|
|
|
|
|
|
|
সম্রাটের প্রতিদ্বন্দ্বী |
দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষচন্দ্রকে বইতে হয়েছে একটা
গোটা জাতির আশার ভার।
ইতিহাসবিদ সুগত বসুর ‘হিজ ম্যাজেস্টিস অপোনেন্ট’ পড়ে লেখকের সঙ্গে কথা বললেন গৌতম চক্রবর্তী
|
উই আর অন দ্য ইয়েলো সাবমেরিন |
এপ্রিল ২৬, ১৯৪৩। দুনিয়া জুড়ে মহাযুদ্ধের দামামা। তারই মধ্যে ভারত মহাসাগরে এগিয়ে চলেছে জাপানি সাবমেরিন ‘আই ২৯’। গোপন অভিযানে চলেছে সে।
২৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ ও ৬০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় ‘আই ২৯’ খুঁজে পেল তাকে। জার্মান সাবমেরিন ‘ইউ ১৮০’। উত্তাল মহাসাগর, জলের ওপর পাশাপাশি ভেসে চলেছে দুই ডুবোজাহাজ। লগ বুক দেখাচ্ছে, মাদাগাস্কারের তটরেখা এখন সবচেয়ে কাছে। প্রায় চারশো নটিকাল মাইল!
শত্রু জাহাজের নজরদারিতে এখন পড়লেই মুশকিল। সেই ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মান বন্দর কিয়েল থেকে ছেড়েছিল ‘ইউ ১৮০’। তার পর কয়েক মাস ধরে উত্তর মহাসাগরের স্রোতে ভাসা। নরওয়ে, আইসল্যান্ডের তটরেখা পেরিয়ে, উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে অবশেষে ভারত মহাসাগরে। মাঝে এক ব্রিটিশ জাহাজ এই সাবমেরিনকে দেখতে পেয়ে ‘ডেপ্থ’ চার্জ করে। কোনও ক্রমে ফের জলের নীচে গিয়ে রক্ষা পায় ‘ইউ ১৮০’।
কতক্ষণ যে পাশাপাশি দুই ডুবোজাহাজ ভাসছে! ২৭ তারিখ সন্ধ্যাবেলায় জার্মান সাবমেরিনের দুই অফিসার সাঁতরে গিয়ে ‘আই ২৯’-এ উঠলেন। তার পর? জাপানি সাবমেরিন থেকে সাঁতরেই ফিরে এলেন তাঁরা। পিছনে রাবারের এক নৌকো। মোটা দড়ি দিয়ে সেটি জাপানি সাবমেরিনের সঙ্গে বাঁধা। পর দিন ভোরের আলো ফোটার আগে সুযোগ নিতে হবে।
২৮ এপ্রিল তখনও ভোর হয়নি। জার্মান সাবমেরিন থেকে নেমে রাবারের ডিঙিতে উঠে বসলেন দুই ভারতীয় তরুণ। উত্তাল ঢেউ, ভিজে যাচ্ছে পোশাক। উথালপাথাল করতে করতেই দড়িতে বাঁধা ডিঙি পৌঁছে গেল জাপানি সাবমেরিনের কাছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসে ডুবোজাহাজ থেকে ডুবোজাহাজে যাত্রী পারাপারের একমাত্র ঘটনা। এমনটা আর ঘটেনি!
|
কিল বোস |
সাবমেরিনের এই ঘটনারও দুই বছর আগে। ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১! লন্ডনে ব্রিটিশ গোয়েন্দার মুখ উজ্জ্বল, “২৩ তারিখ আমরা ইতালির একটা মেসেজ ‘ডিকোড’ করতে পেরেছি। সাঙ্ঘাতিক খবর!”
কী খবর?’ গোয়েন্দাপ্রধান মুখ তুলে তাকালেন।
“মনে হয়, বোসের খবর। কাবুলের ইতালীয় দূতাবাস মেসেজ পাঠাচ্ছিল, বোস বোধ হয় জার্মানি যাবে।
বোস মানে সুভাষচন্দ্র বসু। গত জানুয়ারি মাসে কলকাতার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছেন, তার পর তাঁর আর খবর নেই। এ বারই ব্রিটিশ সরকারের হাতে প্রথম নিখুঁত খবর।
গোয়েন্দাপ্রধান মুখ তুলে তাকালেন, “কাবুল থেকে ইউরোপ যেতে হলে তো ইস্তানবুল বা কায়রো হয়ে যেতে হবে?”
“হ্যাঁ, স্যর। ও জার্মানি ঢুকে গেলে কিন্তু বিপদ। ভারতের অনেক খবর পাচার করতে পারে।”
পরের সপ্তাহে ব্রিটেনের ‘স্পেশাল অপারেশনস এগজিকিউটিভ’ তাদের ইস্তানবুলের এজেন্টকে নির্দেশ পাঠাল, “বোস আফগানিস্থান থেকে জার্মানি যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ওকে কী ভাবে খতম করতে পারো, জানাও।”
ইতিহাস জানে, সুভাষচন্দ্র বসু সে যাত্রায় ইস্তানবুল যাননি। অরলান্দো মাজেত্তা নামে এক ইতালীয় কূটনীতিকের নকল পাসপোর্ট নিয়ে কাবুল থেকে হিন্দুকুশ পেরিয়ে গাড়িতে চলে গিয়েছেলেন সমরখন্দ। সেখান থেকে ট্রেনে মস্কো। তার পর মস্কো থেকে বার্লিনে উড়ান!
ব্রিটেনের আর্কাইভে এখনও রাখা আছে সেই গোপন নির্দেশ।
|
কলকাতা, ২০১১ |
ওপরের দুটি দৃশ্যই ইতিহাসবিদ সুগত বসুর সদ্য-প্রকাশিত ‘হিজ ম্যাজেস্টিস অপোনেন্ট’ বই থেকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে দিন কয়েক আগে ধরা গেল কলকাতায়। “সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে ধারণা, তিনি শুধু যোদ্ধা দেশনায়ক। কিন্তু সেটাই সব নয়। কেমন মানুষ ছিলেন? সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে কেমন টানাপোড়েন ছিল তাঁর? এইগুলিই দেখতে চেয়েছিলাম,” বলছেন তিনি।
আর মানুষ সুভাষচন্দ্রকে ঘিরেই তাই প্রাথমিক প্রশ্ন।
প্রশ্ন: ভারতীয় জনজীবনে দু’জন আলাদা সুভাষচন্দ্র! এক জন রক্তমাংসের, ইতিহাসের চরিত্র। হিউ টয়, লেন গর্ডন বা আপনি যাঁর কথা লেখেন! আর এক জন সুভাষচন্দ্র ভক্তের ভগবান। তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মরতে পারেন না, বিয়ে করতে পারেন না। জনজীবনে এই যে দুই সুভাষ... ঐতিহাসিক হিসাবে কী ভাবে দেখছেন?
সুগত: সোশাল অ্যানথ্রপলজিতে চমৎকার কাজ হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক হিসাবে মনে হয়, ওই যে শুধুই যোদ্ধা দেশনায়কের ইমেজে গুরুত্ব দেওয়া সেখান থেকেই ভ্রান্তি। যোদ্ধা দেশনায়ক মানে প্রায় অর্জুন। তিনি শুধু নিষ্কাম কর্ম করে যাবেন, গাণ্ডীব ধনু তুলবেন। আর একটা বিষয়! দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা এ সবের প্রেক্ষিতে যোদ্ধা নায়কই যেন হয়ে দাঁড়ালেন শেষ ভরসা। জনতা ভাবল, তিনি ফের আলো দেখাবেন।
প্রশ্ন: ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ সিনেমাটা দেখেছিলেন? ওই ছবির পর ‘গাঁধীগিরি’ বলে একটা শব্দ চালু হয়ে যায়। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের ক্ষেত্রে আজও সে রকম ঘটে না! কেন?
সুগত: ওই যে! সুভাষচন্দ্রের ইমেজটা যোদ্ধা দেশনায়ক হিসেবেই আটকে থাকল। বিপক্ষের লোকেরা জার্মানিতে যাওয়া, হিটলারের সঙ্গে তাঁর হাত মেলানো নিয়ে কুৎসা করেছে, ঠিকই! কিন্তু অতিভক্তরাই বেশি ক্ষতি করেছেন।
প্রশ্ন: গাঁধীগিরির উত্থানের আরও কারণ আছে। গাঁধীজি নিজে ‘গাঁধীবাদ’ কথাটায় পাত্তা দিতেন না। উল্টে রসিকতা করে বলেছিলেন, “আমার নামে কোনও বাদ-টাদ চললে মরার পরেও আমার আত্মা কুঁকড়ে উঠবে!”
সুগত: আমিও মানুষ সুভাষের সেই জায়গাগুলি ধরতে চেয়েছি। উনি শুধুই যোদ্ধা দেশনায়ক নন। কী রকম রসিকতা করতেন, ব্যক্তিজীবনে কী রকম ছিলেন, তার অনেক ঘটনা...
|
সুগতর বই থেকে: অজানা সুভাষ |
রসিকতা ১: ১৯৪২। জার্মানির অধীনে থাকা ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিচ্ছেন সুভাষ: আপনারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরুন! তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এম আর ব্যাস জানালেন, “নেতাজি, এই সৈন্য জোগাড়ের কাজটায় আমাকে নিন।”
হো হো করে হেসে উঠলেন সুভাষ, “খেপেছেন! এমনিতেই এর পর গাঁধীজিকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু আপনার মতো গুজরাতি ভদ্রলোককে অহিংসার পথ থেকে সরিয়ে আনলে ওঁকে কী বোঝাব বলুন তো?’’
|
বিফ এবং রেড ওয়াইন |
ভারত ছাড়ার পর জার্মানির পথে মস্কোতে প্রথম ভদকা খেয়েছিলেন সুভাষ। সেটিই তাঁর জীবনে প্রথম মদ্যপান। পরে স্ত্রী এমিলিকে জানিয়েছিলেন, ‘রীতিমত গলা জ্বলছিল।’ কিন্তু ইউরোপে থাকতে থাকতেই অনেক দেশজ সংস্কার থেকে মুক্তি ঘটে তাঁর। গোমাংস ভক্ষণে আপত্তি ছিল না। রেড ওয়াইনও চমৎকার লাগত।
|
মেয়ের বাবা |
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এমিলি তখন ভিয়েনায় পিতৃগৃহে। সুভাষ বার্লিনে। ২৯ অক্টোবর খবর পেলেন কন্যার জন্মের। প্রথমে কিঞ্চিৎ মুষড়ে পড়েছিলেন। ভারতে যিনি মহিলাদের অধিকার নিয়ে সরব ছিলেন, পরবর্তী কালে আজাদ হিন্দ ফৌজে মেয়েদের নিয়ে সেনাদল গড়ে তুলবেন, সেই সুভাষও! পরে অবশ্য সদ্যোজাত কন্যাকে দেখে তিনি খুশিতে উচ্ছল।
গাঁধীর পৌত্র, ঐতিহাসিক রাজমোহন গাঁধী কয়েক বছর আগে একটি গাঁধী-জীবনী লিখেছিলেন। পারিবারিক আর্কাইভের নথি ঘেঁটে সেখানে তিনি গাঁধীর সঙ্গে সরলা দেবীর প্রেম নিয়ে নানা কথা জানিয়েছিলেন। দেবত্বের ধাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন মোহনদাস। সুগত বসুও তাঁর নতুন বইয়ে আজ মানুষ সুভাষচন্দ্রকে মুক্তি দিলেন।
|
নেতাজি ভবন, ২০১১ |
এলগিন রোডের বাড়ির বারান্দায় এখন দুপুরের আলো। সন্ধ্যাবেলাতেই সুগতকে যেতে হবে প্রেসিডেন্সি কলেজের মেন্টর গ্রুপের আলোচনায়।
প্রশ্ন: ওটেন সাহেবের কথায় আসি। পরবর্তী কালেও এ নিয়ে সুভাষ সরাসরি উত্তর দিতেন না। মিটিমিটি হাসতেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যে জঙ্গি ছাত্র আন্দোলন, ওটেন সাহেবের ঘটনা কি তারই বীজ?
সুগত: এটাও যোদ্ধা দেশনায়কের ইমেজ। ভারতীয় শিক্ষকেরা যোগ্যতা সত্ত্বেও ইংরেজ শিক্ষকদের সমান সুযোগসুবিধা পান না, এ নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদের মনে তখন তুমুল অসন্তোষ। ওই ঘটনা তারই প্রভাব। তবে আজকের ছাত্রদের বলব, ওই ইমেজে বাঁধা না পড়ে পরে ১৯২৮ বা ’২৯ সালের সুভাষচন্দ্রকে দেখতে। তখন ছাত্রসম্মেলনে তিনি স্বাধীনতা, জাস্টিস আর সাম্যের কথা বলছেন। জাতপাতের বিরোধিতা করতে বলছেন।
প্রশ্ন: কলেজে পড়ার সময়েই সুভাষ আর তাঁর বন্ধু দিলীপ রায় ট্রেনে হরিদ্বার, আগ্রা ইত্যাদি অঞ্চলে ঘুরতে গেলেন। মনে হয় না, কয়েক দশক পরে জন্মালে এরাই হয়তো ট্রেনের বদলে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত, এক জনের নাম হত চে গেভারা। আর এক জনের নাম আলবার্তো গ্রানাদো!
সুগত: চে গেভারার মতো দেশ দেখাটা সুভাষেরও কাজে দিয়েছিল। তার আগে সন্ন্যাস নেওয়ার কথা ভাবতেন। কিন্তু সে বার উত্তর ভারতে ভণ্ড সন্ন্যাসী, জাতপাত দেখে বিরক্ত। মনে রাখতে হবে, নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ অনেক পরে। হ্যারো স্কুল, ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে দেশে ফেরার পর। সুভাষের ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ কিন্তু কিশোর বয়সেই ঘটে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: কিশোর বয়সে একটি ছেলে সন্ন্যাস নিতে চায়, এবং সেই কারণে দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়ছে। এখানে কি যৌনতা অবদমনের ব্যাপার নেই?
সুগত: অবশ্যই। সুভাষচন্দ্র ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ নামে একটি আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন। সেখানে বয়ঃসন্ধিতে তাঁর ওই টানাপড়েনের কথা, ‘আমার মানসিক গড়নে তখন একটা অস্বাভাবিকত্ব ছিল’ ইত্যাদি অনেক কিছু লিখে গিয়েছেন।
|
বদ্ধ পাগল |
২৯ মে, ১৯৪২। রাইখ চ্যান্সেলরিতে ঢুকে এলেন সুভাষচন্দ্র। সে দিনই হিটলারের সঙ্গে তাঁর সরাসরি দেখা। এবং সেটিই একমাত্র আলোচনা। তার আগে বার্লিনে এসে রিবেনট্রপ ও অন্য নাতসি নেতাদের সঙ্গে সুভাষের কথা হয়েছে। জার্মানি তত দিনে চুক্তি ভেঙে সোভিয়েত রাশিয়ায় আক্রমণ শুরু করেছে।
জার্মানি এবং ইতালির হাতে থাকা ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়েই আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম প্রস্তুতি। জার্মানিতে কেন? বিক্ষুব্ধ ভারতীয় ছাত্রদের প্রশ্নে তখন সুভাষের সাফ জবাব, “লেনিনও জার্মান কাইজারের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধে সেখানেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, আগে জারতন্ত্র উৎখাত করা। তার পর অন্য কথা।”
কিন্তু হিটলার? এশীয় জাতি ইউরোপীয় শক্তিকে হঠিয়ে দেবে, তিনি মানতে পারেন না। ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে তাই তাঁর মাথাব্যথা নেই। জীবনে হিটলারের সঙ্গে একমাত্র সাক্ষাতে সুভাষ তাই বিরক্ত। পরে হিটলার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বদ্ধ পাগল!’
তবু প্রশ্ন থেকেই যায়। মহাযুদ্ধের বাজারে সুভাষ তখন বার্লিন থেকে রোম, ভিয়েনা যাতায়াত করেন। নাতসি জমানায় অসউইত্জ বন্দিশিবির বা ইহুদিনিধন নিয়ে তিনি তা হলে নীরব কেন?
|
সুগতর বই থেকে |
|
এই বন্ধুত্বের ব্যাখ্যা দেওয়া শক্ত। কিন্তু সুভাষচন্দ্র একা নন। ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে স্তালিন এবং রুজভেল্টের সাক্ষাৎ। স্তালিনের মতো গণনিধনযজ্ঞের হোতাকে দেখে রুজভেল্ট মোটেও খুশি হননি, কিন্তু সে দিনের পরিস্থিতিতে তিনি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’ ১৯৩৯ সালের ২৩ জুলাই হিটলারকে ‘প্রিয় বন্ধু’ সম্বোধন করে মহাত্মা গাঁধীও লিখেছিলেন, ‘দুনিয়াকে আপনিই এখন যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন।’
সুভাষও তাই জার্মানির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। রেডিয়োতে বলেছিলেন, “ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমরা যদি শুধু আদর্শের বিচার করি, ভুল হবে। জার্মানি, ইতালি বা জাপানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি তাদের দেশের মানুষের বিষয়। স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্রে আমরাও অন্য দেশের হস্তক্ষেপ সহ্য করব না। ভারতীয়রা কেমন সরকার গড়বে, নিজেরা বেছে নেবে।”
|
লেখকের সঙ্গে |
প্রশ্ন: স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র কেমন হবে, তা নিয়ে সুভাষের স্পষ্ট মত ছিল। বলেছিলেন, শক্তিশালী কেন্দ্র আর একনায়কত্বের কথা।
সুগত: ওটা ১৯৪৪ সালে টোকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে বলেছিলেন। মাত্র তিনটি বক্তৃতায় উনি ‘অথরিটারিয়ান স্টেট’-এর কথা বলেন। কিন্তু সেগুলির শেষেও বলেছিলেন, পরে রাজ্যের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হবে। তা ছাড়াও বিভিন্ন বক্তৃতায় বারংবার বলেছেন, গণতন্ত্র পাশ্চাত্যের কোনও প্রতিষ্ঠান নয়, তা সব দেশের, সব মানুষের জন্য।
প্রশ্ন: সুভাষচন্দ্র নিটশে, শোপেনআওয়ার পড়তেন। কিন্তু নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন? রামচন্দ্র গুহও তাঁর ‘মেকার্স অব মডার্ন ইন্ডিয়া’ বইয়ে রাজনৈতিক দর্শনের কথা বলতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র এবং ভারতীয় বামপন্থী নেতাদের বাদ দিয়েছেন। বলেছেন, এঁদের গোটা রাজনৈতিক দর্শনই বিদেশ থেকে আমদানি করা।
সুগত: ওটা ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত মত। রণজিৎ গুহ আবার সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক দর্শনের প্রশংসা করেছেন। দু’জন ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত মত আলাদা হতেই পারে।
প্রশ্ন: ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস থেকে যাঁরা বেরিয়ে যান, প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি বা চিদম্বরম, কেউ সফল হন না। কংগ্রেসেই ফিরে আসতে হয়। ব্যতিক্রম দুই জন বাঙালি। সুভাষচন্দ্র বসু ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুগত: সুভাষকে লড়তে হয়েছিল গাঁধী, জওহরলাল, পটেলদের সঙ্গে। আর মমতা যখন দল ছাড়লেন, নেতৃত্বে সীতারাম কেসরী। তফাত আছে। কিন্তু মিল কোথায় জানেন? তখন বিধান রায়, কিরণশঙ্কর রায়দের নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের অ্যাড হক কমিটি শুধু নামেই। জনসমর্থন সুভাষের পিছনে। মমতার ক্ষেত্রেও তাই!
|
ব্যাটল ফর ইম্ফল |
কদম কদম বঢ়ায়ে যা! ইম্ফলে ঢুকছে আজাদ হিন্দ। সুভাষের নির্দেশ, তেজপুরের রাস্তা খোলা রাখতে হবে। ব্রিটিশ সৈন্য সেখান থেকে পালাবে। আর জাপানিদের সহায়তায় আজাদ হিন্দ ঢুকে আসবে অসমে।
শেষ রক্ষা হয়নি। দিন কয়েক পরে ইম্ফল ফের ব্রিটিশ অধিকারে।
প্রশ্ন: সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে আপনার বাবার কাকা। নীরদচন্দ্র চৌধুরী মায়ের কাকা। নীরদবাবু ইম্ফল যুদ্ধ সম্বন্ধে সাফ বলেছিলেন, সুভাষ স্ট্র্যাটেজিক অপারেশন জানতেন না। পদাতিক বাহিনী যখন এগোবে, মাথার ওপর বিমানবাহিনী আশ্রয় দেবে। আজাদ হিন্দের সেটা ছিল না। পিছনে রসদের একটা লাইন-আপ রাখতে হবে। সেটাও ছিল না।
সুগত: জাপানিরা এয়ার-কভার দিতে পারবে না, সুভাষ জানতেন। আর স্ট্র্যাটেজিস্টরা এখন বলেন, ইম্ফলে জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল ফিফটি-ফিফটি।
প্রশ্ন: সুভাষচন্দ্র কলকাতা থেকে গোমো গিয়ে সেখানে দিল্লি-কালকা মেল ধরেছিলেন। সেই স্টেশনের নাম এখন ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস’। কিন্তু জাপানি সাহায্যে তখন আন্দামান, নিকোবরও মুক্ত হয়েছিল।
সুভাষচন্দ্র আন্দামানের নাম দিয়েছিলেন ‘শহিদ দ্বীপ’। আর নিকোবরের নাম ‘স্বরাজ দ্বীপ’। কী মনে হয়? আন্দামান, নিকোবরের নামও বদলালে ভাল হয়?
সুগত: ‘শহিদ’ শব্দটা ভাল। সেলুলার জেলে কত স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাণ দিয়েছেন! আন্দামানের নাম শহিদ দ্বীপ হলে আমি খুশিই হব।
|
নেতাজির উত্তরাধিকার |
সুভাষ কী ভাবে রয়েছেন আজ? মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, কাশ্মীরের জঙ্গিরাও একদা বলেছেন, সুভাষচন্দ্র বেঁচে থাকলে তাঁদের যুক্তি বুঝতে পারতেন। কিন্তু সুগতর সুভাষজীবনী সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি দেখান, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের কথা ভাবেনি। সুভাষচন্দ্রই প্রথম তাদের নিয়ে ঠিকঠাক ফৌজ গঠন করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ভেবেছিলেন।
কী রকম ছিল সেই ফৌজ? ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাছাউনিতে তখন বিভিন্ন ধর্মের জন্য আলাদা ক্যান্টিন। আজাদ হিন্দ ফৌজেই প্রথম হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে এক ক্যান্টিন। এবং মুসলিম মনে আঘাত লাগতে পারে ভেবে ১৯৪২ সালেই ‘বন্দে মাতরম্’-এর বদলে ‘জনগণমনঅধিনায়ক’কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক।
ভারতের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে তাইল্যান্ড, বার্মা, জাপান, মালয় বা সুমাত্রার ভারতীয় ‘ডায়াস্পোরা’কেও স্বাধীনতার কাজে ব্যবহার করেছেন সুভাষ। সেখানকার অনাবাসী ভারতীয়দের অর্থ সাহায্যেই আজাদ হিন্দ সরকারের ব্যাঙ্ক, মুদ্রা ও ডাকটিকিট। শুধু নিজেদের নিয়ে থাকেনি তারা, তাইল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়েও অর্থসাহায্য করেছে আজাদ হিন্দ সরকার। ‘লুক ইস্ট’ পলিসির যুগে এই বই সুভাষচন্দ্রকে অন্য ভাবে দেখতে শেখায়।
|
কখনই বলেননি, রক্ত দাও |
প্রশ্ন: অশোক রুদ্র একটা যুক্তি দেখিয়েছিলেন। সুভাষের ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ গোছের কথা আসলে শাক্ত বাঙালির রক্তপ্রেমের প্রতীক...
সুগত: রক্তের কথা গাঁধীজিও ১৯৪২ সালে বলেছিলেন। স্বাধীনতার মূল্য দিতে গেলে আমাদের রক্তের নদী বইয়ে দিতে হবে। উনি, কাথিয়াবাড়ের গুজরাতিও কি শাক্ত বাঙালি নাকি?
একটা ব্যাপার দেখার মতো। গাঁধী তখন ‘রিভার্স অব ব্লাড’-এর কথা বলছেন। সুভাষও বলেছেন, ‘ব্লাড ব্রাদারহুড ফর পূর্ণ স্বরাজ ইন ইন্ডিয়া।’ দু’জনেই কিন্তু ব্রিটিশের রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া নয়, দেশবাসীকে রক্তের বিনিময়ে আত্মাহুতির ডাক দিচ্ছেন। তার মধ্যে সুভাষ ডাক দেন, ‘দিল্লি ইজ কলিং। ব্লাড ইজ কলিং টু ব্লাড।’ কিন্তু ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ গোছের কথা কখনও বলেননি। ওটা বাঙালির অতিসরলীকরণ!
প্রশ্ন: নীরদবাবুর একটা মন্তব্যে আসি। উনি লিখেছিলেন, ‘সুভাষচন্দ্র এক জন শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি তাঁহার বাঙালিয়ানায় গাঁধীবাদের ভেজাল মিশাইতে দেন নাই। আপন বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করিয়াছিলেন। হিন্দুর সমগ্র ইতিহাসে এই জাতীয় দ্বিতীয় উদাহরণ নাই।’
সুগত: ওটাও ব্যক্তিগত মত। সুভাষচন্দ্র নিজেকে হিন্দু-মুসলমান প্রতিপন্ন করতে চাইতেন না। ইউরোপে কেউ ওঁকে ‘বাংলার নেতা’ বললে রেগে যেতেন। সেখানে উনি বাঙালি নন, ভারতীয়। অমর্ত্য সেন পরবর্তী কালে যে ‘বহুমুখী আইডেন্টিটি’র কথা বলবেন, একটি লোক একই সঙ্গে হয়তো বাঙালি, ভারতীয়, জার্মানির বাসিন্দা, নন-ভেজ... সেগুলি সুভাষচন্দ্রেরও বিশ্বাস। তবে একটা কথা! ওই যে ‘গাঁধীবাদের ভেজাল’ সুভাষের পক্ষে মানে কিন্তু গাঁধীর বিপক্ষে নয়। এই সত্যটি
বোঝার সময় এসেছে। |
|
|
|
|
|