রবিবাসরীয় গল্প
রানির পোশাক
কাল থেকেই বাড়িতে একটা সাজো সাজো রব। মেজ মাসি আসবে নতুন বউদিকে নিয়ে। নতুন বলতে একেবারেই নতুন। ফাল্গুনে বিয়ে হয়েছে সবে। এখনও গা থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে বিয়ের গন্ধ। ছোট মাসির মেয়ে আট বছরের রিয়া তো বাপ্পাদার বিয়ে, নতুন বউ আসা, গিফ্ট পাওয়া, খাওয়াদাওয়া, হইচই, আনন্দ রোশনাই দেখে এমন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে যে, বায়না ধরেই বসে আছে ওকেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক। বর? কেন? টুবলুদা তো রয়েছে। ওর তো বিয়ে হয়নি এখনও! সে কী রে? মাসির ছেলেকে কেউ বিয়ে করে নাকি? রিয়া বিরক্ত। ‘টুবলুদা তো বেশ ভাল ছেলে, তোমরাই তো বলো রূপাই দিদিকে একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিতে হবে।’
‘বা, বা, তা হলে তো তোর আগে রূপাইয়ের সঙ্গেই টুবলুর বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত কি না? বোকা কোথাকারে? রূপাই, তুই, তোরা হলি টুবলুর বোন। ভাই বোনে বিয়ে হয় না বুঝলি ঘণ্টি’?
এত শত রিয়া বোঝে না। ওর বউ সাজা নিয়ে কথা, অ্যাটেনশন পাওয়া নিয়ে কথা। তা ছাড়া বাবার যেমন গায়ে লোম নেই, প্লেন, টুবলুদারও তো তাই! লোমওলা পুরুষ রিয়া মোটে পছন্দ করে না। বড় মেসো ওকে আদর করতে গেলে নাক-টাক কুঁচকে বলে ওঠে, ‘উফ্, এত জ্বালাতন করো কেন গো?’
সে যা-ই হোক, আজ এ বাড়িতে ছোট মাসিও আসবে রিয়া-সহ। বড় মাসি আসবে। সেই মতো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। মা’দের এই একটা ব্যাপার, সুযোগ পেলেই বোনেরা এক হতে চায়। এঁটো হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে কী যে সেই এক গল্প ছোট থেকে শুনেই যাচ্ছে, শুনেই যাচ্ছে রূপাই, তিন্নি। বাবাও তো বলে, ‘তোর মা, মাসিদের ছোটবেলার সব গল্প আমার মুখস্ত!’
এখন আবার মায়ের ছোট মাসি এসে রয়েছে রূপাইদের বাড়িতে। বাবা সে দিনই বলছিল তাকে, ‘দ্যাখ, দ্যাখ রূপাই, তোর মা-র ছোট মাসি, ন’মামা এলে দোষ নেই, কিন্তু আমার সোনামাইমা, ফুলপিসিরা দু’দিন এসে থাকুক তোর মা মুখ তোলা হাঁড়ি করে ঘুরে বেড়াবে, কথায় কথায় চোখ পাকাবে আমাকে!’ কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। মা নিজের ফ্যামিলির লোকজনকে যতটা খাতির করে, বাবার দিকের লোকজনদের তার কণামাত্র পাত্তা দেয় না। সেই কবে বিশ বছর আগে নতুন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে মা ক’টা বছর কত অপমান সহ্য করে থেকেছে, তার বিস্বাদ আজও লেগে রয়েছে মা’র মুখে, বা বলা চলে মা লাগিয়ে রেখেছে। বাবা মাকে নিয়ে আলাদা হয়ে চলে এসে আলাদা সংসার পেতেছে। তার পর গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে চলে গেল। দাদু, ঠাকুমা মরে ভূত হয়ে গেল। তবু মা-র মুখ শ্বশুরবাড়ির নামে তিতকুটে!
সে যা-ই হোক, আজ সবার এ বাড়িতে জমায়েত হওয়ার উপলক্ষটার মধ্যে বেশ একটা নতুনত্ব আছে!
ব্রিটেনের রাজকুমারের সঙ্গে তার আট বছরের পুরনো বান্ধবীর বিয়ে, তাই সরাসরি সম্প্রচার করবে একটা বিদেশি চ্যানেল। যখন প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে রাজকুমারী ডায়ানার বিয়ে হয়েছিল, তখন মা’দের কারও বিয়ে হয়নি এবং মা’দের বাড়িতে তখন টেলিভিশন নামক বস্তুটা ছিলই না, ফলে সেই বিয়ে মা-রা কেউ দেখতে পায়নি। বলা ভাল, রাজা রানিদের বিয়ে কেমন হয়, তা এমন হাতে গরম দেখার সৌভাগ্য কখনও মা বা মায়ের বোনেদের হয়নি। সদ্য সদ্য বাবা একটা বত্রিশ ইঞ্চির এল সি ডি টিভি কিনেছে, নতুন ফ্ল্যাটের লিভিং রুমে চমৎকার মানিয়েছে টিভিটা। নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে সবাইকে নেমন্তন্ন করে মা নিজে উদ্যোগী হয়ে শুধু ফ্ল্যাট নয়, ফ্ল্যাট সাজানোর প্রতিটা খুঁটিনাটি জিনিসই ডেকে দেখিয়েছে অতিথি, অভ্যাগতদের। টিভিটা, ডাবল ডোর ফ্রিজ, বটল গ্রিন কার্পেট এ সবই তার মধ্যে অন্যতম। যত লোকজন জিজ্ঞেস করেছে ‘এটা কোথা থেকে কিনেছিস রে? ওটা কোথা থেকে?’ তত মা আনন্দিত হয়েছে। পুজোর প্রসাদ বিতরণ করতে করতে ঘেমে নেয়ে চাপা গর্বে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলেছে জিনিসপত্র সংগ্রহের ইতিহাস। যেমন কেউ হয়তো বলল, ‘তোর খাটটা খুব সুন্দর হয়েছে রানি!’ অমনি মা বলে উঠবে, ‘আর বোলো না সোহাগদি, পালিশ করাতে কালঘাম ছুটে গেছে। এক বার পালিশ করানো হল, সে আমার পছন্দ হল না, আবার তুলে, নতুন করে..., ঠিক এই গোল্ডেন ব্রাউন কালারটা না আসা অবধি..., আমার তো জানো কী খুঁতখুঁতে স্বভাব।’ এই ভাবে মা পালিশটার বিশেষত্বের প্রতি নজর আকর্ষণ করবে আমন্ত্রিতের।
রূপাই, তিন্নি যদি আপত্তি জানায় বলে, ‘উফ্ মা, যে আসছে তাকে বেডরুমের টয়লেটটাও নিয়ে গিয়ে দেখাতে হবে? তুমি না বেশি বাড়াবাড়ি করো!’ মা বলবে, ‘বেশ করি করি! কেন করব না? কেউ ভেবেছিল এক দিন রানি দত্তগুপ্ত পঞ্চাশ লাখ টাকার ফ্ল্যাট কিনবে? বাথরুমের টয়লেটে ওনেক্স লাগাবে? দশ লাখ টাকার গাড়ি চড়বে? সবাই তো বারণ করেছিল তোর বাবাকে বিয়ে করতে। ছোটবউদি তো কী নাকই না কুঁচকে ছিল, ‘ভাড়া বাড়িতে থাকে, এতগুলো ভাইবোন! কী না কী একটা ব্যবসা। বিয়ে করে রানি তো একটা আলাদা ঘরই পাবে না বরের পাশে শোওয়ার!’ আর আমার শাশুড়ি কী বলেছিল? তোদের ঠাকুমা? ‘গড়ন পেটন ভাল না, এই মেয়ে বিয়ে করলে শ্যামলের আয়পয় কোনও দিন ভাল হবে না!’ বলেছিল তো? তা কী হল? বিয়ের পর থেকেই তোর বাবার উন্নতি শুরু হল। কোথা থেকে কোথায় এল মানুষটা, সে তো আমারই ভাগ্যে? স্ত্রী ভাগ্যে ধন! বলেই ছিল নরেনকাকা তোর বাবার হাত দেখে। সে তোর বাবাও বিশ্বাস করেছিল কি না, কে জানে? বোধ হয় ভেবেছিল আমার দিকের লোক, তাই আমার হয়ে কথা বলছে!
এখন মাসিদের মধ্যে মায়ের অবস্থাই সবচেয়ে ভাল। মায়ের বাড়িতেই হাত-পা ছড়িয়ে বসার ব্যবস্থা সবচেয়ে উত্তম। টিভিটাও অন্যদের তুলনায় ঢের বড়, তাই প্রিন্স উইলিয়াম আর কেট মিডলটনের বিরাট মাত্রায় প্রচারিত বিবাহ চাক্ষুষ করতে রূপাইদের বাড়িতেই একটা সমারোহ পড়ে গেল যেন। মায়ের মাসি মানে ছোড়দিদা তো ছিলই এখানে, এগারোটা বাজতে বাজতে এসে পড়ল বড় মাসি, ছোট মাসি, রিয়া, মেজ মাসি আর নতুন বউদি। বড় মাসির এক ছেলে, এক মেয়ে। দু’জনেই বিদেশে। তাই বড় মাসি এল একাই। বেলা আড়াইটে থেকে চ্যানেলটা রাজকুমারের বিয়ে লাইভ দেখাতে শুরু করবে। দিদা বলল, ‘তা হলে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলে হয় না? দুপুরের ভাতঘুমটা না হলে আমার রানির ভাত হজম হবে না! জানিস তো?’
মা বলল, ‘না, না, ছোট মাসি, আমরা খেতে খেতে টিভি দেখব। তুমি বরং খেয়ে নিয়ে তোমার ঘরে গিয়ে গড়িয়ে নাও।’
দিদা বলল, ‘তোরা যদি আমাকে না ডাকিস?’
‘ও মা ডাকব না কেন? এই সব তো আর রোজ রোজ দেখায় না। ঠিক ডেকে দেব তোমাকে, নিশ্চিন্তে থাকো।’
দিদার মনে সন্দেহ, ‘না বাবা, আমিও তোদের সঙ্গে খেতে খেতে টিভি দেখব!’
বয়েস সত্তরের কাছে হলে কী হবে, দিদার মনে আশা আকাঙ্ক্ষা এখনও যথেষ্ট রয়েছে। এই সে দিন মাকে বলছিল, ‘রানি, তোর বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ এক জন ভদ্রমহিলাকে দেখি মর্নিং ওয়াক করতে; আমারই মতো বয়স হবে। দিব্যি তো সালোয়ার কামিজ পরে গটগট করে হেঁটে যায়। আমারও ইচ্ছে করে বুঝলি ও-রকম সালোয়ার কামিজ পরতে, মর্নিং ওয়াক করতে!’
‘তুমি সালোয়ার কামিজ পরবে মাসি? জীবনে পরেছ?’
‘পরিনি তো কী? এখন পরলেই হয়!’
মা-র সঙ্গে সঙ্গে ফোন বড় মাসিকে, ‘ছোট মাসির অবস্থা বোঝ! মনে কত যে বাসনা! সালোয়ার কামিজ পরবে, লং ড্রাইভে যাবে! সে দিন অত চিজ দেওয়া স্যান্ডউইচ খেল। আমি বলতে গেলাম— তোমার বয়েস হয়েছে, এ সব চিজটিজ খাওয়া অভ্যেস নেই, এত খেয়ো না, শেষে পেটটেট ছেড়ে দেবে! তো তাতে কী রাগ!’ ‘কী এমন বয়েস হয়েছে আমার? মুখে ক’টা বলিরেখা পড়েছে, শুনি?’
কথাটা সত্যি। বয়েস হয়ে গিয়েছে এ কথা শুনতে ছোড়দিদা একদম নারাজ। রাতের বেলা শুতে যাওয়ার আগে মা-র ঘরে ঢুকে মা-র নাইট ক্রিম মাখে নিয়মিত।
বর্ধমানে কোথায় বিয়ে হয়েছিল ছোড়দিদার, অল্প বয়সে বিধবা। শ্বশুরবাড়ি ভীষণ রক্ষণশীল। প্রায় গোটা জীবনটাই সাধ-আহ্লাদের ঘরে তালাচাবি দিয়ে কেটে গিয়েছে দিদার। মা-ই বলে এ সব কথা। বলে, জীবনে তো কিছুই পায়নি ছোট মাসি। কিন্তু তাই বলে যে ছোড়দিদার দুঃখ দুঃখ মুখ তা মোটেও নয়। সারাক্ষণ কথা বলে যাচ্ছে, বকবক করে যাচ্ছে। কী পেয়েছে না পেয়েছে তাই নিয়ে বড় একটা হাপিত্যেস নেই। সকালে উঠেই বলে, ‘ওরে টিভিটা একটু ছেড়ে দে! কী হচ্ছে দেখি।’ এ দিকে চোখে ভাল দেখে না। টিভি দেখতে বসেই, ‘ও রূপাই, এটা কে রে? কবি সুমন? কবি নাকি?’
না, না, দিদা, উনি কবীর সুমন।
অ!
কবীর সুমন বৃত্তান্ত কিছুটা জানাতে হল। দিদা এ বার জন্তুজানোয়ারের চ্যানেল দেখবে। রিমোট ঘুরিয়ে আনা হল সেই চ্যানেল, ‘ও মা রূপাই, এ কেমন সাপ রে? লোমওলা সাপ?’
লোমওলা সাপ?
মা-ও এল দেখতে, তিন্নিও এল দেখতে, ততক্ষণে দৃশ্য পাল্টে গিয়েছে, ‘কোথায় তুমি দেখলে লোমওলা সাপ?’
দেখাল তো।
ধ্যাৎ, হতেই পারে না।
বলছি দেখিয়েছে।
সারা দিন ধরে দিদা বলে গেল লোমওলা সাপ দেখিয়েছে।
মা বলল, ‘আচ্ছা বাবা দেখিয়েছে। তুমি দেখে খুশি তো?’
‘এর মধ্যে আমার খুশি হওয়ার কী আছে রানি? দেখিয়েছে তাই বললাম।’ দিদা নাছোড়।
এ বার জয়ললিতাকে সনিয়া গাঁধীর পাশে দেখে ওই কি ইন্দিরা গাঁধীর নাতনি?
রূপাইয়ের মাথায় হাত, ‘ও দিদা, তুমি যা দেখছ দেখো না! এত কথা বলো কেন?’
দিদা কথা বলবেই, আর ওড স্টেটমেন্ট দিতেই থাকবে, উইয়ার্ড কমেন্ট পাস করে করে স্তম্ভিত করতেই থাকবে উপস্থিত জনগণকে। সেই যে গৃহপ্রবেশের সময় এসেছে যাওয়ার আর নাম নেই! মা-র মেজাজ খারাপ থাকলে মা পর্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ে দিদাকে নিয়ে। মেজাজ ভাল থাকলে বলে, ‘আহা, কী জীবন তুই বল? বর্ধমানের বাড়িতে তো ছোট মাসির একটা টিভি পর্যন্ত নেই, ছোট মাসিকে যখন রেখে আসতে যাব, একটা টিভি কিনে দিয়ে আসব!’
রিয়া স্নান করে আসেনি, রূপাই আর তিন্নির টয়লেটে একটা সাদা ধবধবে বাথটব বসানো হয়েছে। রিয়া সেই টয়লেটে স্নান করবে। রূপাই নিয়ে গেল রিয়াকে স্নান করাতে। তিন্নি ইদানীং একটু ব্যস্ত, সদ্য সদ্য প্রেমে পড়েছে। আজ বিকেলে বেরোবে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ছেলেটা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছু নয়, জাস্ট প্লেন গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু ছেলেটার বাবার একটা মোটামুটি বড় ব্যবসা আছে। ছেলেটা সেই ব্যবসায়েই জয়েন করবে। যে মা নিজের বিয়েটা যথেষ্ট রিস্ক নিয়ে করেছিল, সেই মা এখন তিন্নির সঙ্গে মৃদুলের প্রেমটাকে সহ্য করতে পারছে না। বারবার বলছে, ‘আমাদের সময়টা অন্য রকম ছিল। আমরা নিজেরাও পয়সা চোখে দেখিনি। বিলাসিতা, আরাম এ সব কী আমরা জানতাম না। এতগুলো বোন ছিলাম, আমরা জানতামই যে, বাবা আমাদের বিরাট ঘর-বর দিতে পারবে না। তাদের দাবিদাওয়া মেটাতে পারবে না, তোর বাবা যদি জীবনে উন্নতি নাও করত আমার বিরাট কিছু এসে যেত না। কিন্তু তোরা এত অ্যাম্বিশাস, এত আয়েশে বড় হয়েছিস, না চাইতেই এত পেয়ে গেছিস, তোদের পক্ষে সম্ভব জয়েন্ট ফ্যামিলি, যৌথ ব্যবসার আয়, অন্যের হাত তোলা হয়ে থাকা এ সব মানিয়ে নেওয়া? প্রেম করছ করো, বিয়েটা বাবা আমার পছন্দে কোরো!’
তিন্নি কী ভাবছে তিন্নিই জানে, প্রেমটা ও চালিয়ে যাচ্ছে। রিয়াকে স্নান করিয়ে রূপাই দেখল, তিন্নি বেরোবার জন্য রেডি হচ্ছে। রূপাই বলল, ‘কী রে, এখন বেরোচ্ছিস?’
দরকার আছে।
মৃদুলের সঙ্গে তো বিকেলে দেখা করবি বলেছিলি।
নাহ, এখনই দরকার দেখা করাটা।
বাড়িতে সবাই এসেছে, মা এখন বেরোলে চেঁচাবে।
চলে আসব বিকেল হওয়ার আগেই।
তুই তো খেলিও না, তিন্নি।
এসে খাব।
মা বিস্তর আপত্তি জানাল, শেষে বলল, ‘প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়েটা দেখবিও না? এত লাফাচ্ছিলি যে দেখবি বলে?’
তিন্নি মুখ বেঁকাল, ‘নাহ্, অত ‘ফেয়ারি টেল’ ম্যারেজ আমার দেখার দরকার নেই!’
বেরিয়ে গেল তিন্নি, দুটো-টুটো নাগাদ টেবিল সাজিয়ে খেতে দিল মা সবাইকে। বিয়ে শুরু হতে এখনও একটু দেরি আছে, টিভিতে বিশেষজ্ঞরা দলবল নিয়ে বিয়ে নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কে রানি এলিজাবেথের মাথায় টুপি তৈরি করেছে, কে বিয়ের কেক বানিয়েছে, কে ডায়ানার বিয়ের পোশাক তৈরি করেছিল সব সবিস্তারে বর্ণিত হচ্ছে। সমস্ত ব্রিটেনের মানুষ ভেঙে পড়েছে লন্ডনের রাস্তায়। ক্লিয়ারেন্স হাউস থেকে লন্ডনের যে যে রাস্তা দিয়ে রাজ পরিবারের রোলস রয়েসগুলো যাবে ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবে অবধি, সেখানেই কাতারে কাতারে মানুষ দাঁড়িয়ে, উচ্ছ্বসিত জনতা, সবার রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা কমোনার কেট মিডলটন কখন বিয়ের পোশাক পরে বেরিয়ে আম মানুষকে দেখা দেবে।
শুক্তোটা রেঁধেছে বড় মাসি, নতুন বউদি এমন একটা ভাব করছে যেন, জীবনে শুক্তো চোখেই দেখেনি। একেবারে সদ্য সদ্য স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কানট্রি থেকে ল্যান্ড করেছে এ দেশের মাটিতে। বড় মাসি ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে আছে। আর মেজ মাসির শুক্তো জিনিসটা কী, বোঝাবার চেষ্টা করছে নতুন বউদি সুনয়নাকে। মা বলল, ‘এই মেজদি, সুনয়নার বাড়িতে কোনও দিন শুক্তো হয়নি? শুক্তো কী জানে না, বাঙালি মেয়ে!’
মেজ মাসি বলল, ‘না-ই জানতে পারে, ওর মা তো চাকরি করত, কখনও শুক্তো-টুক্তো রাঁধার সময় পেয়েছে নাকি? আর ও তো কার্শিয়াং-এর হস্টেলে মানুষ, ক্রিশ্চান স্কুল, এ সব খায়নি। সে-দিন লাউ ছেঁচকি খেয়েও তো সুনয়না বলল, আগে খায়নি।’ মেজ মাসির খুব গর্ব ছেলের বউ নিয়ে। ‘ব্যাঙ্কে চাকরি করে’ বলবে না, বলবে, ‘সুনয়না হল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার!’ সুনয়না মেয়েটা কেমন তা এখনও ভেবে দেখেনি রূপাই। তবে বাপ্পাদার সঙ্গে প্রেমের বিয়ে নয়। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। কিন্তু মেজ মাসির পছন্দ করা বউভাতের শাড়ি তিন বার বদলিয়েছিল। মোটামুটি ভাবে সুনয়নাকে রূপাই সেই মেয়েদের দলে ফেলে দিয়েছে, যারা বাঙালিদের কতকগুলো স্বাভাবিক আচার, আচরণ দেখে আকাশ থেকে পড়ে, অথচ অবাঙালিদের অনেক নিয়মকানুন জানে। সুনয়না বিয়েতে মেহেন্দি পরেছে, দিল্লি থেকে আনিয়ে ইউ পি-র মেয়েদের মতো লাল-সাদা গোছা গোছা চুড়ি পরেছে, এ রকম আরও অনেক কিছু করেছে, যাতে ধারণা হয় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন কালচার সম্পর্কে ও উৎসাহী, উৎসাহ নেই শুধু বাঙালিদের বাঙালিত্ব বিষয়ে। বিয়ের দিন সুনয়না একটা হেভি ওয়ার্কের জারদৌসি পরেছিল। কিনা, বেনারসি পরে তো পার্টিতে যাওয়া যায় না, তাই। বেনারসি বিয়েতে কেনা মানে টাকাটা জলে দেওয়া। মা বলেছিল, ‘এত টাকা মাইনের চাকরি করে, কিন্তু কিপটের মরণ! আর না হয় দ্বিতীয় বার না-ই পরলি। তাই বলে বিয়েতে বেনারসি কিনবি না? শাড়ি কিনতে গিয়েও ইনভেস্টমেন্টের কথা ভাবে?’ শুক্তো নিয়েই কথা ঘুরতে লাগল খাওয়ার টেবিলে। কার বিয়েতে, কোন অনুষ্ঠানে, কবে কার সাধে, কার পৈতেতে, এমনকী কোন শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গে কে কেমন শুক্তো খেয়ে স্বাদের মাহাত্ম্যে সব ভাত শুক্তো দিয়েই খেয়ে ফেলে, আর সব ভালমন্দ ভক্ষণের জন্য পেটে জায়গা অবশিষ্ট রাখতে পারেনি, এ সব গল্প চলতে লাগল। সুনয়না দিব্যি শুক্তোর ডাঁটা চিবিয়ে ফেলল দেখে, বড়ি দিয়ে ভাত মেখে ফেলল দেখে চোখ টিপল মা বড় মাসিকে। ছোড়দিদা বলল, ‘রানি, এত চোখ টেপাটিপির কী আছে রে?’
মা, বড় মাসি, চমকে গেল দু’জনেই, ‘কী বলছ কী, তুমি? বিয়েটা দেখো না মন দিয়ে!’
‘শোন, বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে মেয়েদের ও-রকম শিখিয়েই পাঠায়, ডাল, চচ্চড়ি খেতে ভালবাসি, খাই বললে শ্বশুরবাড়িতে ডাল, চচ্চড়িই জুটবে। শ্বশুরবাড়ি যে কেমন জায়গা তা সবাই জানে। ওই জন্য বলতে হয় আমার মুখে মাছ, মাংস ছাড়া রোচে না! আমিষ পদ না হলে আমি ভাত খেতে পারি না! বুঝলি? কেন, তোদের দিদিমা আমাকে শিখিয়ে দেয়নি, খবরদার বলবিনে যে, পান্তা খাই! তা হলে সব বাসি ভাত পান্তা করে আদর করে তোকে খেতে দিয়ে বলবে, ‘আহা, ওকে দাও, ওকে দাও, মেয়েটা পান্তা খেতে ভালবাসে!’
মেজ মাসির মুখ লাল হয়ে গেল, সুনয়না ব্যাপারটা বুঝেছে কি না, কে জানে! হাঁ করে শুনছে। রূপাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ওই দ্যাখো, ওই দ্যাখো, কেট মিডলটন বেরিয়ে গাড়িতে উঠছে!’
সবাই তাকাল টিভির পর্দায়! লন্ডনের রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। হাতে হাতে উড়ছে ব্রিটেনের ফ্ল্যাগ। জয়ধ্বনিতে ভরে উঠছে আকাশ বাতাস! টিভিতে লাইভ কমেন্ট্রি চলছে এ বার কেট মিডলটনের বিয়ের পোশাক নিয়ে। নানা মুনি নানা মত দিচ্ছেন। প্রত্যেকেই বলছে দারুণ পোশাক নির্বাচন করেছেন কেট! গ্রেস কেলির বিয়ের পোশাকটির সঙ্গে কেটের পোশাকের সাদৃশ্য রয়েছে। গাড়িতে চড়ে ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবের দিকে যাচ্ছেন কেট, ব্রিটেনের হবু রাজকুমারী। একটু পরে গাড়ি থেকে নামলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে পোশাকটির বৈশিষ্ট্য!
রূপাইয়ের মা রানি ভীষণ আধুনিকা হওয়ার চেষ্টা করে, বিশেষত আজ সুনয়নার সামনে মা আরও স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করছে। কেট গাড়ি থেকে নামতেই সুনয়না বলে উঠল, ‘কী দুর্দান্ত পোশাক! কী সুন্দর ফিগার কেটের! ঠিক যেন বার্বি ডল!’ মা-ও তাই বলতে লাগল। ‘দারুণ ড্রেসটা! দারুণ!’ দিদা বলল, ‘কী বলছে রে ইংরিজিতে, আমাকে একটু বল না।’
বলছে, ‘হবু রাজকুমারীর বিয়ের সাজ দুর্দান্ত হয়েছে। সারা পৃথিবীর ফ্যাশন জগতের লোকজন সেটাই বলছে, মত দিচ্ছে!’
সুনয়না বলল, ‘আলেকজান্ডার ম্যাকুইন! বিরাট নামী ফ্যাশন হাউস জানো তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি জানি।’ মা হেরে যাবে কেন সুনয়নার কাছে!
দিদা চোখ কুঁচকে দেখতে লাগল টিভি। দেখতে দেখতে ঠোঁট উল্টে গেল। রূপাই বলল, ‘কী দিদা, তোমার কেমন লাগছে বিয়ের কনেকে?’ দিদা একটা মুখাভিনয় করল, রূপাই বলল, তার মানে?
ধুর, এই কি রানির বিয়ের পোশাক?
মা বলল, তুমি কিছু বোঝো না, তাই।
‘একে তো সাধারণ একটা মেয়ের মতো দেখছি। সত্যিকারের রানি যদি এমন ন্যাড়া ন্যাড়া সেজে আসে, তা হলে সাধারণ মেয়েরা তো আর রানি সাজার স্বপ্নও দেখতে যাবে না!’
‘ও তো সাধারণ হতেই চায়।’
‘আহা, হয় রানি হও, নয় সাধারণ হও, দুটোই একসঙ্গে কী করে হবে? ফুরফুরে পোশাক নেই, গায়ে গয়না নেই! এ কেমন রানির সাজ?’
মা বলল, ‘সারা পৃথিবীর লোক তো ধন্য ধন্য করছে। এমনি?’
দিদা শুক্তোর ডাঁটা চুষতে চুষতে বলল, ‘ছোটবেলায় সেই গল্পটা পড়িসনি?’
‘কোনটা আবার? বাবাঃ ছোট মাসি না! কোনটা শুনি?’
‘সেই যে একটা ছোট্ট ছেলেই শুধু বলে উঠেছিল, রাজা কেন উলঙ্গ?’
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
Probondho Rabibasariyo Magazine



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.