গর্ত ভরাট করার ছাই ধসে চার জনের মৃত্যুর দেড় দিনের মধ্যে ফের একই ঘটনা ঘটল অন্ডালের পরাশকোলে। শনিবার সন্ধ্যায় যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সোমবার ভোরে সেখান থেকে ফুট দশেক দূরে আবার ছাই বসে গিয়ে গর্ত তৈরি হয়। যথারীতি, ছাই দিয়ে ধস ভরাট করা এলাকায় ছিল না কোনও বেড়া। নেই কোনও সতর্কীকরণ বোর্ডও। তবে ভাগ্যক্রমে কেউ হতাহত হননি।
শনিবার সন্ধ্যায় পরাশকোলে তারক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর মেয়ে বৃষ্টি, তারকের বন্ধু বাবন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ছেলে সায়ন ধসপ্রবণ এলাকায় ছাই বসে গিয়ে তলিয়ে যান। সারা রাত ধরে মাটি কাটার পরে রবিবার সকালে তাঁদের দেহ মেলে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এর পরে সোমবার ভোরে এলাকার অনেকের বাড়িতে ফাটলের আওয়াজ শোনা যায়। সকালে দেখা যায়, রবিবার যেখান থেকে চার জনের দেহ মেলে তার অদূরেই ছাই ধসে তৈরি হয়েছে একটি গর্ত। |
ফাটল ধরেছে তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, মলয় বন্দ্যোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, বাপি মণ্ডল, প্রভাত চট্টোপাধ্যায়-সহ প্রায় ৩০ জন গ্রামবাসীর বাড়িতে। ফাটল দেখা গিয়েছে মৃত বাবন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও। এমন ফাটলের জেরে বাসুদেব মণ্ডল নামে এক বাসিন্দার বাড়ির কুয়োর পাড় ভেঙে গিয়েছে। গ্রামের একটি দুর্গা মন্দিরেরও প্রায় দেড় ফুট অংশ বসে গিয়েছে।
এ দিন সকাল ১১টা নাগাদ পরাশকোল কোলিয়ারির এজেন্ট ওয়াই প্রসাদ এবং ম্যানেজার সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় এলাকা পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে বাসিন্দাদের রোষের মুখে পড়েন তাঁরা। এলাকার মানুষ, প্রধানত মহিলারা ঘেরাও করেন তাঁদের। ধসের জেরে বিপন্ন বাড়িগুলি ওই দুই কর্তাকে ঘুরে দেখতে বাধ্য করেন তাঁরা। ওই দুই আধিকারিকের কাছে গ্রামবাসী পুনর্বাসনের দাবি জানান। গ্রামবাসীর কাছে দুই আধিকারিক আটকে রয়েছেন জানতে পেরে দুপুর ২টো নাগাদ অন্ডাল থানার পুলিশ গ্রামে যায়। এর পরেই গ্রামবাসী ওই দুই আধিকারিককে ছেড়ে দেন। এ দিকে, এ দিনই শ্রম দফতরের অধীনস্ত ডিরক্টর জেনারেল অফ মাইনস সেফটি-র দুই আধিকারিক পরাশকোলে ধস নামার ঘটনার তদন্তে যাওয়ার জন্য অন্ডালের কাজোড়া এরিয়া কার্যালয়ে পৌঁছন। তবে পরাশকোলে গিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভের মুখে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় এ দিন আর তাঁদের গ্রামে যেতে দেননি ইসিএল কর্তৃপক্ষ।
এ দিন বিকেলে ডিজিএমএসের ডেপুটি জেনারেল অফ মাইনস সেফটি এস এস মিশ্র জানান, পরাশকোল এলাকায় জাতীয়করণের আগে ভূগর্ভস্থ খনি ছিল। পরে ইসিএল একটি খোলামুখ খনি করে উপরিভাগের কয়লা কেটে নেয়। |
১৯৮৯ সালে সেই খোলামুখ খনি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরে ওই এলাকায় ব্যাপক হারে অবৈধ খনন হওয়ায় পুরো এলাকা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। এস এস মিশ্র জানান, ইসিএল তাঁদের জানিয়েছে, দিন সাতেক আগে রাস্তার পাশে ধস নামার পরে সেখানে বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভরাটের কাজ করতে মাটি কাটার যন্ত্র, গাড়ি ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ার জন্য বেড়াটি খুলে দিতে হয়। ইসিএল তাঁদের আরও জানিয়েছে, ওই এলাকায় অবৈধ খাদান বন্ধ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের।
এস এস মিশ্র বলেন, “আমরা তদন্ত শুরু করেছি। ইসিএলকে ওই এলাকাটি পদ্ধতি মেনে ভরাট করার নির্দেশ দিয়েছি।” ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায়ও দাবি করেন, অবৈধ খননের জেরেই ওই এলাকায় বারবার ধস নামছে। এ নিয়ে বেশ কয়েক বার তাঁরা পুলিশের কাছে অভিযোগও জানিয়েছেন। তবে বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের দাবির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতর বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এ দিকে, দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ময়না-তদন্ত হওয়ার পরে এ দিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তারক, বৃষ্টি, বাবন ও সায়নের দেহ। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। এর পরে গ্রামের রীতি মেনে দেহগুলি বাড়ি থেকে দেবী পদ্মাবতীর স্থান, সেখান থেকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দিন বিকেল ৩টে নাগাদ গ্রামে মৌন মিছিল করেন বাসিন্দারা। তৃণমূলের পাণ্ডবেশ্বর ব্লক সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সরকার বলেন, “অবৈধ খনন রুখতে পুলিশ এবং ইসিএলের কাছে বারবার আবেদন জানানো হয়েছে। পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েও ফল হচ্ছে না। চার জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে মৌন মিছিল করে ফের এ সব দাবি জানানো হয়েছে।” |