|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
যাত্রালক্ষ্মীর সেবায় আজীবন নিবেদিত |
প্রভাতকুমার দাস |
বাংলার যাত্রানাটক, ব্রজেন্দ্রকুমার দে। দিশারী প্রকাশনী, ১৩০.০০ |
বিশ শতকের পেশাদার যাত্রার প্রাতঃস্মরণীয় যুগপুরুষ ব্রজেন্দ্রকুমার দে (১৯০৭-১৯৭৬) সর্বস্তরের যাত্রামোদীদের কাছে মাস্টারমশাই, পালাসম্রাট কিংবা লোকনাট্যগুরু হিসেবে অভিহিত হয়েছেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, অর্থনীতিতে এম এ পাশের পর অন্য কোনও লোভনীয় জীবিকার চেয়ে শিক্ষকতা পেশাকেই গ্রহণীয় ভেবেছিলেন। কেননা, অবসর মতো পালা নিয়ে বাংলার জাতীয় সম্পদ যাত্রালক্ষ্মীর সেবা করতে পারবেন। তাঁর শিক্ষক যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর আদেশ শিরোধার্য করে একাগ্র মনে সারা জীবন পালা লিখেছেন, যাত্রাসংস্কারে মনোযোগী থেকেছেন যাত্রাপালাকে সাহিত্যের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার লক্ষ্যে ব্রতযাপন করেছেন। পঁয়ত্রিশ বছর আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন, শুধু যে তাঁর রচিত অনেক পালার বিষয়বস্তু এখনকার নিরিখেও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি তা নয়, প্রবন্ধ-নিবন্ধে তাঁর নিজের কালে দাঁড়িয়ে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে যে-সব অভিমত জানিয়েছেন, তা আজকের প্রেক্ষিতেও বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। প্রয়াণের পরে পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা কিছু গদ্য রচনা করে একত্র করে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল, সম্প্রতি বাংলার যাত্রা নাটক শিরোনামে ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র আর একটি বই পাওয়ার সুযোগ হল।
মতিলাল রায়, মুকুন্দদাস আর ভোলানাথ রায়ের সফল উত্তরাধিকার বহন করে ব্রজেন্দ্রকুমার কলকাতার পেশাদার যাত্রার সংস্রবে এসেছিলেন গত শতকের তিরিশের দশকের গোড়ায়। তার পর প্রায় চার দশকের অধিক সময় ধরে, পালা রচনায় যে-সব নতুন উন্মেষ ঘটিয়ে বাংলার যাত্রাগানকে শিক্ষিত সমাজে প্রতিষ্ঠা দানের সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন, তা আমাদের যাত্রা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এক অননুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যে জন্য সমকালীন সর্বাঙ্গীণ বিকাশ-প্রতিষ্ঠাকে ‘ব্রজেন্দ্র-যুগ’ হিসেবেই চিহ্নিত করতে হয়। যদিও তাঁর কালের প্রধান যাত্রাগুরুদের মধ্যে যাঁরা অগ্রগণ্য, তিনি তাঁদের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করেছেন ছোট পরিসরে কয়েকটি আলোচনায়। প্রবাদপ্রতিম সূর্য দত্ত, বড় ফণী, ছোট ফণী, পঞ্চু সেন, বিমল লাহিড়ীদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে তিনি যা লিখেছেন, তার ভিতর দিয়ে ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায় আলোকিত হয়েছে। |
আলোচ্য সংকলনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ অধুনালুপ্ত অভিনয় পত্রিকার সঙ্গে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সেই আলাপচারিতায় যাত্রা বিবর্তনের যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তার ঐতিহাসিক ও তথ্যসমৃদ্ধ গুরুত্ব অপরিসীম। যাত্রা জগতের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা, তা একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও বিশ্লেষণাত্মক। এই বিবরণের সঙ্গে এ গ্রন্থের নামপ্রবন্ধ ও ‘পালাকারের জবানবন্দি’ শীর্ষক দু’টি রচনাই পরিপূরক বর্তমান প্রজন্মের যাত্রানুরক্ত তরুণ গবেষকদের কাছে একই সঙ্গে সুখপাঠ্য ও আকর হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়াও তাঁর কয়েকটি বক্তৃতা ও চিঠিপত্রের সংকলন বর্তমান গ্রন্থের উপযোগিতা বৃদ্ধি করেছে। ভূমিকায় উল্লেখ সত্ত্বেও তাঁর অনিয়মিত লেখা ডায়েরি-র দু-চার টুকরো কেন সংযুক্ত হয়নি, তা জানলে ভাল হত। আশা করা যায়, ‘পরবর্তী কোনও প্রচেষ্টায় সে গুলোকে একত্র করবার’ নিশ্চয় ব্যবস্থা করা হবে। |
ব্রজেন্দ্রকুমার দে
(১৯০৭-১৯৭৬) |
|
এক অর্থে যাত্রা ও তাঁর জীবন দীর্ঘকাল অনবচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। জীবিকার বাইরে অবসরের সবটাই তিনি নিবেদন করেছিলেন যাত্রালক্ষ্মীর সেবায়। জীবনের শেষতম পালার জন্য এক সংবর্ধনার আসরে তিনি তাই অকপটে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন: ‘আবার যেন আমি আসি যাত্রালক্ষ্মীর পীঠস্থান এই বাংলার মাটিতে। যে গান গাওয়া হল না, সে গান শেষ করতে বিধাতা যেন আমায় বারে বারে পাঠিয়ে দেন এইখানে এই জংলা মাটিতে।’
তরুণকুমার দে একটি ছোট্ট ভূমিকা লিখেছেন, তা ছাড়াও প্রায় প্রতিটি রচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য ও টীকা যোগ করে দিয়েছেন। এ ছাড়াও গ্রন্থের শেষাংশে ব্রজেন্দ্রকুমারের মূল্যায়ন এবং ‘বিদ্রোহী নজরুল পালার কবি মোহিতলাল’ বিতর্ক প্রসঙ্গে সমকালীন প্রতিক্রিয়ার একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন করেছেন তিনি। তরুণকুমার ঠিকই বলেছেন, পালাকার হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত হওয়া সত্ত্বেও ব্রজেন্দ্রকুমার যে বিভিন্ন সময়ে যাত্রা বিষয়ে মূল্যবান কিছু স্মৃতি-সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন, তা ‘খুব কম মানুষেরই জানা আছে।’ ঠিক কথা, পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমারকে জানতে হলে তাঁর লেখা এই সব নিবন্ধের সন্ধান অত্যন্ত জরুরি।
এ রকম একটি কাজে আগ্রহ দেখিয়ে প্রকাশক ধন্যবাদার্হ, তবু বিন্যাস, বানান, মুদ্রণপ্রমাদ ছাড়াও সামগ্রিক সতর্কতা ও সম্পাদনার অভাব দেখে মন বেশ কিছুটা খারাপ হবেই। |
|
|
|
|
|