সরস্বতীর উৎস সন্ধানে, মানাগ্রামে
বিকেলের পড়ন্ত রোদে, অগুনতি গাড়ির মাঝে অসংখ্য যাত্রীর ইতস্তত ব্যস্ততায়, হরিদ্বার থেকে ৩২১ কিমি পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বদ্রীনাথে এসে নীলকণ্ঠ শৃঙ্গের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে আর চোখ ফেরাতে পারি না। আস্তানা ঠিক করেই বেরিয়ে পড়ি। মসৃণ পাহাড়ি পিচ রাস্তায় চড়াই উতরাইয়ে ধনী যাত্রীর দান, ঝুড়ি পিঠে যাত্রী বহনকারী মানুষ-যান, সি ডি-ডি ভি ডি’র গান ও ‘বদ্রী বিশাল’ জয়ধ্বনির টান সামলে সন্ধ্যায় আলোকোজ্জ্বল মন্দিরে এসে পৌঁছলাম, পাশেই বয়ে চলা অলকানন্দার রূপ প্রাণবন্ত, উচ্ছল।
পর দিন ঝকঝকে রোদে, সকালের ঠিকানা বদ্রীনাথ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ভারতের শেষ সীমান্তবর্তী অঞ্চল মানাগ্রাম। চওড়া পিচ রাস্তার দু’দিকেই সবুজে ঘেরা কালচে বাদামি পাহাড়ের চূড়াগুলো সাদা মেঘে ঢাকা। এরই মাঝে কোনও দু’টি পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বহু দূরের বরফে ঢাকা সাদা শৃঙ্গগুলোর দৃশ্য অসাধারণ। বাঁ দিকে সাদা নুড়িপাথরের পাহাড়ি প্রান্তরে ধূসর নীল অলকানন্দা বয়ে চলেছে। মানাগ্রামের কাছে কেশব প্রয়াগে গাড়ি থেকে নামলাম। এখানেই সরস্বতী আর অলকানন্দার সঙ্গমস্থল। এর পর সরস্বতীর আলাদা অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ইলাহাবাদে আবার ত্রিবেণী সঙ্গমে সরস্বতীর পরিচিতি আছে। ভারত-তিব্বত সীমান্তে এই গ্রামের আশেপাশে সেনা ছাউনি আছে। এখানকার দেড়শোর মতো অধিবাসী চিনের আগ্রাসনের সময় তিব্বত থেকে পালিয়ে আসে। এরা সাধারণ যাযাবর শ্রেণির মানুষ। আগে এরা চিন ও তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য করত। চেহারায় চিনাদের সঙ্গে মিল আছে। এদের স্থানীয় নাম মার্চা। ধর্মীয় রীতি অনুসারে, শীতের সূচনায় ‘মন্দির বন্ধ’র অনুষ্ঠানে প্রতি বছর মানাগ্রামের মহিলাদের তৈরি একটি বিশেষ পশমের চাদর বদ্রীনাথের মূর্তির জন্য দেওয়া হয়।
সমুদ্রতল থেকে মানাগ্রামের উচ্চতা ৩১১৮ মিটার। পথের ধারে পাথরের দেওয়ালে নানা মাপ, রং, নকশার কার্পেট, বিক্রির জন্য রাখা। সিমেন্টে বাঁধানো সরু পাহাড়ি রাস্তার ডান দিকে খাড়াই পাহাড়। বাঁ দিকে স্রোতস্বিনী সরস্বতী। আরও একটু এগিয়ে বাঁ দিকে স্বর্গারোহিণী শৃঙ্গ দেখতে পেলাম। কথিত আছে, পাণ্ডবরা স্বর্গে যাওয়ার পথে মানাগ্রামে এসেছিলেন। এখান থেকে যাত্রা শুরু করেন মহাপ্রস্থানের পথে। কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড জলের গর্জনে খুঁজে পেলাম সীমান্তে মানাপাস থেকে আসা সরস্বতী নদীর উৎসস্থল। কথিত আছে, পরিশ্রান্ত দ্রৌপদী সরস্বতী নদীর বিস্তার পার হতে পারেননি। ভীম হাত জোড় করে সরস্বতী নদীকে কলেবর সংকীর্ণ করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরস্বতী এই অনুরোধ প্রত্যাখান করেন। তাই রাগান্বিত ভীম লাথি মেরে একটি পাথর আড়াআড়ি ভাবে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। যা ভীম পুল নামে পরিচিত। সবুজ লতাগুল্মে ঘেরা বিরাট বিরাট পাথরের ফাঁক দিয়ে অন্ধকার গুহা থেকে প্রবল বেগে সশব্দে সরস্বতীর জলধারা বেরিয়ে আসছে। দু’টি বিশাল আকারের পাথরের তলা দিয়ে পূর্ণযৌবনা সরস্বতীর উদ্দাম স্রোত ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে। ধাপ কেটে তৈরি কংক্রিটের পাথুরে রাস্তায় হলুদ রঙের সরস্বতী মন্দিরে গেলাম। সামনের প্রশস্ত চত্বর থেকে স্রোতের ভাসমান জলকণায় রামধনুর অপূর্ব রঙের খেলা চোখে পড়ল। মন্দিরের পাশে বাতাসে উড়ছে লাল ও সাদা রঙের সিল্কের পতাকা। মন্দিরে লাল পর্দার সামনে লাল-কমলা কাপড়ে মোড়া সরস্বতী মূর্তি। ফেরার পথে দেখলাম ডান দিকের সাদা পাথরের খাড়াইতলের নীচের দিকে কৈলাস-মানস সরোবরের জল, একটা নির্দিষ্ট ফাটল থেকে অবিরাম ধারায় পড়ছে। শুনলাম, দ্রৌপদীর তৃষ্ণা নিবারণে এই জল কাজে লেগেছিল। এর পাশেই গুহার মধ্যে ত্রিশূল, ছবি, বিগ্রহ নিয়ে গায়ে সাদা ছাই মাখা, মাথায় জটাওয়ালা নাগা সন্ন্যাসী বর্ফানী দাসের ডেরা। এর পর বাঁ দিকে খাড়াই সংকীর্ণ রাস্তা ধরে ব্যাসগুহা বা ব্যাসদেবের ডেরার জন্য আরও উপরে উঠতে থাকি। পথের ধারে পাথর সাজিয়ে একটা দেওয়াল আছে। এখানেই ভারতের সীমানায় শেষ চায়ের দোকান। খাড়া পাহাড়ের নীচে হলুদ রঙের ব্যাসগুহা। সাদা দেওয়ালে লেখা আছে, এই পবিত্র গুহা ৫১১১ বছর পুরনো। পৌরাণিক ইতিহাসে উল্লিখিত যে মহর্ষি ব্যাসদেব এই গুহায় বাস করতেন। এই জায়গাটি ‘মণিভদ্র আশ্রম’ নামে পরিচিত হয়। গুহার মধ্যে লাল ভেলভেট কাপড়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাসদেবের সাদা মূর্তি। কিংবদন্তি যে, এই গুহাতেই ব্যাসদেব বেদ চার খণ্ডে বিভাজিত করেন। ব্যাসগুহা থেকে ঢালু ঘোরানো পাহাড়ি পথে গণেশ গুহায় গেলাম। গোলাপি রঙের গঠন কাঠামোর শীর্ষে একটি লাল-সাদা পতাকা আছে। পথের ধারে আসল উলের সোয়েটার, মাফলার, কার্ডিগান, টুপি বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখা আছে। গ্রাম থেকে বেরোনোর সময় চোখে পড়ল হলুদ তোরণে লেখা ‘ধন্যবাদ’।
মানাগ্রামে সরস্বতী নদীর উৎস খোঁজার স্মৃতি সততই সুখের...
Previous Item Utsav Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.