|
|
|
|
‘হীরক রাজ্যে’ হরতাল, এখনও মিলছে ছিন্ন দেহ |
অনিন্দ্য জানা • মুম্বই |
খবর কী আজ?
কেন? মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের দখল নিতে নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার এবং নির্বাচক দিলীপ বেঙ্গসরকর এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিলাসরাও দেশমুখ। এটাই!
ব্যস! এই এক লাইন লিখেই আজকের মুম্বই-কভারেজ শেষ করে দেওয়া যায়। খামোখা মূল্যবান নিউজ-প্রিন্ট নষ্ট করে লাভ কী?
এবং করা যায় না!
যায় না, কারণ লিখতে হয়, ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ৪৮ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও কী অসম্ভব দিশেহারা দেখাচ্ছে মুম্বই পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি)-কে। লিখতে হয়, ‘যা তথ্য পাওয়া যাবে, নিয়মিত সংবাদমাধ্যমকে জানানো হবে’, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের এই অমোঘ আশ্বাসবাণী সত্ত্বেও আজ সংবাদমাধ্যমের সামনে এলেনই না এসআইটি-র প্রধান রাকেশ মারিয়া। লিখতে হয়, মুম্বইয়ে বর্ষার মেঘ কেটে গিয়ে আজ খানিক রোদ্দুর উঠলেও বিস্ফোরণের তদন্তাকাশ এখনও ঘোর মেঘাচ্ছন্ন। |
|
শোকের ‘বন্ধ’: বিস্ফোরণের পর নিহতদের স্মরণ করে বন্ধ রয়েছে অপেরা হাউসের হিরের বাজার। রয়টার্স |
এখনও কাউকে গ্রেফতার তো দূরস্থান, কোনও ‘আটক’ও নেই! কোনও প্রামাণ্য ‘লিড’ নেই। অন্যান্য বার যেমন বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে ঝটপট ই-মেল পাঠিয়ে দেয়, এ বার এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি যে, কারও ঘাড়ে দায় একটা চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসা যাবে। যে সিসিটিভি ফুটেজের উপর অগাধ বিশ্বাস রেখে বসেছিলেন কর্তারা, ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, আস্ত গন্ধমাদন। বিশল্যকরণী খুঁজে বার করতে গেলে যে সময় লাগবে, তাতে রোগী নির্ঘাত মারা যাবে। সমস্ত ফুটেজ মিলেমিশে মোট ১১টা সিডি হয়েছে। সেগুলোও যথেষ্ট ঝাপসা। তার ওপর আবার তাতে ধরা রয়েছে হাজার হাজার চেহারা। কোথা থেকে কী বেরোবে! কে স্থানীয়, কে বা কারা বহিরাগত, কারা বলবে? হেদিয়ে মরছে পুলিশ। আমতা আমতা করে বলা হচ্ছে, “ওই সমস্ত ফুটেজ নিয়ে স্থানীয় মানুষের কাছে যাওয়া হবে। তাদের দেখিয়ে জানার চেষ্টা করা হবে, কোন কোন অচেনা মুখ রয়েছে সেখানে।” মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ সংবাদ চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমরা ব্যাপারটা একেবারেই বুঝতে পারিনি। তৈরিও ছিলাম না। গোয়েন্দা-তথ্য তো সব সময়েই আসতে থাকে। এ বছরই এখনও পর্যন্ত দেড়শোটা এসেছে। বিশ্বকাপ ফাইনালের সময়েও রোজ আসত। কিন্তু নির্দিষ্ট করে তো কিছু বলা হয়নি। যেগুলো এসেছে, সেগুলো সবই খুব রুটিন ধাঁচের।” আরও বলেছেন, “বিশেষ তদন্তকারী দল তদন্ত করছে। কোনও একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দিকে আঙুল তোলা যাচ্ছে না। তুলতে চাইছিও না আমরা। তদন্তকারীরা সমস্ত কিছুই খতিয়ে দেখছেন। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। তবে যা হচ্ছে, সব তো বল-বাই-বল কমেন্ট্রি করা সম্ভব নয়। এটা একটা সময়সাপেক্ষ এবং যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি।”
সত্যিই তো! তদন্তের ধারাবিবরণী দেওয়া যাবে কী করে? কী বলা হবে? ওহে শুনছেন, গত কাল যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, আজও সেখানেই আছি? কোথাও এক ছটাক আলোও দেখা যায়নি। বরং ‘আত্মঘাতী’ হামলার যে তত্ত্ব গত কাল ছাড়া হয়েছিল, আজ সেটাও গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঠিকই তো! ‘আত্মঘাতী’ হামলা হলে সেটা এমন সব সাধারণ লোককে মারতে হবে কেন! সে তো অনেক বড় ব্যাপার।
বস্তুত, পুলিশের একাংশ প্রাথমিক ভাবে মনে করছে, এটা নিছকই কোনও ‘অপেশাদার’ লোকের কাজ। পেশাদার কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী হলে এতক্ষণে ‘দায়’ স্বীকার করে নিত। এবং তিনটেতেই থেমে যেত না। কিন্তু এটা প্রকাশ্যে বলবে কে। মানসম্মান তো আরও যাবে। কথা উঠবে, অপেশাদারদেরই মোকাবিলা করতে পারে না, কড়া জঙ্গি মোকাবিলা করবে কী করে এই অপোগণ্ড প্রশাসন!
অতএব খুব কৌশলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ‘খবর’। বিস্ফোরণের পর ফোনে আড়ি পেতে অমুক অমুক কথা শোনা গিয়েছে। তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ‘সূত্র’ পাওয়া গিয়েছে। যা বলছে, এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্ধ্রপ্রদেশের একটা যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। আর হ্যাঁ, যে স্কুটারে বিস্ফোরক রাখা ছিল, সেটা শনাক্ত করা গিয়েছে। তা ছাড়া? তা ছাড়া যা বলা হচ্ছে, তার নির্যাস অমুক জায়গা থেকে তমুক জায়গায় ই-মেল এসেছে। সেগুলো ঘেঁটে দেখা হচ্ছে। বা, ফরেন্সিক তদন্ত রিপোর্ট বলছে, বিস্ফোরণে আরডিএক্স নয়, ব্যবহৃত হয়েছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং টিএনটি (যেন এটা কাল জানা ছিল না!)। যা থেকে মনে হচ্ছে, বিস্ফোরণের পিছনে থাকলেও থাকতে পারে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। এমনকী, এমনও বলা হচ্ছে, তিনটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পিছনে থাকলেও থাকতে পারে মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ড-খ্যাত দাউদ ইব্রাহিমের হাত! |
|
সূত্রের খোঁজ চলছে অপেরা হাউসের কাছে। পি টি আই |
শেষেরটা শুনে ঝপ করে মনে পড়ল সাংবাদিক মহলে চালু মুশকিল-আসানটা মুম্বইয়ে কোনও ঘটনার দিশা না-পাওয়া গেলেই আরামসে দাউদের নাম লিখে দাও! খবরের কাগজে বেরোনো কোনও রিপোর্টের প্রতিবাদ (পরিভাষায় যাকে বলে, রি-জয়েন্ডার) দাউদ করেছে, কখনও শোনা যায়নি!
রসিকতা থাক।
বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আর তা বোঝা যাচ্ছে জাভেরি বাজার বা অপেরা হাউস এলাকায় বিস্ফোরণের জায়গায় গেলে। আজ সেখানে বুলডোজার নেমেছে। এবং জাভেরি বাজার থেকে উদ্ধার হয়েছে আরও একটি মৃতদেহ। বিস্ফোরণের তীব্রতায় উড়ে গিয়ে একটি বাড়ির চারতলায় আটকেছিল। রাত পর্যন্ত সেটি শনাক্ত হয়নি।
বোঝা যাচ্ছে অপেরা হাউসে হিরে ব্যবসায়ীদের ডেরায় গেলে। ক্ষোভ এবং ক্রোধের গনগনে আগুন জ্বলছে সেখানে। সারা বিশ্বের মধ্যে এটাই নাকি বৃহত্তম ‘ডায়মন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং’ বাজার, দাবি এখানকার ব্যবসায়ীদের। হলেও হতে পারে। পঁচিশতলা একটা বাড়িতে সার সার হিরের দোকান। আজ সব বন্ধ। গত দু’দিনের মতো। বন্ধ থাকবে আগামী রবিবার পর্যন্ত। যার ফলে লোকসান হয়ে যাচ্ছে নাকি কয়েক হাজার কোটি টাকা। সে বাড়িতে অবশ্য ঢোকা গেল না।
কড়া পাহারা বসেছে বিস্ফোরণের পর। জাভেরি বাজারের ‘খাউ গলি’র একপ্রান্তে বাড়িটার নামই ‘দ্য জুয়েল’। হিরে-টিরের মতো দামী জিনিস নিয়ে ব্যবসা করলে একটু লুকোছাপা থাকবে, এটাই দস্তুর। কিন্তু এখানে হিরের ব্যবসা হয় হাতে হাতে। এমনকী, সামনের গাছতলাতেও। আদতে কলকাতার বড়বাজারের বাসিন্দা, ১৯৯০ সাল থেকে মুম্বই-নিবাসী অনিল জৈন যেমন বলছিলেন, “আগে এই পঁচিশ তলার মধ্যে আটটা তলায় বসত ছিল। এখন মাত্র ৫
শতাংশ জায়গায় আছে। বাকি বাড়ি জুড়ে হিরের ব্যবসা। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।”
সে ব্যবসা যে ভাবে হয়, শুনলে অবাক লাগে। জামার তলায় ‘বেনিয়ান’-এর ইনসাইড পকেটে মিছরির মতো মুঠোমুঠো হিরে ভরে নিয়ে চলাফেরা করেন ব্যবসায়ীরা। বিদেশ থেকে খদ্দের আসে। তারা কে জানে কী ভাবে নিয়ে যায় হিরে কিনে! মুম্বই ডায়মন্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ভরত শাহ বলছিলেন, “বিস্ফোরণের পর হুড়োহুড়ি করে পালাতে গিয়ে আর ঝাঁকুনিতে অন্তত ২৫ কোটি টাকার হিরে হাপিস হয়ে গিয়েছে।” শুনলে তাক লেগে যায়! শাহ যা বললেন না, সেটা সন্তর্পণে এবং গোপনে গোপনে বলছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ বিস্ফোরণের পর এলাকার দখল নিতে গিয়ে পুলিশের একাংশ মাটিতে পড়ে থাকা হিরের টুকরো তুলে নিয়ে পকেটে পুরেছে!
সম্ভবত সেই জন্যই তাঁরা হিরের বাজারে পুলিশি নিরাপত্তার বদলে ‘নিজস্ব নিরাপত্তা’ বহাল করার দাবি তুলেছেন। তাঁদের সাফ বক্তব্য, “পুলিশ-টুলিশ দরকার নেই। আমাদের নিরাপত্তাটা আমরাই দেখে নিতে পারব।” তাঁদের দাবি আরও দু’টি। এক, এলাকায় বেআইনি পার্কিং বন্ধ করতে হবে। যেখানে সেখানে গাড়ি এবং মোটরসাইকেল পার্ক করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, এলাকার সমস্ত বেআইনি হকার উচ্ছেদ করতে হবে। কাল এই তিনটি দাবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে বৈঠকও ডেকেছেন তাঁরা।
তবে আপাতত ‘হীরক রাজার দেশে’ লক-আউট। যেমন তালা ঝুলছে মুম্বই পুলিশের মুখে।
তদন্তেও আপাতত লক-আউট ঘোষিত হয়েছে যে! |
|
|
|
|
|