|
|
|
|
স্কুটার মালিকের সন্ধানে গুজরাত পাড়ি গোয়েন্দাদের |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
একটি স্কুটার। যার ‘চেসিস’ নম্বরটি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
একটি ই-মেল। পশ্চিম এশিয়ার কোনও দেশ থেকে যেটি পাঠানো হয়েছিল।
তিনটি ঘটনাস্থলের ক্লোজ্ড সার্কিট টিভি ক্যামেরা থেকে পাওয়া ১১টি সিডি-ভর্তি ছবি।
মুম্বই বিস্ফোরণের দু’দিন পরেও তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বা মুম্বই-পুলিশের কাছে বড়াই করে বলার মতো বিষয় এটুকুই! অথচ গোটা ঘটনার তদন্তে ১২টি দল তৈরি হয়েছে! ইতিমধ্যেই জাভেরি বাজারে যে স্কুটারের ডিকিতে করে বোমা আনা হয়েছিল, সেটি চিহ্নিত করতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। স্কুটারটির চেসিস নম্বর নষ্ট করার চেষ্টা হলেও সেটি উদ্ধার করা গিয়েছে। আর সেই সূত্রেই স্কুটার মালিকের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু স্কুটারটি হাতবদল হয়েছিল না আসল মালিকের থেকে চুরি করে আনা হয়েছিল, তা নিয়ে এখনও সন্দেহ রয়েছে। মন্ত্রক সূত্রের খবর, স্কুটারের আসল মালিক গুজরাতের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। তার সন্ধানে এনআইএ-র একটি দল আমদাবাদ রওনা দিয়েছে। |
|
এ ধরনের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করেই ঘটানো হয়েছিল বিস্ফোরণ। শুক্রবার মুম্বইয়ের দাদরে। এএফপি |
অবশ্য আরও একটি বিষয়ে নিশ্চিত গোয়েন্দারা। তা হল, মুম্বইয়ের ঘটনায় মানব-বোমা ব্যবহার করা হয়নি। জাভেরি বাজারে বিস্ফোরণস্থলের কাছেই এক ব্যক্তির দেহে ইলেকট্রিক সার্কিট মেলায় মানব-বোমার তত্ত্ব সামনে এসেছিল। আজ ময়না-তদন্তে দেখা যায়, দেহে ঢুকে থাকা বস্তুটি আদতে একটি ধাতব টুকরো। দেহের মালিককেও শনাক্ত করা গিয়েছে। তাঁর নাম গুমান সিংহ রাঠৌর।
কিন্তু মূল তদন্ত? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষকর্তারা বলছেন, তদন্তের ধারাবিবরণী দিয়ে চলা সম্ভব নয়। সে জন্যই নির্দিষ্ট কোনও তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা হবে না। তবে তাঁরা এটাও মানছেন, মুম্বই বিস্ফোরণের কিনারা হতে এখনও অনেক দেরি। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তদন্তে মূলত দু’টি বিষয় বারবার খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এক, বিস্ফোরণের সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন তো বটেই, লস্কর বা অন্য কোনও পাক জঙ্গি সংগঠনের যোগ আছে কি না। দুই, মুম্বইয়ের মাফিয়াচক্র বা ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’-এর যোগাযোগ আছে কি না। আবার জঙ্গিদের সঙ্গে মাফিয়া-যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।
বুধবারের ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পিছনে সীমান্তপার তথা পাকিস্তানের কোনও সংগঠনের যোগ যে আছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে একটি ই-মেল থেকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহ বলেন, “আমাদের কাছে একটি ই-মেল এসেছে, যার উৎস দেশের বাইরে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” ওই ই-মেলে কী রয়েছে, তা নিয়ে এখনই সরকারি ভাবে কেউ মুখ খুলতে নারাজ। তবে মন্ত্রক সূত্রের খবর, এই ই-মেলে কোথাও ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের নাম নেই। সূত্রের খবর, ই-মেলে বিস্ফোরণের দায় স্বীকারের পাশাপাশি দাবি করা হয়েছে, কেন্দ্র পৃথক তেলেঙ্গানা গঠন করছে না বলেই এই বিস্ফোরণ! পশ্চিম এশিয়ার কোনও দেশ থেকে ই-মেলটি পাঠানো হয়েছে। তদন্তকারীরা নিশ্চিত, তেলেঙ্গানার বিষয়টি সরকারকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। ই-মেলের উৎস খুঁজে বের করতে সাইবার-বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো হয়েছে। বিস্ফোরণের পরে জঙ্গিরা মোবাইলে বা টেলিফোনে নিজেদের মধ্যে কথা বলেছিল ধরে নিয়ে ওই সময় ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে ফোনে কথাবার্তার রেকর্ডও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। |
|
মুম্বইয়ে বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে রাঁচির স্কুল পড়ুয়ারা। পিটিআই |
এ ছাড়া তদন্তকারীদের সহায় বলতে সিসিটিভি থেকে পাওয়া ছবি। স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, “সিসিটিভি-র ফুটেজ খতিয়ে দেখা যথেষ্ট সময়সাধ্য কাজ। তিনটি ঘটনাস্থল থেকে এগারোটি সিডি-ভর্তি ছবি হাতে এসেছে। যাদের মুখ দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কারা স্থানীয় বাসিন্দা আর কারা বাইরের লোক, তা স্থানীয় মানুষকে দিয়ে শনাক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে।” অপেরা হাউসের বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে একেবারে ঘটনাস্থলের উপরেই ক্লোজ্ড সার্কিট টিভি ক্যামেরা ছিল বলে মুম্বই-পুলিশের কর্তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে ওই ক্যামেরার ছবি থেকে যথেষ্ট তথ্য মেলার আশা করছেন গোয়েন্দারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনেক কর্তা বুধবারের ঘটনায় ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সঙ্গে মুম্বইয়ের মাফিয়াচক্রের যোগ থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “এই দিকটি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনও হতে পারে, দাউদ ইব্রাহিমের ডি-কোম্পানির সদস্যরা জঙ্গিদের সাহায্য করেছিল। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সৌদি আরবের বেশ কিছু স্যাটেলাইট ফোন ও মোবাইলে নজরদারি করা হচ্ছে। ডি-কোম্পানির সঙ্গে যোগ আছে সন্দেহে কয়েক জনের ফোনে আড়িও পাতা হচ্ছে।” ওই কর্তার বক্তব্য, সম্প্রতি সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে খুনের ঘটনা ও তার আগে দাউদের ভাইয়ের গাড়ির চালকের উপর গুলির ঘটনায় ইঙ্গিত মিলেছে, ডি-কোম্পানি তথা মাফিয়াচক্র আবার মুম্বইয়ে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন ও সিমি-সদস্যদের সন্ধানে ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়েছে এনআইএ। আজ রাঁচিতে এক প্রশিক্ষিত সিমি-সদস্যের খোঁজে হানা দেন এনআইএ-র অফিসাররা। তবে তাঁর সঙ্গে মুম্বই-বিস্ফোরণের সরাসরি যোগ নেই বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি। মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি গুজরাত ও রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গাতেও সিমি ও আইএম-সদস্যদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, নাশকতার ঘটনায় নিজেদের আড়াল করতেই আইএসআইয়ের নির্দেশে লস্কর-ই-তইবা ভারতে ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’ গড়েছে। যারা ভারতেই জঙ্গি নিয়োগ করে ভারতেই নাশকতা চালাবে। গোয়েন্দাদের পরিভাষায় এটা ‘করাচি প্রজেক্ট’। মুম্বই হামলার সঙ্গে এই ‘করাচি প্রোজেক্ট’-এর যোগ খুঁজে পাওয়াটাই এই মুহূর্তে গোয়েন্দাদের কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
আজ দিল্লিতে আফগানিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারহানউদ্দিন রব্বানির সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর বৈঠক হয়েছে। সূত্রের খবর, আলোচনায় রব্বানি স্পষ্ট জানিয়েছেন, পাক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে এখনও সক্রিয় রাখার ব্যাপারে আইএসআইয়ের ভূমিকা কিন্তু থেকেই গিয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের আসন্ন সফরেও মুম্বই প্রসঙ্গ উঠবে বলে সরকারি সূত্রের খবর। তার আগে এই ঘটনার সঙ্গে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের যোগসূত্র খুঁজে বের করতে চাইছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। যাতে আমেরিকার হাতেও সেই প্রমাণ তুলে দেওয়া যায়। প্রমাণের অভাবে মুম্বই-বিস্ফোরণের তদন্তও সেই পথে হাঁটবে কি না, এখন সেটাই সবথেকে বড় প্রশ্ন। |
|
|
|
|
|