|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
কল্যাণরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ |
গত আড়াই বৎসরে বারাক ওবামা যাহা করেন নাই, বৃহস্পতিবার তাহাই করিলেন। একটি বৈঠক চলিতেছিল প্রেসিডেন্ট বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িলেন। মেজাজ হারাইবার কারণ বিলক্ষণ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখন শিরে সংক্রান্তি। কংগ্রেস যদি এই মাসের মধ্যেই প্রেসিডেন্টের ঋণ করিবার ঊর্ধ্বসীমা না বাড়ায়, তবে অগস্টের গোড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছু ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইবে। তাহাতে দেশের ক্রেডিট রেটিং ক্ষতিগ্রস্ত হইবেই। বস্তুত, মুডিজ এবং স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুয়োর, উভয় সংস্থাই জানাইয়াছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং পুনর্বিবেচনা করা হইবে। অর্থ সহজ ভবিষ্যতে ঋণের খরচ বাড়িবে। এই অবস্থায় যদি কোনও সমাধানসূত্র খুঁজিয়া না পাওয়া যায়, মেজাজ হারানোই স্বাভাবিক। ইউরোপের নেতারাও মেজাজ হারাইতেছেন কি না, তাহা জানা নাই। কিন্তু, তাঁহাদের সংকটও গভীর। গ্রিস প্রায় মৃত্যুশয্যায়, পর্তুগাল ও স্পেন ধুকিতেছে, ইতালিও ভারসাম্য হারাইয়াছে। সকলেরই ঋণের দায়। এই দেশগুলিকে দেখিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খানিক আশ্বস্ত হইতে পারেন দেনায় আকণ্ঠ ডুবিয়া থাকার সমস্যাটি এখন বহুজাতিক।
যাহা হোয়াইট হাউস এবং মহাকরণকে এক সূত্রে বাঁধিয়াছে, তাহার নাম ঋণ করিয়া ঘৃত পান করিবার অভ্যাস। ঘৃত পান মাত্রেই বিলাসিতা নহে, সামর্থ্যের অতিরিক্ত ব্যয় করিবার প্রবণতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন স্যোশাল সিকিয়োরিটি, ভারতে তেমনই খাদ্যের নিরাপত্তা আইন। বামফ্রন্টের জমানায় পশ্চিমবঙ্গে যেমন যথেচ্ছ সরকারি কর্মী নিযুক্ত হইয়াছে, বেতন বাড়িয়াছে। প্রতিটি উপাখ্যানের মূলেই রহিয়াছে কিছু পাওয়াইয়া দিবার বাসনা। সেই বাসনা মাত্রেই যে অন্যায়, তাহা নহে। ভারতের সাম্প্রতিক খাদ্যের নিরাপত্তা আইন যেমন। দেশের সরকার যদি সকল মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা করিতে পারে, তাহাতে মন্দ কী? প্রশ্ন হইল, সেই সাধ্য আছে কি না? ভারতের অর্থমন্ত্রী হইতে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, সকলেই বলিবেন, সরকারের এই সদিচ্ছা বাস্তবায়িত করিবার সাধ্য, অন্তত আপাতত, নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সামাজিক নিরাপত্তার খাতে বিপুল ব্যয়ের সাধ্য নাই। সাধ্যের অতিরিক্ত চেষ্টা করিলে তাহার ফল কতখানি মারাত্মক হইতে পারে, ইউরোপ এখন হাড়ে হাড়ে বুঝিতেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতেই সেই অবস্থা হইবে, সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু, সমস্যার চরিত্রটি এক। প্রশ্নটি বৃহৎ: কল্যাণরাষ্ট্রের দর্শন মানিয়া চলিবার সামর্থ্য কি কোনও দেশেরই আছে?
কোন দেশ কী উপায়ে টাকার সংস্থান করে, বা আদৌ করিতে পারে কি না, তাহার উপর প্রশ্নটির উত্তর নির্ভর করিতেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন রাষ্ট্রের ব্যয় কমাইবার পন্থার সন্ধান চলিতেছে। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য, যাঁহারা প্রকৃতই ধনী, তাঁহাদের উপর বাড়তি করের বোঝা চাপাইয়া দেওয়া হউক। প্রস্তাবটি চরিত্রে বামপন্থী, ফলে কিঞ্চিৎ অবাস্তব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধনী শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিপত্তি যথেষ্ট। কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যেই রক্ষণশীল টি পার্টি-র উত্থান এই প্রতিপত্তির পরিচায়ক। এই বাধা প্রবল, এবং তাহাতেই প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব আটকাইয়াছে। রক্ষণশীল গোষ্ঠীর দাবি, সরকার সামাজিক ব্যয় হ্রাস করুক। সমস্যাটি শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নহে, তাহা প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক। ভারতের ক্ষেত্রেই যেমন। দেশের বিপুল মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনও যে পরিমাণ ভর্তুকি ভোগ করে, তাহা বিলুপ্ত হইলেই কল্যাণখাতে ব্যয়ের একটি বড় অংশ উঠিয়া আসে। কিন্তু, যে দেশে সরকার এক টাকা বাস ভাড়া বাড়াইতে সাহস করে না, মধ্যবিত্তের অসন্তোষের ভয়ে, সেই দেশে ভর্তুকি বিলোপের প্রস্তাব অলীক। গ্রিসের সরকার দায়ে পড়িয়া কঠোর আর্থিক নীতি গ্রহণের কথা বলামাত্রই দেশব্যাপী অসন্তোষের আগুন জ্বলিতেছে। অতএব, এই পথে কল্যাণব্যয়ের অর্থের সংস্থান সম্ভব নহে। অন্য পথ না খুঁজিয়া পাইলে কল্যাণরাষ্ট্রের দর্শন অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রশ্নের সম্মুখীন হইবে। |
|
|
|
|
|