বেড়ানো ২...
হাতে আল্পসের বরফ
খানকার ছোট্ট শহর মন্টহোভেনেই তো শাহরুখ পেয়েছিলেন তাঁর ‘দুলহনিয়া’ কাজলকে। এখানেই শাহরুখ খুঁজেছিলেন তাঁর ‘কিরণ’ জুহি চাওলাকেও। এ দেশের ব্যাঙ্কেই বিশ্বের ‘বিখ্যাত’ লোকেরা জমা রাখেন তাঁদের কালো টাকা। আবার এ দেশ থেকেই বিশ্ব ফুটবলকে নিয়ন্ত্রণ করে ফিফা।
স্বাগত সুইৎজারল্যান্ডে। মাটির বুকে স্বর্গ। সঙ্গে নিতে হবে টি-শার্ট, স্নিকার্স, যথেষ্ট গরম জামা। ব্যস! আপনার আল্পসে চড়া আটকায় কে?
স্বর্গই তো! লন্ডন থেকে সুইৎজারল্যান্ডের বাসিল শহরে নামার পরে বুঝলাম, প্রকৃতির মধ্যেও এক জন ভ্যান গগ লুকিয়ে আছেন। সীমান্তশহর বাসিল রাইন নদীর তীরে। বাসিলের একটা দারুণ মজা আছে। এক দিকে ফ্রান্স, অন্য দিকে জার্মানি। ইচ্ছে করলে আপনি বাসিলে প্রাতরাশ করে, ফ্রান্সে কফি খেয়ে, জার্মানিতে গিয়ে বার্গারে এক কামড় দিয়ে ফের বাসিলে ফিরে দুপুরের খাবার খেতে পারেন! বাসিল যাওয়া মানে এক ঢিলে তিন পাখি সুইৎজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি।
বাসিলে পৌঁছে আমি আর আমার সফরসঙ্গী ভাস্কর রায় প্রথমেই গেলাম তিন ভূখণ্ডের মিলনস্থল ‘দ্রাইল্যান্দারএক’-এ। তিনটে দেশের পতাকা উড়ছে সেখানে। রাইন নদীর উপরে একটা ছোট সেতু, ‘ইউরো সেতু’। তার এক দিকে ফ্রান্স, অন্য দিকে জার্মানি। হোটেল থেকে পাওয়া সৌজন্যমূলক টিকিট নিয়ে ট্রামে চড়ে রাইন নদী পেরিয়ে পৌঁছলাম গাঢ় সবুজ কৃষিখেত ভরা ফ্রান্সের ছোট্ট শহর সেন্ট লুই-এ। তার পর দেশবদল জার্মানি। সেখানে একটা পার্কে
এক চক্কর ঘুরে ফের সুইৎজারল্যান্ডে। প্রথম ঝলকে এই হল সুইৎজারল্যান্ড। রোম্যান্টিকতার শেষ কথা। শান্ত, নিরাপদ। এ বার পুজোয় যেখানে যেতেই পারেন ইচ্ছে হলে।
কারণ যশ চোপড়ার প্রেমের দেশ এখন আর অধরা নয়। চেষ্টা করলে মধ্যবিত্তও ঘুরে আসতে পারেন। এই তো ঘুরে এলাম আমি। সম্প্রতি লন্ডনের হ্যারোতে টেকনো ইন্ডিয়া স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উদ্বোধনের পরে হঠাৎ আবার সেই ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিল। স্বর্গকে ছোঁয়ার ইচ্ছে। তার জেরেই পৌঁছে গেলাম সুইৎজারল্যান্ডের বাসিলে। হ্যাঁ, সুইৎজারল্যান্ড মানে কিন্তু স্রেফ জেনিভা-জুরিখ নয়। একটা দেশ কি আর মাত্র দু’টো শহরে শেষ হয়? আসল দেশটাকে তো চেনা যায় নাম-না-জানা জায়গাগুলোয় গেলে। সে জন্যই এ বারের সুইৎজারল্যান্ড সফরে আমি সচেতন ভাবে ‘হাই প্রোফাইল’ জায়গাগুলো থেকে দূরে থেকেছি। চলে গিয়েছি এমন সব জায়গায়, যেখানে বরফ মোড়া আল্পস আর অফুরান সবুজের সঙ্গে বেড়ানোর খরচটাও তুলনামূলক ভাবে কম। মাথাপিছু এক লাখ টাকাতেই হয়ে গিয়েছে এ বারের আল্পস দর্শন।
বাসিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কাজ সেরে বাসিলেরই বাসিন্দা, বহু পুরনো বন্ধু রাম মিত্রের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম সাইট সিয়িংয়ে। সে-ও এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। অসংখ্য চেরি গাছের মধ্যে দিয়ে পায়ে-চলা পথে রামদা নিয়ে গিয়েছিলেন অদ্ভুত এক নিরিবিলি জায়গায়। সন্ধের নরম নিভু নিভু আলোয় সেজেছে শহরতলি। গাছের পাতা পড়লেও যেন আওয়াজ শোনা যাবে। দূরে গরুর গলার ঢং ঢং শব্দ আর রাখালিয়া বাঁশির মৃদু সুর... আরে! এ তো আমার দেশের মতোই। সেখানেও তো এ ভাবেই গোধূলি নামে গ্রামে, গ্রামে... আজও। সেই আলো আঁধারিতে হঠাৎ নজরে এল এক বিশাল গাছের নীচে বেঞ্চিতে বসে এক নারী, একাকিনী। আশপাশে কোনও জনমানব নেই। সেই গোধূলি লগনে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, কিছু কথাও হয়েছিল... তবে ঠিকানাটা নিইনি। ইচ্ছে করেই।
বাসিল থেকে স্পিজ হয়ে যাওয়া যায় ইন্টারলাকেনেও। সেখানে আল্পসের কোলে হ্রদের সৌন্দর্য। স্পিজের পথও কত চমক নিয়ে অপেক্ষা করে আছে! রাস্তার দু’ধারে ফুলের মেলা, রংবাহারি টিউলিপের বেড। বিশাল এক লেককে ঘিরে ছোট্ট শহর। অস্তগামী সূর্যের আলোয় আল্পস যেন হোলি খেলায় মেতেছে। উঁচু টিলাতে এক প্রাচীন গির্জা দেখতে দেখতেই আকাশের রং গাঢ় হয়ে উঠল। চার পাশের পাহাড় হঠাৎই সেজে উঠল জোনাকির মতো আলোয়। আল্পসের মাথায় বসে গেল তারার মেলা।
স্পিজের হোটেলে রাত কাটিয়ে পর দিন সকালে রওনা দিলাম ইন্টারলাকেনের উদ্দেশে। পথের ধারে পাহাড় ঘেরা টলটলে জলের হ্রদ। ইন্টারলাকেন পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে দু’পা যাওয়ার পরেই দৃশ্যটা স্বপ্নের মতো। বাঁ দিকে ‘গ্র্যান্ড ভিক্টোরিয়া হোটেল’। ডান দিকে সবুজ মাঠের গা ঘেঁষে যত দূর চোখ যায় নীল আকাশের গায়ে বরফ ঢাকা পাহাড়। যেন তাদের ছোঁয়া যাবে, আদর করা যাবে। রোদ ঝলমলে দিন, তাই মাঠের ধারের বেঞ্চগুলোতে লোকজন রোদ পোয়াচ্ছে। হঠাৎই দেখা হয়ে গেল সেই মানুষটির সঙ্গে, যিনি ভারতীয়দের সুইৎজারল্যান্ড চিনিয়েছেন যশ চোপড়া স্বয়ং। ভিক্টোরিয়া হোটেলের গাড়িবারান্দার তলায় দু’টি ঘোড়ায় টানা গাড়ি। তবে কোনও নায়ক-নায়িকার দেখা মেলেনি। হোটেলে চা খেয়ে, স্যুভেনির শপ থেকে কিছু উপহার কিনে এ বার বাসিল ফেরার পালা। সেখান থেকে ওই দিনই ফ্র্যাঙ্কফুট। ফ্র্যাঙ্কফুট থেকে কলকাতায় ফেরা।
বাসিল থেকেই চাইলে যাওয়া যেতে পারে সুইৎজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন। রাস্তা এমন মসৃণ যে গাড়ির গতি ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার হলেও সমস্যা নেই। দু’পাশে ছোট ছোট জনপদ। কখনও রেললাইন, কখনও ঘন সবুজ গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় পথ চলেছে। তার মধ্যে হঠাৎই চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে জাগবে ঝকঝকে সাদা আল্পস পাহাড়। সে এক দুর্দান্ত দৃশ্য। সাদা আর সবুজে আঁকা। বার্নে গেলে এক বার ঢুঁ মারতেই হয় পার্লামেন্ট ভবনে। সেই ভবন থেকে নীচে তাকালে মনে হয় যেন সবুজ কার্পেটে মোড়া পার্লামেন্টের আশপাশটা। এতটাই পরিচ্ছন্ন চার দিক। তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে রাইন নদী। আর সামনে? আল্পসের তিন শৃঙ্গ আইগর, মঙ্ক ও ইয়াংফ্রাও। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে।
সেখানেও অপেক্ষা করে ছিল চমক। পার্লামেন্টের উল্টো দিকে শান বাঁধানো চত্বরটি লোকে লোকারণ্য। কেউ গাইছে, কেউ গিটার বাজাচ্ছে, কেউ বা রোদে পিঠ দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করছে। তার মধ্যেই আবার কয়েক জন তরুণতরুণী সুইস ভাষায় লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নীরবে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করে চলেছে। বিক্ষোভও এত শান্তিপূর্ণ হয়! তার পর আরও চমক। চত্বর পেরিয়ে সারি সারি খাবারের দোকান। হঠাৎ দেখি আমার আরও দুই সঙ্গী, নন্দদা ও সাইমন ষাট ছুঁই ছুঁই দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। পরে জেনেছিলাম, তাঁরা মন্ত্রিসভার বিশিষ্ট সদস্য! ভাবুন তো কলকাতার ডেকার্স লেনে আমাদের কোনও মন্ত্রী লাঞ্চ সারছেন। তাও সান্ত্রীবিহীন অবস্থায়!
এ যাত্রায় সুইৎজারল্যান্ডকে কিছুটা দেখলাম, কিছুটা চিনলাম, আবার নতুন করে অনেকটা ভালবাসলাম। তবে ইন্টারলাকেনের লেকের জলে মন কেমন করা নীল আকাশের যে ছায়া ভাসে, তাকে আমার ছোঁয়া হল না... তার জন্য আবারও ফিরতে হবে ওই মায়াবী দেশে।
আপনিও ঘুরে আসুন না।

কী ভাবে এগোবেন
বেড়ানোর খরচ: সাধারণ মানের হোটেল-লজ অনেক। স্পিজ লেকের চার পাশে চলনসই হোটেলের ভাড়া ভারতীয় টাকায় আড়াই-তিন হাজার। কোথাও কোথাও ডরমেটারিও আছে। হোটেল-লজে বছরের অনেক সময় ছাড় দেওয়াও হয়। এমনিতে ১০১ সুইস ফ্রাঁতে আরামদায়ক হোটেলে ঘর মিলবে। ইন্টারনেটে হোটেল বুক করলে আরও সস্তা হবে। সপ্তাহখানেক ট্যুরে চার জনের খরচ আনুমানিক দুই থেকে আড়াই লাখ। (এক সুইস ফ্রাঁ = আনুমানিক ৫৩ টাকা)
ঘোরাঘুরি: কোনও কোনও হোটেল যাতায়াতের জন্য সৌজন্যমূলক ট্রাম টিকিট দেয়। তাতে বাসিল-ফ্রান্স-জার্মানি চক্কর মারা যায়। শহরের প্রাণকেন্দ্র সুইস বি বি রেল স্টেশন থেকে শুরু করে পুরনো ও নতুন বাসিল শহরের প্রায় সবটাই মাত্র পাঁচ সুইস ফ্রাঁতে দেখে ফেলতে পারবেন। কলকাতা থেকে সপ্তাহে তিন দিন লুফ্থহানসার বিমান ফ্র্যাঙ্কফুট যায়। ফ্র্যাঙ্কফুট থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনে বাসিল দু’ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের পথ।
মাথায় রাখুন: সকালে গলায় জড়াবার জন্য হাল্কা কিছু রাখবেন। খুব হাওয়া দেয়। আর রাতে অবশ্যই হাল্কা সোয়েটার বা জ্যাকেট লাগবে। আর হ্যাঁ, সঙ্গে ছোট বাচ্চা থাকলে ঠান্ডা লাগতেই পারে। সুতরাং ওষুধপত্র সঙ্গে রাখুন।
আরও জানতে:
www.myswitzerland.com-এ লগ ইন করতে পারেন। এটা সুইস সরকারের পর্যটন দফতরের নিজস্ব ওয়েবসাইট।


কোথায় যাবেন ভাবছেন

• খরচ মাথাপিছু ৭০ হাজারের মতো। চার জনের পরিবার
আড়াই লাখ টাকা বাজেটে ঘুরে আসতে পারবেন।
• আল্পসের বরফ আপনাকে মাতাল করবে।
নিরাপত্তার কোনও সমস্যা নেই।
• রাস্তাঘাট দারুণ।

ছবি: সত্যম রায়চৌধুরী
Previous Item Patrika Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.