পুস্তক পরিচয় ১...
গোটা উপস্থিতিটাই ছিল ‘সিডিশাস’
জাগরণের চারণ মুকুন্দদাস ও তাঁর রচনাসমগ্র, পুলক চন্দ। দে’জ, ৪৫০.০০
ঠিক একশো বছর আগে ব্রিটিশ শাসকের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক চালকে বানচাল করতে পেরেছিল বাঙালির দেশাত্মবোধ, বাঙালির আবেগ ‘সেটল্ড ফ্যাক্ট’ হল ‘আনসেটল্ড’। ১৯০৪-১৯১১-র মধ্যেই দেখা যায় বাঙালির রাজনৈতিক ক্রিয়াশীলতার অনবদ্য স্ফুরণ। ইংরেজি বোলচালের নেতাদের সঙ্গে এক আশ্চর্য জাগরণের চেতনায় বাঁধা পড়েছিলেন সাধারণ গ্রামীণ মানুষও। বাংলা জুড়ে তখন স্বাদেশিকতার মহোৎসব। তবে জয়ের চূড়ান্ত সংবাদের সঙ্গে এসেছিল শোকবার্তাও, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালির আধিপত্যে বেজেছিল বিদায়ঘণ্টা। এর পর উচ্চ ও মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে ক্রমশই সরতে থাকে রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র। অতএব, ১৯১১-র স্মৃতি খুব সঙ্গত কারণেই বাঙালির মনে বহুধা ব্যঞ্জিত। শতবর্ষের পূরণে নানাবিধ স্মৃতিচারণের সূত্রেই হাতে এল জাগরণের চারণ মুকুন্দদাস ও তাঁর রচনাসমগ্র। যে-সব পুরনো মানুষজনের গল্পে কথায়, স্মৃতিকথনে মুকুন্দদাসের গানের কলি, যাত্রাভিনয়ের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসতে পারত, তাঁরা আজ বিলুপ্ত প্রজাতি। পুলক চন্দ লেখক, গায়ক, রাজদ্রোহী, পল্লিপ্রেমী, ‘অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাবশিষ্য’ মুকুন্দকে তত্ত্ব তথ্যের সম্ভারে এ ভাবে না তুলে ধরলে তাঁরও হয়তো বিলোপ ঘটত। বিচ্ছিন্ন ভাবে সংকলিত মুকুন্দদাসের রচনা যা এর আগে প্রকাশিত হয়েছে বা চার দশক প্রাচীন জয়গুরু গোস্বামীর চারণকবি মুকুন্দদাস আর সহজে হাতে আসে না। ইতিহাস অনুরাগী ছাড়া লোকগানে আগ্রহীদের কাছেও এটি একটি সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
বর্তমান সংগ্রহে আছে মুকুন্দদাসের চারটি যাত্রাপালা (সমাজ, ব্রহ্মচারিণী, পল্লীসেবা, কর্মক্ষেত্র), যাত্রাপালার বহির্ভূত এবং এযাবৎ ‘সম্পূর্ণ দৃষ্টির অগোচরে থাকা’ ৮৫টি গান ও গদ্যরচনা। এ ছাড়া মুকুন্দ-সংস্করণ ও বসুমতী সংস্করণে উক্ত চারটি যাত্রাপালার পাঠান্তর, এবং মুকুন্দদাসের মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ পাঠ, স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে ১৯০৫-১৯০৮-এর মধ্যে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ও ‘বেঙ্গলি’-র যাবতীয় প্রতিবেদন, ‘মাতৃপূজা’র গানের অনুবাদের টীকা ও সরলাবালা সরকারের স্মৃতিচারণ সংবলিত চারটি পরিশিষ্ট। শুরুতে সংগ্রাহক-সম্পাদকের অতি দীর্ঘ গবেষণামূলক ভূমিকাটিও বইটির অনন্য সম্পদ। মুকুন্দদাসের যাত্রাপালায় কবি-পরিচয় অনুল্লিখিত ব্যবহৃত গানের সূত্র নির্দেশ থেকে মুকুন্দের জীবন, কর্ম ও রাজনৈতিক-সামাজিক চিন্তাপ্রবাহে অংশীদারিত্ব, সব এসেছে আলোচনার আওতায়।
ডাকাত থেকে মহাত্মা বাল্মীকির এই ‘আর্কিটাইপ’-এর বাঙালি জীবনে চমকপ্রদ উদাহরণ মুকুন্দদাস। বরিশালের ডেপুটির আর্দালি গুরুদয়াল দে এবং শ্যামাসুন্দরীর সন্তান যজ্ঞেশ্বর ব্রজমোহন স্কুলে কোনওক্রমে ক্লাস এইট পর্যন্ত উঠে পড়াশোনায় ইতি টেনে খুলে বসে মুদির দোকান। একই সঙ্গে এক গুন্ডাদলের পাণ্ডা হিসেবে ‘যজ্ঞা গুন্ডা’ ও তার দল আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। পুলিশ যখন এদের শায়েস্তা করতে নাজেহাল, তখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বিটসানবেলের ‘ক্যারট অ্যান্ড স্টিক’ নীতি ফলপ্রসূ হয়। পুলিশ কিংবা কেরানির চাকরির লোভ দেখিয়ে গুন্ডাদলকে ছত্রভঙ্গ করা যায়। গুন্ডামিতে ক্ষান্ত দিলেও যজ্ঞেশ্বর কিন্তু চাকরির দ্বারা প্রলোভিত হয়নি, দোকানকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে তার দিনযাপন। কীর্তন বা পালাগানের প্রতি আকর্ষণ, যা ছিল তার আবাল্য সম্পদ তা-ই জীবনের এই উত্তরণপর্বে হয়ে ওঠে তার অন্যতম পাথেয়। বৈষ্ণব বীরেশ্বর গুপ্তের সাকরেদ থেকে কিছু কালের মধ্যেই স্বাধীন গায়েন যজ্ঞেশ্বরের আবির্ভাব ঘটে মুকুন্দদাস নামে। স্কুলে থাকাকালীন অশ্বিনীকুমার হয়তো যজ্ঞেশ্বরের অজান্তেই স্বাদেশিকতার যে বীজ রোপণ করেছিলেন তার মনে, শক্তির উপাসক মুকুন্দদাসের গানে তা-ই মহীরূহ হয়ে দেখা দেয়।
মুকুন্দদাসের মঞ্চোপস্থিতি দর্শকদের চোখে ছিল এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সরলাবালার স্মৃতিচারণে পড়ি, ‘‘যাত্রা আরম্ভ হইল। ড্রামের ধ্বনির সহিত সমতানে ঐকতান বাদ্য বাজিয়া উঠিল। মুকুন্দদাস রঙ্গ মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলেন। গৈরিক বর্ণের আলখাল্লার মত একটি পোশাক পরিধান করিয়াছেন, মাথায় পাগড়ি, দীর্ঘায়িত, বলিষ্ঠ দেহ, গলায় মেডেলের মালা। তাঁহার প্রতি পদক্ষেপে মঞ্চ কাঁপিয়া উঠিতেছে।... তাহার পর যখন ড্রামের বাদ্যের তালে তালে জলদগর্জনের ন্যায় মুকুন্দদাসের কণ্ঠের সঙ্গীত ধ্বনিত হইয়া উঠিল, তখন আসর একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেল। সেটি উদ্বোধন সঙ্গীত: আয়রে বাঙ্গালী, আয় সবে আয়/ আয় লেগে যাই দেশের কাজে, দেখাই জগতে নহে ভীরু বাঙ্গালী/ সেও দাঁড়াইতে জানে বীর সমাজে’’। (পৃ: ৬৫৪)। কেবল গানে বীরত্বের কথাতেই নয়, মুকুন্দদাসের সমগ্র উপস্থিতিতেই যে বীরত্বের অভিব্যক্তি, তা ছিল তৎকালীন বাঙালি মননে এক তীব্র ক্ষতের ওষুধ। ব্রিটিশ শাসকদের তির্যক অভিধায় বাঙালি ভদ্রলোক ছিল ‘দুর্বল’, ‘নারীসুলভ’। স্বভাবতই দায় বর্তেছিল উচিত জবাব দেওয়ার। এলিট সমাজ যখন নানা উপায়ে এই জবাব সন্ধানে ব্যস্ত, তখন মুকুন্দদাসের মতো গায়ক, অভিনেতারা ‘পারফরমেন্স’কে হাতিয়ার করে এই বার্তা সহজেই পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষ ও শাসকদের কাছে। সরকারের চোখে কেবল মুকুন্দের গানে ও যাত্রায় স্বাদেশিকতার বার্তাই ‘সিডিশাস’ ঠেকেনি, হয়তো ‘সিডিশাস’ ঠেকেছিল তাঁর গোটা উপস্থিতিই।
আরেক অর্থে ‘স্বদেশি’ প্রয়াসে মুকুন্দের মতো মানুষের অবদান ছিল নিতান্তই অপরিহার্য। পুলক চন্দ যথোচিত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এলিট এবং সাধারণের মধ্যে তাঁর সংযোগস্থাপনকারী ভূমিকা। শ্রীচন্দের উল্লিখিত অশ্বিনী দত্তের একটি মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; “কলেজে পা দিতে পারিলেই আর মুকুন্দ হইত না, শিষ্ট ভদ্র গৃহস্থ হইত; বরিশালের লোকেরাও চিনিত না”। (পৃ. ৫২) কলেজি শিক্ষা যে মানুষকে পল্লিসমাজের রূপ রস থেকে দূরে ঠেলে, মুছে দেয় তার গায়ের মাটির গন্ধ এমন চিন্তা মুকুন্দের যাত্রা, গানেও বার বার ফিরে এসেছে। লেখক এবং কবি হলেও মুকুন্দ যে দেশ জোড়া ‘অশিষ্ট’ গ্রামীণ মানুষেরই একজন, এ বার্তা তাঁদের কাছে পৌঁছেছে অভিনেতা-গায়ক মুকুন্দের মধ্য দিয়ে। পল্লি সংগঠন, গ্রামীণ আদর্শের বাণী, বিদেশি বর্জনের ডাক মুকুন্দের মেঠো গানে, অকপট তেজস্বী অভিনয়ে সাড়া জাগিয়েছিল তাঁদের হৃদয়তন্ত্রীতে। তাঁর যাত্রাপালার দিনটি ছিল মহা সমারোহের ঘর ফেলে দূর-দূর পল্লি থেকে আসত মানুষ নৌকা বেয়ে, পায়ে হেঁটে; মেয়েরা আসতেন ছেলে কোলে, খাবার নিয়ে; বাড়ি ঘর সেদিন থাকত জনশূন্য, কারণ ‘চাকর, লোকজন, নৌকার মাঝি প্রভৃতি সকলেই যাত্রা শুনিতে আসিয়াছে’। (পৃ. ৮৫৪) আর মুকুন্দ যখন বিভোর হয়ে ‘মাতৃপূজা’র গান গাইতেন, ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’ তখন শ্রোতাদের সঙ্গে নজরদার পুলিশবাহিনীও কালীমূর্তির দিকে চেয়ে দেখত যে সত্যিই মায়ের হাতের মাটির খড়্গ দুলে উঠেছে। (পৃ. ৩৪) শাসকরা যে এর পর তাঁকে কারারুদ্ধ করার কথা ভাববে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
শ্রীচন্দ নির্মোহ ঐতিহাসিকতার নিয়মাবলি মেনেই দেখিয়েছেন যে, মুকুন্দের অসাধারণত্বের মধ্যেই মিশেছিল তাঁর সময়কালের চেতনার সীমাবদ্ধতার চিহ্ন। গাঁধীর শ্রেণিসমন্বয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় তাঁর পল্লীসেবা-য়, কর্মক্ষেত্র-এ। দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষের দুঃখে বিহ্বল মুকুন্দদাস গ্রামীণ পুনরুজ্জীবনের উপায় দেখতে পান সদাশয় জমিদারের নেতৃত্বে। আবার, নারী নির্যাতন, পণপ্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার হলেও পিতৃতন্ত্রের পরিধি বা প্রচলিত ঐতিহ্যের বাইরে তাঁর চিন্তার বিস্তার ঘটেনি। কর্মক্ষেত্র-এ বাউল তাঁর শিক্ষয়িত্রী মেয়ে গার্গীকে উপদেশ দেন, ‘মনে রেখো, শুধু লেখাপড়া শেখালেই হবে না, তাদের ধর্ম্ম-জীবন কর্ম্ম-জীবন দু-ই এখান থেকে তৈরী করে দিতে হবে, যেন তারা সংসারে গিয়ে আদর্শ গৃহিণী হ’য়ে দাঁড়াতে পারে। শ্বশুর-শাশুড়ী যেন তাদের সেবায় আনন্দে ভরপুর হয়। বর্ত্তমানে বাংলার অবস্থা বড়ই ভীষণ হ’য়ে দাঁড়িয়েছে, বউ ঘরে এলেই শ্বশুর-শাশুড়ীর বুক শুকিয়ে যায়। তোমার বিদ্যালয়ে যাতে গৃহলক্ষ্মী তৈরী হয়, সে দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবে’। (পৃ. ৩৮৭) আর আন্তরিক ভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতিকামী হলেও মাতৃকাশক্তির অবিরল বন্দনা তাঁকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রবণতার অঙ্গীভূত করেছিল তো বটেই।
এই সমস্ত ঐতিহাসিক জটিলতার মধ্যে দিয়েই শ্রীচন্দ যে বর্ণময় মুকুন্দদাসকে উপহার দিয়েছেন, সে জন্য অবশ্যই তাঁর অভিনন্দন প্রাপ্য। তবে অভিনেতা, গায়ক, শিল্পীরা হয়তো বলবেন, বইয়ের পাতায়, নথিপত্রে একজন বিদ্রোহীর চিন্তা-চেতনা ধরা পড়লেও, এক জন ‘পারফরমার’-এর সম্যক ছবিটি ধরা পড়ে না, ‘পারফরম্যান্স’-এর মুহূর্তটিতেই ঘটে এক শিল্পীসত্তার পূর্ণ পরিস্ফুটন। মুকুন্দদাসের ‘পারফরম্যান্স’ ক্যামেরাবন্দি করার যেহেতু সুযোগ ছিল না, সেহেতু এ বিষয়টি অজানাই থেকে যাবে। তবে, তৎকালীন যাত্রাগানের ঐতিহ্যের নিরিখে যদি মুকুন্দদাসের গানের ঘরানা, যাত্রার বিশিষ্টতার উপর সম্পাদক কিছুটা আলোকপাত করতেন, তা হলে কতকটা হলেও এ জাতীয় কৌতূহল মিটত।
Previous Item Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.