|
|
|
|
রুজির টানে জীবনের আগুনে পুড়ে খাঁটি বঙ্গের ‘বিশ্বকর্মারা’ |
অনিন্দ্য জানা • মুম্বই |
কত বড়?
কত আর? মেরেকেটে সাত বাই বারো হবে! দু’পাশে সার দেওয়া নিচু নিচু টেবিল। টেবিলও কি? বরং টুলই বলি। তার সামনে মেঝের মাদুরের উপর বসা কিছু চেহারা। বয়সে তরুণ। এক হাতে ব্লোয়ার থেকে গনগনে হল্কা বেরোচ্ছে। তার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সোনা।
অন্য হাতে সন্না। টুলের উপর দক্ষ হাতের কারিকুরিতে ফুটে উঠছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশা। চুলের মতো। দেখলে তাক লাগে।
ঘরের এক কোণায় একটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন এলসিডি। তার তলার র্যাকে টিনের কৌটো। চা বানানোর সরঞ্জাম। পুঁচকে জানলা দিয়ে বাইরের একফালি আলো দেখা যায়। ভিতরের টিউবলাইট জ্বলে ঝকঝক করে। ঘরের কোলাপসিব্ল গেটটায় তালা-মারা। ভিতরে ঘাড় গুঁজে একমনা শরীর। কেউ হুগলি। কেউ হাওড়া। কেউ মেদিনীপুর।
নাম? নাম কী?
সুরজিৎ মাইতি, অনুপ মণ্ডল, অভিজিৎ পাঁজা, সুরজিৎ পাঁজা, অরূপ মণ্ডল, সঞ্জীব মণ্ডল, রবীন বউড়ি... এমন আরও আরও কত!
আর ঠিকানা? |
|
ব্যারিকেডের পাশ কাটিয়ে চলছে সাইকেল। মুম্বইয়ের জাভেরি বাজারের বিস্ফোরণস্থলে। শুক্রবার এপি-র ছবি। |
জাভেরি বাজারের ৭৯ নম্বর সুতার চাল। থার্ড ফ্লোর। রুম নম্বর ১৩। জামা মসজিদের কাছে।
মুম্বইয়ের বঙ্গজগতের এক টুকরো। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। ভিতরে আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সোনা। মাতৃভাষার আগন্তুককে তালা খুলে ভিতরে নিয়ে গেলেন হুগলির খানাকুলের সুরজিৎ। বাইরে থেকে এনে দিলেন সম্মানজনক স্টিলের টুল। হোক না গর্তের মতো আস্তানা। বহিরাগত অতিথি এসেছেন। তাঁকে যত্নআত্তি করতে হবে তো। টুলে বসিয়ে স্পেশ্যাল চা আর সঙ্গে বিস্কুটের অর্ডার দিয়ে বললেন, “ভয় তো লাগেই। কিন্তু করবটা কী? রুজির ধান্দায় এখানে এসেছি। থাকতে তো হবেই। দেশে গিয়ে কী কাজ করব? ওখানে কাজ পাইনি বলেই না এখানে আসা। দেশে ছায়া আছে। মায়া আছে। কিন্তু পেটের ভাতটা তো এখান থেকেই জোটে। বাড়িতে টাকা পাঠাই। বছরে এক বার, দু’বার ঘুরে আসি গিয়ে।”
কথা বলতে বলতেই হাত চলছিল। কেউ সাত। কেউ দশ। এমনও আছেন, যাঁদের এই জাভেরি বাজারে সোনার কাজে কেটে গেল জীবনের পঁচিশ, তিরিশ বা তারও বেশি বছর। অধিকাংশই এখনও ব্যাচেলর। রাতে একসঙ্গে হইহই করে সিনেমা দেখতে যান। হোলির দিন হুল্লোড় করেন। গান চালিয়ে নাচেন। প্রজাতন্ত্র দিবসের রক্তদান শিবিরে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসেন। আবার পুলিশের হাতে ‘হফতা’ও দেন বিনা বাক্যব্যয়ে। তিতকুটে গলায় বলেন, “পাঁচ টাকা-দশ টাকা নিয়ে চলে যায়! ওরা আবার আমাদের কী বাঁচাবে!”
কৈশোর থেকে তারুণ্যে পৌঁছতে না-পৌঁছতে চেনাশোনা ধরে এই জাভেরি বাজারে এসে পড়া। কাজ শিখতে শিখতে দেড় থেকে দু’বছর। প্রথমে ভুলভাল। ‘শেঠে’র বকুনি খেতে খেতে দড় হওয়া। বড় হওয়াও বটে। ক্রমশ পাকা হয়ে-ওঠা হাত। তার পর পুরোদস্তুর কারিগর। সোনা পুড়িয়ে পুড়িয়ে অবিশ্বাস্য সমস্ত নকশা তৈরি। পাশে ড্রয়িং রেখে সাদা পাতায় কালো কালির ডিজাইন হুবহু তুলে-আনা। কঠিন কাজ তো? “অভ্যেস হয়ে যায়। এক বার ধরে নিতে পারলে আর কঠিন নয়। না-জানলে তো সব কাজই কঠিন”, বলেন তাঁরা। তার পর দেওয়ালে বিশ্বকর্মার বাঁধানো ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন, “উনিই আমাদের দেবতা। ইস্কুলে যেমন সরস্বতী ঠাকুর। আমাদের তেমনই বিশ্বকর্মা। কিন্তু আমরা একেক জন যা সূক্ষ্ম কাজ করার ক্ষমতা রাখি, মনে হয়, বিশ্বকর্মাও পারবেন না!”
যে ঘরে কাজ, সেখানেই খাওয়া-পরা-শোওয়া। এই জাভেরি বাজারে কাজ করতে করতেই ২০০৩ সালের বোমা বিস্ফোরণ দেখেছেন কেউ কেউ। কারও জীবনে গত পরশুই প্রথম। অরূপ যেমন। বলছিলেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছে বোধহয়। কিংবা কোনও বাড়ি বৃষ্টিতে ধ্বসে পড়েছে। এত পুরনো পুরনো বাড়ি সব। তারপর নীচে গিয়ে দেখলাম, একের পর এক লাশ নিয়ে যাচ্ছে। তখন বুঝলাম, বোমা ফেটেছে!”
তার পর? “তার পর আর কী? খুব দৌড়োদৌড়ি শুরু হল চারদিকে। আমরাও গেলাম দেখতে”, বললেন হাওড়ার ঝিকরার বাসিন্দা অরূপ। ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে এসে বসেছেন আরও কয়েক জন। তাঁদের মধ্যে এক জন ভারী চুপচাপ। “যে দোকানের সামনে বিস্ফোরণ হয়েছিল, ও সেই দোকানের সামনেই ছিল। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে। তারপর পালাতে গিয়ে জামা-টামা ছিঁড়ে ফিরেছে। এত ভয় পেয়েছিল যে, গোটা একটা দিন প্রায় কোনও কথা বলতে পারেনি। বোবা হয়ে গিয়েছিল!” খানাকুলের রবীনকে দেখিয়ে বললেন সুরজিৎ। তার পর জানালেন, ঘটনার পর সেলফোনের টাওয়ার ‘পালিয়ে’ যাওয়ায় বাড়ির সঙ্গেও কোনও যোগাযোগ করতে পারেননি। সেই সময়ে বাড়ির লোকেরা প্রচণ্ড চিন্তায় ছিলেন। আপাতত অবশ্য পরিজনরা স্বস্তিতে। তাঁদের বলা হল না, বিস্ফোরণের পর মিনিট পনেরো সেলফোনের সিগন্যাল লোপাট হয়ে তাঁর গোটা রাজ্যপাটের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণও!
বিস্ফোরণের পর প্রথম অভিঘাতে অনেকে ভেবেছিলেন, বাড়ি ফিরে যাবেন। অনেক হয়েছে। আর নয়। জাভেরি বাজারের অধিকাংশ বঙ্গসন্তানও তেমনই ভেবে বসেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বোধ ফিরতে এখন বুঝতে পারছেন, নাচার তাঁরা। এখানেই থাকতে হবে। উপায় কী? অনুপ যেমন বলছিলেন, “যতক্ষণ এই ঘরে বসে কাজ করি (বেলা ১১টা থেকে রাত ১২টা। দুপুরে কয়েক ঘণ্টার বিশ্রাম সহ), ততক্ষণ কোনও চিন্তা নেই। বাইরে বেরোলে বিপদ হতে পারে। কিন্তু সে তো রাস্তায় বেরোলে গাড়িচাপাও পড়তে পারি! জন্ম-মৃত্যু সব উপরওয়ালার হাতে। জন্মেছি যখন, মরতে তো হবেই। যার যখন সময় আসবে, তখন যেতে হবে। আর ফিরে কী করব?” তাঁর সঙ্গে সায় দেন বাকিরা, “প্রথম প্রথম খুব ভয় পেয়েছিলাম। তার পর ভাবলাম, যা হবে দেখা যাবে। পালাব কেন?” তার পর একগাল হেসে বলেন, “বাড়ি ছেড়ে আসার সময় যেমন কষ্ট হয়, তেমনই এখান থেকে ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময়েও খুব খারাপ লাগে। ভাবি, কত দিনে ফিরে আসব!” টুল থেকে মাথা তুলে এক জন বলেন, “বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি জানেন তো? আমাদের এটা হল শ্বশুরবাড়ির মতো। বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু স্বামীকে ছেড়ে আবার বেশি দিন থাকতেও ইচ্ছে করে না।”
পলিপ্যাকে ভরে-আনা চা নিজেদের জন্য প্লাস্টিকের কাপে ঢেলে অতিথিকে সাম্মানিক কাপ-প্লেটে ঢালতে ঢালতে এক জন সিরিয়াস গলায় প্রশ্ন করেন, “দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) তো ফাটিয়ে দিচ্ছেন! প্রচুর কাজ করছেন। যখন-তখন যেখানে-সেখানে চলে যাচ্ছেন। লোককে খুব খাটিয়ে নিচ্ছেন। কী মনে হয়? শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারবেন? রাজ্যের হাল বদলাতে পারবেন? চাকরি-বাকরি কিছু হবে? আমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা হলে তো ফিরে যেতে পারি।” পাশ থেকে রসিকতা করেন বন্ধু, “আরে! জাভেরি বাজারে সোনার কাজ করি বলে আমাদের সঙ্গে লোকে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না! একে তো বাইরে থাকি। তারপর এখন ভাববে, কবে বিস্ফোরণে উড়ে যাবে! কী দরকার বাবা!”
হা হা হাসিতে উড়ে পালায় সাত বাই বারোর অন্দরের গুমোট আবহাওয়া। মনে হয়, চোখের সামনে জীবন-মৃত্যু আর প্রতিদিন লড়তে লড়তে বাঁচাই বোধহয় মানুষকে এতটা দার্শনিক করতে পারে।
বাইরে বিস্ফোরণের আপাত-আতঙ্ক।
এক আপাত-নিশ্চিন্ত বর্তমানের পিছনে দ্রুত ধাবমান ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
দেওয়ালে নির্নিমেষ বিশ্বকর্মা।
ভিতরে জীবনের আগুনে পুড়ে পুড়ে খাঁটি মানবজমিনের সোনা। |
|
|
|
|
|