|
|
|
|
কেন্দ্রের আপত্তি মেনেই ঐকমত্য |
পরশু পাহাড়-চুক্তি সই হচ্ছে সুকনায় |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
সাড়ে তিন বছর আগে যেখানে পাঁচ দিন আটকে থাকার পরে পাকাপাকি ভাবে পাহাড় ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সুবাস ঘিসিং, আগামী সোমবার সেই পিনটেল ভিলেজেই সই হতে চলেছে পাহাড়ের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। যার মাধ্যমে সরকারি সিলমোহর পড়বে বিমল গুরুঙ্গের জমানায়।
রাজ্যে ক্ষমতা দখলের ৫৭ দিনের মাথায় দার্জিলিং পাহাড়ের সমস্যার সমাধানের জন্য চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার দুপুরে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী জানান, আগামী ১৮ জুলাই, সোমবার পাহাড় নিয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
চুক্তি সইয়ের সেই অনুষ্ঠানে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। থাকবেন কেন্দ্র ও রাজ্যের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জন অফিসারও। গুরুঙ্গদের দাবি ছিল, পাহাড় চুক্তি স্বাক্ষর হোক পাহাড়ে। কিন্তু বর্ষায় ধসপ্রবণ দার্জিলিঙে চুক্তি-অনুষ্ঠান করার ঝুঁকি নিচ্ছে না রাজ্য সরকার। পরিবর্তে বেছে নেওয়া হয়েছে পঞ্চনই নদীর ধারে সুকনার পিনটেল ভিলেজকে। শিলিগুড়ি থেকে যার দূরত্ব সাত কিলোমিটার। আবার পুরনো গোর্খা পার্বত্য পরিষদের এলাকার মধ্যেই পড়ছে এই অঞ্চলটি। ১৮ তারিখ ঘিসিংয়ের অত্যন্ত প্রিয় এই আস্তানায় যখন ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটি সই হবে, শিলিগুড়িতে তখন বাংলা ও বাংলা ভাষা বাঁচাও সমিতি-সহ আটটি সংগঠনের ডাকা দু’দিনের বন্ধ চলার কথা। বন্ধ অবশ্য শুক্রবারও ডাকা হয়েছিল। তবে বাংলা মোর্চা-সহ আটটি সংগঠনের ডাকা এই ২৪ ঘণ্টার বন্ধ সন্ধ্যা ৬টার পরে উঠে যায়। মনে করা হচ্ছে, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বন্ধ সমর্থকদের যে সারাদিন ধরে বুঝিয়েছেন, তাতেই শেষ পর্যন্ত বন্ধ তুলে নিয়েছে তারা।
কিন্তু ঘিসিং এ দিন কী করেছেন? জলপাইগুড়িতে রাজ্য সরকারের ভাড়া করা বাড়িতে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এ দিন নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করে রেখেছিলেন তিনি। নিয়মমতো বিকেলেও বাড়ি থেকে বার হননি। জানা গিয়েছে, দিনভর টিভির সামনেই বসেছিলেন তিনি। চুক্তির পরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ঘিসিংয়ের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানানো হয়, এখন তিনি কিছু বলবেন না। চুক্তি দেখে যা বলার বলবেন। |
|
মহাকরণে শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: অশোক মজুমদার |
চুক্তি চূড়ান্ত করা নিয়ে অবশ্য কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষই জানিয়েছিলেন, চুক্তির খসড়া নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে। সরকারি সূত্রের খবর, ত্রিপাক্ষিক চুক্তির খসড়ায় তিন-চারটি বিষয় ‘আপত্তিজনক’ বলে মনে হয়েছিল কেন্দ্রের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিন্তার বিষয় ছিল, এই চুক্তির কোনও ফাঁক দিয়ে যেন ভবিষ্যতে কোনও ভাবেই পৃথক রাজ্যের দাবি না ওঠে। বিশেষ করে তেলেঙ্গানার আগুন নিয়ে বিপাকে থাকা কেন্দ্র দেখতে চাইছিল, ভবিষ্যতে এই চুক্তি নিয়ে যেন আইনি সমস্যা বা সাংবিধানিক জটিলতা দেখা না দেয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তাই আপত্তি করেছিল ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নামটি নিয়েই। প্রস্তাবিত স্বশাসন যে সংস্থা চালাবে, তার এই নামই ধার্য হয়েছে চুত্তিতে। এমন নামের ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথক রাজ্যের দাবি জোরদার হওয়ার আশঙ্কা হবে কি না, তা নিয়েও রাজ্যের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও দিল্লি এবং কলকাতায় নানা মহলে বিশদে খোঁজখবর নেন। তবে বিতর্ক দানা বাঁধার আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বোঝান, গোর্খাল্যান্ড নামটাতে আপত্তির কোনও কারণ নেই। কারণ, দিনের শেষে গুরুঙ্গরা স্বশাসিত পরিষদই পাচ্ছেন। পৃথক রাজ্য নয়। ওই নাম থাকলেও আলাদা রাজ্যের দাবিতে যে জেদাজেদির রাস্তায় মোর্চা হাঁটবে না, সেই ব্যাপারেও তিনি কেন্দ্রকে নিশ্চিত করেন। মোর্চা নেতাদের সঙ্গেও টেলিফোনে আলোচনা হয় দু’পক্ষের। কেন্দ্রকে মমতা আরও জানান, গুরুঙ্গরা প্রথমে স্বশাসিত পরিষদের নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘গোর্খাল্যান্ড অ্যাসেম্বলি’। কিন্তু মমতা সেটা খারিজ করে দেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “একটা শব্দ পরিবর্তন হতেই পারে। তাতে কি যায়-আসে! এই নিয়ে যারা রাজনীতি করছে, তারা দুষ্ট গোয়ালের লোক।”
অ্যাসেম্বলি বা বিধানসভা, স্পিকার এই সব শব্দ অবশ্য নানা ভাবে চুক্তিতে পরেও ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, স্বশাসিত প্রশাসনের সভাকে অ্যাসেম্বলি বা বিধানসভা বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল। একই ভাবে সেই সভার পরিচালককে স্পিকার বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণত রাজ্যের ক্ষেত্রেই বিধানসভা ও স্পিকার শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়। চুক্তিতে তাই প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পুলিশে নিয়োগে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ‘গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল’ শব্দটি তুলে ‘গোর্খা জনজাতির যুবক’ বলে উল্লেখ করার সুপারিশ পাঠায় কেন্দ্র। তা-ও মেনে নিয়েছে মোর্চা ও রাজ্য। মোর্চার তরাইয়ের এলাকাগুলির দাবি নিয়ে ঠিক হয়েছে, একটি কমিটি সেই দাবিগুলি খতিয়ে দেখবে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, চুক্তিটি ত্রিপাক্ষিক হলেও আসলে কেন্দ্রের ভূমিকা এখানে অনেকটাই সাক্ষী থাকার মতো। এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে, মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন, চুক্তিতে সই করবেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব, মোর্চার সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব কে কে পাঠক।
সব সমস্যা কাটিয়ে তিন পক্ষই ঐকমত্যে পৌঁছনোর পরেই এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে ঘোষণা করেন, “আমরা সহমত হয়েছি। ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হচ্ছে। প্রস্তাবিত নতুন স্বশাসিত পর্ষদ এলাকার মধ্যে সুকনায় এই অনুষ্ঠান হবে।” পাহাড় থেকে চুক্তি-অনুষ্ঠান সুকনার পিনটেল ভিলেজে সরিয়ে আনার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বর্ষাকাল চলছে। আবহাওয়া খুব খারাপ। বৃষ্টি হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাহাড়ে পৌঁছতে পারবেন না। তাই সুকনাতে ‘স্পট’ ঠিক করা হয়েছে।”
চুক্তির অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী এবং উত্তরবঙ্গের বিধায়করা। থাকবেন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। মমতা চান, চুক্তি অনুষ্ঠানে থাকুন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র। তবে পাহাড় নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে ভাল করে না জেনে অনুষ্ঠানে হাজির থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায় না সিপিএম। সূর্যকান্তবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর দূত মারফত মৌখিক ভাবে আমন্ত্রণ পেয়েছি। কিন্তু চুক্তির কী বিষয়বস্তু, কোন কোন শর্তের উপরে চুক্তি সই হচ্ছে, তা ভাল করে না জেনে কিছু বলা সম্ভব নয়।” বিষয়টি নিয়ে সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। সিপিএমের বক্তব্য, পাহাড়ের মতো ‘স্পর্শকাতর’ একটি বিষয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সর্বদল বৈঠক ডাকা উচিত ছিল।
চুক্তির হাত ধরে পাহাড়ের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর জন্য অর্থ দেওয়ার কথা কেন্দ্রীয় সরকারের। প্যাকেজে কী আছে, তা এ দিন জানাতে রাজি হননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে বলেছেন, “রোটি-কাপড়া-মকান-এর কথা থাকবে।” তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, পাহাড়ের নতুন স্বশাসিত প্রশাসনকে প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা করে অর্থসাহায্য দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। স্বশাসিত প্রশাসন গঠিত হওয়ার পর প্রথম তিন বছর এই পরিমাণ অর্থসাহায্য দেওয়া হবে।
এই খবর চাউর হতেই খুশির হাওয়া বইছে পাহাড়ে। তরাই, ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের সমতলের দোলাচল অবশ্য কাটেনি। এ দিনের বন্ধ উঠে গেলেও বাংলা ও বাংলা ভাষা বাঁচাও সমিতি-সহ আটটি সংগঠনের ১৮-১৯ তারিখের ডাকা বন্ধ এখনও বহাল। তবে, তরাই-ডুয়ার্সকে আজ, শনিবার থেকে যে ৪৮ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দিয়েছিল আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, তা থেকেও তারা কিছুটা সরেছে। রবিবারের বন্ধ তারা তুলে নিয়েছে। আজ, শনিবারের বন্ধে চা বাগানকে ছাড় দিয়েছে পরিষদ।
গোর্খাল্যান্ডের দাবি ‘হৃদয়ে রেখে’ মোর্চা নেতারা যে রাজ্যের মধ্যে থেকেই অন্তর্বর্তী স্বশাসন নিতে রাজি হয়েছেন, সে কথা আন্দোলনকারীদের বোঝান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তবে কী চুক্তি হচ্ছে, তা প্রকাশ্যে আসার পরে প্রয়োজনে আরও বড় মাপের আন্দোলনের হুমকিও দিয়ে রেখেছে বাংলা মোর্চা, আদিবাসী পরিষদ-সহ একাধিক সংগঠন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমরা যখন মোর্চার সঙ্গে আলোচনা করেছি, তখনও এরা বন্ধ ডেকে তা ভণ্ডুলের চেষ্টা করেছে। তৃণমূল তখন তার বিরোধিতা করেনি। আমরা কিন্তু এখন এই বন্ধের বিরোধিতা করছি।”
চুক্তি স্বাক্ষরের পরে দু’দিনের সফরে আরও কয়েকটি ঘোষণার কথা মাথায় রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজেই জানান, কলকাতা-কোচবিহার উড়ান চলাচলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হবে। উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলার জন্য পৃথক সচিবালয়ের অফিসের প্রতীকী উদ্বোধনও হতে পারে। এ ছাড়া আলুয়াবাড়ি থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেল মন্ত্রকের বাস চলাচলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হতে পারে সে দিন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “উত্তরবঙ্গের জন্য রেল ও রাজ্যের অনেক প্রকল্প করে দেব। যেমন জলপাইগুড়িতে সার্কিট বেঞ্চ। তবে আস্তে আস্তে হবে।” |
|
|
|
|
|