সেই প্রেক্ষিতেই প্রধান বিচারপতির সতর্কবার্তা। ভারতীয় গণতন্ত্র যেহেতু পরিষদীয় এবং প্রতিনিধিত্বমূলক, তাই শাসনক্ষমতর বিন্যাসে এখানে আইনসভা তথা সংসদই সার্বভৌম। সরকারও এই সংসদ হইতেই নির্বাচিত। তাই জনপ্রতিনিধিত্বের বৈধতাও এই সরকারের সর্বাধিক। আইনের শাসন বলবৎ রাখা এবং সংবিধানের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের নিশ্চয় কিছু অনন্য ভূমিকা রহিয়াছে, কিন্তু সেই ভূমিকা বিচারবিভাগকে শাসনবিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয় না। যাহার যাহা কাজ, তাহা দায়িত্ব সহকারে, নিষ্ঠার সহিত করিয়া যাওয়াই ভারতীয় সংবিধানের অভিপ্রায়। |
|
|
|
|
|