|
|
|
|
টলিউড একসুর, এ বার সতর্ক না হলেই নয় |
ইন্দ্রনীল রায় |
এ বার একটু সতর্ক হতে হবে।
সোমবার সকালে ভয়াল আগুনে লাখ লাখ টাকার সেট পুড়ে যাওয়ার পরে এখন এটাই ভাবছে টলিউড।
আনোয়ার শাহ রোডের ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওয় ওই আগুনে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে ‘মেঘের পালক’ টেলি সিরিয়ালের সেট। যার কোনও রকমের বিমা করানো নেই। এই সিরিয়ালের প্রযোজক ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় বলছেন, সব মিলিয়ে ৪০ লক্ষ টাকার জিনিস ছিল ওই সেটে।
বিমা নেই। সাবধানতা নেই। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই-এর তালিকাটা এত লম্বা বলেই সোমবার আগুনের গ্রাসে বেরিয়ে এসেছে টলিউডের ‘দৈন্য দশা।’ এমন একটা অগ্নিকাণ্ড খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয়, লাভের অঙ্কে টলিউড হু হু করে এগোতে শুরু করলেও তলে তলে কতটা অব্যবস্থা এবং অবহেলা এখনও রয়েই গিয়েছে। সেই ভুলেরই খেসারত দিতে হল সোমবার ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে এখন শোনা যাচ্ছে এই গুঞ্জন।
ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওয় একাধিক ছবির শু্যটিং করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। অগ্নিকাণ্ডের খবরে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন প্রসেনজিৎ। বললেন, “আমাদের কাছে স্টুডিও এবং ফ্লোর হচ্ছে মন্দির। সেটা এ ভাবে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেল দেখে আমি অত্যন্ত আহত এবং দুঃখিত।” তার পর কিছুটা আবেগতাড়িত হয়েই বলে ওঠেন, “ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওয় ‘কালপুরুষ’-এর (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত) উত্তর কলকাতার সেটটা এখনও রয়েছে। সেটা আমি নিজের হাতে বানিয়েছিলাম।” কিন্তু সোমবার যা হয়েছে, তার পরে সত্যিই ফের সতর্ক হওয়া দরকার মনে করছেন প্রসেনজিৎ। তাঁর সাফ কথা, “গত ছ’সাত বছরে টালিগঞ্জে টাকার জোয়ার এসেছে। ভাবলেও ভাল লাগে ইন্ডাস্ট্রিতে এত টাকা আসছে। কিন্তু তার পরেও আমরা কিন্তু দায়িত্ববান হচ্ছি না। আমি এখন প্রযোজক হিসেবে সব কিছুর বিমা করাই। সানন্দা টিভিতে আমার নতুন সিরিয়াল, অন্য একটি চ্যানেলে ‘অদ্বিতীয়া’ সবই পুরোপুরি বিমার আওতায়। কিন্তু সবাই কি সেটা করে? মনে হয় না।” |
|
ঘটনাস্থলে সব্যসাচী ও মিঠু চক্রবর্তী। নিজস্ব চিত্র |
স্টুডিও-মালিকদের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলেছেন প্রসেনজিৎ। তাঁর মন্তব্য, “টেকনিশিয়ান, প্রযোজক বা অভিনেতারা যাতে ভাল পরিবেশে কাজ করতে পারেন, তার জন্য স্টুডিও মালিকরা কি যথেষ্ট চেষ্টা করেন?” উত্তরটা শোনা যায় প্রসেনজিতের মুখেই, “না, তাঁরা করেন না। আমরা খুব সাংঘাতিক পরিবেশে কাজ করি।” তবে এ ক্ষেত্রে অভিনেতা-প্রযোজকদের ভূমিকাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না ইন্ডাস্ট্রির অলিখিত এই ‘অভিভাবক’। তাঁর মতে, “এক সময় আমরা অভিনেতা, প্রযোজক, টেকশিয়ানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে বেশ কিছু স্টুডিও বয়কট করব। কারণ সেখানে ঠিকঠাক পরিকাঠামো নেই। কিন্তু পারিনি। যেই কোনও কাজ এল, আমরা সব ভুলে গিয়ে শু্যটিং শুরু করে দিলাম। জানি সবারই টাকার দরকার। কিন্তু এতটুকু দায়িত্ববোধ থাকবে না? এটাই আমার সব চেয়ে বড় চিন্তা। আমরা দায়িত্বশীল না হলে ভারতলক্ষ্মীর মতো ঘটনা আবারও ঘটবে।”
বিষয়টাকে অবশ্য কিছুটা মানবিক দিক থেকে দেখতে চাইছেন প্রযোজক এবং ‘প্রোডিউসার্স গিল্ড’-এর সেক্রেটারি যিশু দাশগুপ্ত। তাঁর মন্তব্য, “স্টুডিওগুলো প্লট হিসেবেও লোভনীয়। ওখানে ফ্ল্যাট বা কমপ্লেক্সও তৈরি হয়ে যেতে পারে। তাই পরিস্থিতি খুব জটিল। আশা করব সরকার বিষয়টা যত্নের সঙ্গে দেখবে। স্টুডিও মালিকদের ভয় দেখানোর কোনও মানে হয় না। তা হলে ওঁরা স্টুডিও বিক্রি করে দেবেন। বরং ওঁদের জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, ওঁরা কী চান, ঠিক পরিবেশ তৈরির জন্য কী কী প্রয়োজন। কিন্তু সব কাজই করতে হবে মানবিকতার সঙ্গে। বিমা বলুন, স্টুডিও পরিকাঠামো বলুন আমরা অভিনেতা, টেকনিশিয়ান, প্রযোজকরা যদি সামগ্রিক
দায়িত্ব না নিই, তা হলে টলিউডের পুনর্জন্মের গল্পটাও
অর্থহীন হয়ে যাবে।” যিশু মনে করেন, “বার বার সতর্ক হতে হবে বললেই চলবে না। এ বার মানে এ বারই।” অভিনেতা
সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং রুদ্রনীল সেনগুপ্ত জানালেন, শহরে নতুন যে সব স্টুডিও হচ্ছে, সেগুলো ভাল হলেও পুরনোগুলোর
হাল বেশ খারাপ।
সোমবারের আগুনে আংশিক পুড়ে গিয়েছে ‘সিঁদুর খেলা’-র সেটও। বাংলায় ফিল্ম এবং সিরিয়ালের এক নম্বর প্রযোজক ভেঙ্কটেশ ফিল্মস-এর প্রযোজনায় চলা এই সিরিয়ালের সেটেরও কোনও বিমা করানো নেই। ভেঙ্কটেশ-এর মহেন্দ্র সোনি বললেন, “সিঁদুর খেলার জন্য আমাদের কোনও বিমা নেই। চরম শিক্ষা হল।” তবে আপাতত আগুনের কথা ভুলে গিয়ে রোজ সিরিয়াল সম্প্রচারের ভাবনাই তাড়া করেছে প্রযোজকদের। আগুন নেভানোর কাজ শেষ হতেই প্রযোজক-চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বৈঠকে বসেন। কোথায় কোন স্টুডিও ফাঁকা আছে, আলোচনা হয় তাই নিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রোডাকশন কর্মী জানালেন, ‘মেঘের পালক’-এর আর হয়তো দু’টো পর্ব তৈরি আছে। তাই খুব দ্রুত শু্যটিং শুরু হওয়া দরকার। সম্প্রচার বন্ধ হলে চ্যানেল সমস্যায় পড়বে। সেটা তো হতে দেওয়া যায় না।
প্রিয়া সিনেমার কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত বলছেন, “শহরে কয়েকটা মাত্র স্টুডিও। ভারতলক্ষ্মীর এই অবস্থার পরে ইন্ডাস্ট্রির অভাব আরও বেড়ে গেল।” শু্যটিং সেটের চাহিদাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে। শহরের বেসরকারি স্টুডিওগুলোর অন্যতম ভারতলক্ষ্মী-তে মূল সেট তিনটি হলেও শু্যটিং হত অন্তত পাঁচ-ছ’টিতে। ইন্দ্রপুরীতে সেট গোটা চার। নিউ থিয়েটার্সে দু’টি বড় সেট। চাহিদা মেটাতে রেকর্ডিং-ডাবিংয়ের ঘরগুলিতেও জোড়াতালি দিয়ে শু্যটিং হচ্ছে। বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর দেড় বছর হল খুলেছে ‘ক্যালকাটা মুভিটোন’। সেখানে দু’টি সেট। রিজেন্ট পার্ক থানার কাছে একটি বন্ধ কারখানাকে স্টুডিও করা হয়েছে। তাতেও মিটছে না চাহিদা।
রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে কী ভাবছে?
তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর সূত্রের খবর, এক সময় যেটা ছিল কলকাতা দূরদর্শনের স্টুডিও, রাধা স্টুডিওর সেই অংশ সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। শীঘ্রই তা শু্যটিংয়ের জন্য দেওয়া হবে। টেকনিশিয়ান্স-১ চত্বরে পাঁচতলা ভবন তৈরির প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। অর্থ মঞ্জুর হলেই সেটির কাজ শুরু হবে। |
|
|
|
|
|