দক্ষিণ কলকাতা: বেহালা
জোকা
ডুবাইলি রে...
কটির পর একটি আবাসন বাড়ছে। বাড়ছে জনবসতি। গোটা পঞ্চায়েত এলাকাটিকে কলকাতা পুরসভার মধ্যে আনার পরিকল্পনাও প্রায় পাকা বর্তমান রাজ্য সরকারের। কিন্তু যে এলাকাটি নিয়ে এত চিন্তাভাবনা, সেই জোকা-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কার্যত নিকাশি ব্যবস্থাই নেই। বর্ষায় জল জমে, সেই জল আবার প্রকৃতির নিয়মে শুকিয়েও যায়। এই পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকায় সারা বছর জল জমে থাকে।
জোকা গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দার সংখ্যা ৪০ হাজারের কিছু বেশি। এক দিকে কবরডাঙা, অন্য দিকে ঠাকুরপুকুর ৩এ বাসস্ট্যান্ড। একটি দিক পৈলান, অন্য দিক বাখরাহাট রোডের হাঁসপুকুরের এ পার। বিশাল এই এলাকাই কলকাতা পুরসভার লাগোয়া। নগরায়ণের ঢেউ আছড়ে পড়ছে শহরের লাগোয়া এই গ্রামীণ অঞ্চলে। এক সময়ে গোটা অঞ্চলটিই ছিল কৃষিজমি। ফলে নিচু। কিন্তু সেই নিচু জমিতেও বসতি
গড়া হয়েছে। যত দিন ফাঁকা ছিল, জল জমার বিষয়টি বুঝতে পারেননি বাসিন্দারা। যখন জনবসতি বাড়ল, তাঁরা বুঝলেন জল যাওয়ার জন্য নিকাশি ব্যবস্থার দরকার। এলাকায় নিকাশির মূল মাধ্যম চড়িয়াল খাল। সেই খাল ব্যবহার করে কলকাতা পুরসভার নিকাশির জলও বের করা হয়।
এক দিকে টালিগঞ্জ, অন্য দিক থেকে বেহালা, ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের জল পাম্প মারফত হাইড্র্যান্টে ফেলে পুরসভা। সেই জল এই অঞ্চলের ওপর দিয়েই বিভিন্ন নিকাশি নালা মারফত চড়িয়াল খালে পড়ে। কিন্তু কলকাতা পুরসভার বিশাল জল বহন করার মতো নিকাশি ব্যবস্থা জোকা পঞ্চায়েত এলাকায় নেই। এর উপর চড়িয়াল খালের নাব্যতা কম, বিপুল পরিমাণ জলধারণ করার ক্ষমতাও কম। ফলে উপচে পড়া জলে ভাসে গোটা পঞ্চায়েত এলাকা, পঞ্চায়েতের মত এ রকমই।
সৃজনী পার্ক, বাইনা বিঘা, অ্যানি সরণি, সত্যেন পার্ক, ডায়মন্ড পার্ক সমেত বিস্তীর্ণ এলাকা সামান্য বৃষ্টিতেই ভাসে। এমনকী, বেহালার জমা জল নেমে গেলেও এই এলাকার জল বাড়ে। দীর্ঘ সময় তা দাঁড়িয়েও থাকে। এলাকার বাসিন্দা বিপুল মালাকারের মন্তব্য: “বেহালার মানুষের চোখের জল শুকালে আমাদের চোখের জল পড়া শুরু। কেননা, ওদের সব জল আমাদের এলাকায় এসে জমে। আর এই জোকা-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় নিকাশি নালাই নেই। জল বেরবে কোথায়? সৃজনীতে সারা বছরই জল দাঁড়িয়ে থাকে। বর্ষায় সাপের আনাগোনা। বর্ষার পরে মশা-মাছি, চর্মরোগ ঘরে ঘরে।” বাবুর বাগানের বাসিন্দা বাবলা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “পুরসভার জল সব এই এলাকার মধ্যে দিয়েই যায়। বড় যে নিকাশি খালগুলি ছিল সেগুলি সংস্কার হয় না দীর্ঘ দিন। ফলে প্রায় বুজে যাওয়ার অবস্থা। তাই এই নিচু এলাকায় জল এসে জমে। থাকে সেই অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত।
জোকা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান সিপিএমের শৌভিক চৌধুরী বলেন, “আমাদের পঞ্চায়েত ২০০৮ থেকে উন্নয়ন (নিকাশি) খাতে সে ভাবে কোনও টাকাই পাচ্ছে না। ফলে নিকাশি উন্নয়ন হবে কী ভাবে? এলাকায় কোনও নিকাশি ব্যবস্থাই নেই। তাই সারা বছর জল জমে থাকে। আমাদের হাতে টাকা না থাকায় কোনও নিকাশি ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে পারিনি।” তাঁর বক্তব্য, চড়িয়াল খাল দীর্ঘ ৩০ বছর পর ড্রেজিং হচ্ছে। কিন্তু ড্রেজিং হলেও ডায়মন্ড পার্কের কাছে অ্যানি সরণিতে কিছু খালপাড়বাসী আছেন। তাঁদের একটি সমস্যার জন্য এই অংশে ড্রেজিং করেনি কেইআইপি। যার জন্য নিচু অংশের পর এই উঁচু অংশটা বাঁধের মতো চেহারা নিয়েছে। জল খাল থেকে উপচে এলাকা ভাসাচ্ছে। আর টানছে না।
ঠাকুরপুকুর মহেশতলা পঞ্চায়েত সমিতির জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ অরিজিৎ দত্তের কথায়: “এলাকার সমস্যাটা খুব গভীরে। ঠাকুরপুকুর-জোকা অংশে যখন চড়িয়াল খালকে মূল নিকাশি খাল হিসেবে ভাবা হচ্ছে, তখন বিষ্ণুপুর-বজবজ অংশে এই খালকেই সেচ খাল হিসেবে বলা হচ্ছে। চাষের জমিতে খাল কেটে সেচের জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ও দিকে খালের হুগলি নদীর অংশে নদীর নাব্যতা কম থাকায় জোয়ারের জল যাতে খালে না ঢোকে, সে জন্য প্রত্যেকটি লকগেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর খালের জল বেরোতে পারে না। জমে থাকে।” অরিজিৎবাবু বলেন, “জোকা ও বসিরহাট রোড অংশে এই খালের উপর দু’টি ব্রিজ বানানো হয়েছে। ব্রিজগুলি এমনিতেই নিচু। আর টেলিফোন লাইন, জলের লাইন, বিদ্যুতের লাইন সব এই ব্রিজের নীচেই। জল এতেও বাধা পাচ্ছে। ফলে জল বেরতে না পেরে ভাসাচ্ছে। প্রশাসনকে অনেক বার জানিয়েও ফল হয়নি। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাঝেমধ্যে কচুরিপানা পরিষ্কারের চেষ্টা করি। ব্যস ওইটুকুই। টাকা পাই না বহু দিন। কাজ হবে কী ভাবে?”
যদিও পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষের সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সভাধিপতি তৃণমূলের শামিমা শেখ বললেন, “ওঁরা ভুল কথা বলছেন। বিভিন্ন খাতে বহু টাকা ওঁরা খরচই করেননি। সেই টাকা ব্যবহার করে কেন নিকাশি বা উন্নয়নের কাজ করছেন না? আমরা জোকাকে আলাদা ভাবে দেখি। ওই পঞ্চায়েত এলাকার জন্য ইতিমধ্যেই জেলা পরিষদ বহু রাস্তা বানিয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে সাংসদ কোটার বহু টাকাও। ওঁরা বিভিন্ন খাতের টাকা খরচ করে বলুন, উন্নয়ন করার পরে টাকা নেই। আমরা আবার টাকা দেব। কলকাতা পুরসভার সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট সমন্বয় আছে। ওরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছে।’’
রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘জোকাকে কলকাতা পুর এলাকায় আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কলকাতা পুরসভায় এলে এডিবি-র টাকায় দ্বিতীয় পর্যায়ে যে নিকাশির কাজ শুরু হবে সেখানে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তখন পুরো নিকাশি ব্যবস্থাই ঢেলে সাজা হবে। এই মুহূর্তে অত বড় গ্রামীণ এলাকার নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজার মতো অর্থ বা পরিকল্পনা নেই।”

ছবি: পিন্টু মণ্ডল

Previous Story

Kolkata

Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.