বেড়ানো ১...
ঈশ্বরের বাগান
ক কালে বাঙালির মধুচন্দ্রিমা, পুজো আর লোকদেখানো বেড়ানো ছিল কাশ্মীরে। কাশ্মীরের নারী ও প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে লম্বা আলোচনা চলত বাড়িতে বাড়িতে। বলা হত, কোনও মোগল সম্রাট নাকি উত্তর ও দক্ষিণে হিমালয় পর্বতশ্রেণিতে ঘেরা উপত্যকাটি দেখে গেয়ে উঠেছিলেন, ‘স্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা এখানে, এই এখানে, এখানেই।’
সদ্য-সদ্য ঘুরে এসে অবিরত মনে হচ্ছে এই কাশ্মীর আসলে অবিকল সেই কাশ্মীর, ঈশ্বরের বাগান। যেখানে ডাল হ্রদের শিকারা, হাউসবোটে লোকজন এখনও অধীর অপেক্ষায় থাকে বাঙালি ভ্রমণার্থীদের বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ এবং হেমন্তে। গোলাগুলির ভয়ডর কাটিয়ে কোলাকুলির মেজাজে কাশ্মীর; সোনায় সোহাগা হয় কাশ্মীরের সঙ্গে যদি পুজোয় বাঙালি জুড়ে নেয় যুদ্ধের স্মৃতিবাহী দ্রাস, কার্গিল ও লেহ্-লাদাখ। মনে আছে ষাটের দশকের একদম গোড়ায় পুজো রিলিজ শাম্মি কপূর, শর্মিলা ঠাকুরের ‘কাশ্মীর কি কলি’ দেখে বাঙালির হুড়োহুড়ি কাশ্মীরের দিকে ট্রেন ধরার জন্য। এ বছর বাঙালির সামনে বড় টোপ লেহ্ শহর থেকে ১৫০ কিমি দূরে, ভারত-চিন সীমান্তে বর্ণালির সাত রংয়ে ঝিলমিল প্যানগং হ্রদ, যে অপরূপ নিসর্গে তোলা হয়েছে আমির খানের মারকাটারি ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর শেষ দৃশ্যাবলি। আর একটা কথা। কাশ্মীরে ঘুরতে গেলে প্রথমেই নিরাপত্তা নিয়ে মনে একটা খচখচানি তৈরি হয় বাঙালির। আমাদের তেমন কিছুর মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে সাবধানের মার নেই। পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা
জরুরি। যে কোনও সময় দেখাতে হতে পারে।
তবে বাঙালি হোন আর যেই হোন, প্লেন বা ট্রেন থেকে জম্মুতে নেমে দেড় ঘণ্টার ট্রিপ করে এক বার কাটরা শহর পৌঁছনো চাই। কারণ এই কাটরা থেকে ছ’কিলোমিটার পথ পাহাড় ঠেলে উঠলেই সেই জয় মাতাদির লোকমান্য গুহা, যেখানে এক নয়, তিন-তিন দেবীর প্রতিষ্ঠা। মহাকালী, সরস্বতী, লক্ষ্মী। লোকে এক নামে ডাকে বৈষ্ণোদেবী। গুহাতে মূর্তি কিছু নেই, শুধু তিনটি পাথরপিণ্ডকে সাক্ষী রেখে এক বিমূর্ত উপাসনা। পাণ্ডাদের উপদ্রব নেই, কী দিলেন, না দিলেন দেখার কেউ নেই। কারও মঙ্গল কামনায় চুনরি চড়াতে পারেন, তা ফিরে এলে সঙ্গে করে ফিরুন। আর সেই কামনায় দিনরাত হাজার হাজার নারীপুরুষের অবিরাম ওঠানামা। সে এক দৃশ্য বটে।
কাটরা থেকে হেলিকপ্টার নিলে ছ’কিমি দূরত্ব কমে দাঁড়ায় আড়াই কিলোমিটারে। কিন্তু হায় রে, ওই ছ’মিনিটের উড়ান যে কী আশ্চর্য এক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা, তা সারা জীবনের বিমানযাত্রার স্মৃতি দিয়ে বোঝা যাবে না। অশক্তদের জন্য আছে টাট্টু ও ডুলি। তবে পাকদণ্ডীর ছ’কিলোমিটার কিন্তু সমতলের চোদ্দো। ফেরার পথে কুয়াশা হয়ে হেলিকপ্টার বাতিল হওয়ায় চার কিমি হেঁটে ও দু’কিমি ঘোড়ায় চড়ে সেটা হাড়ে-হাড়ে, পেশিতে-পেশিতে টের পেয়েছি। অতএব বাঙালি, শরীর বুঝে, আবহাওয়া বুঝে এগোন। হেলিকপ্টার চড়া চাই।
কাটরা থেকে গাড়িতে রওনা হলাম কাশ্মীরের পথে। জম্মু ও কাশ্মীরের মাঝখানে সীমানা আসলে পাহাড় ফুঁড়ে বানানো আড়াই কিমি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ জওহর টানেল। একটা দীর্ঘ সুড়ঙ্গ যে কী ভাবে আকাশপাতাল তফাত গড়তে পারে নিসর্গে, তা জওহর টানেল পার না হলে বোঝা দায়। জম্মু থেকে কাশ্মীরে ওঠা বাস্তবিকই মর্ত থেকে স্বর্গে উত্তরণ। আমরা কাটরা থেকে আট ঘণ্টার যাত্রায় ২২০ কিমি পরে রাতের মতো আস্তানা গাড়লাম পহেলগাঁওয়ে। যাকে কাশ্মীরিরাই বলছেন ভূস্বর্গের ভূস্বর্গ।
সেই ভূস্বর্গে পৌঁছনোর ব্যাপারটা বলি। জওহর সুড়ঙ্গ পার হওয়া ইস্তক পাহাড়, বন, নদী ও আকাশের যে সৌন্দর্য দেখেছি তা সুইৎজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, স্কটল্যান্ড বা আমেরিকাতেও দেখিনি।
পহেলগাঁও থেকে ৯৬ কিমি দূরে রাজধানী শ্রীনগর অবিশ্যি এক ভিন্ন নখরা নিয়ে ছড়িয়ে আছে উপত্যকা জুড়ে। লক্ষ্মীমন্ত শহর, দিব্যি বিরাট, আর তার হাইড পার্ক বা গড়ের মাঠ হল ২২ কিমি দীর্ঘ এক হ্রদ, ডাল লেক। সঙ্গে আরেক, নাগিন লেক। এই ডাল লেকের আভাসমাত্র দেওয়া যাবে না পূর্বে দেখা কোনও হ্রদ দিয়ে। শহরের মধ্যে আরেক শহরই বুঝি হাউসবোট ও শিকারায় সাজানো, গড়া, ধরা। আমরা এই জলজ শহরের নবীনতম হাউসবোট স্মিথ প্যালেসে উঠেছিলাম। প্যালেসই বটে, কারণ কার্পেটে মোড়া তিন কামরার বোটে বসার ঘর, বারান্দা, প্যান্ট্রি, ঠান্ডা-গরম রানিং ওয়াটার, কেব্ল টিভি (কলকাতার খবরও দেখা যায়), ফ্রিজে বিয়ার, মেনুতে মাংস, ভাত, রুটি, পরোটা, সবজি, ডাল, স্যান্ডউইচ, টোস্ট, অমলেট, পোচ, কর্নফ্লেক্স, কী নেই! মাংসের যে কোনও পদ, চাইলে বিরিয়ানি।
কিন্তু হাউসবোটের বারান্দা কী শিকারার গদিতে বসলে নাওয়া-খাওয়ার তেমন চিন্তা আপনার থাকবে না। বিশেষ করে শিকারায় চেপে হ্রদভ্রমণে বেরোলে নিজেকে মোগল বাদশাহ বা শাম্মি কপূর ভেবে বসতেও পারেন। গায়ে, গায়ে দোকানদারদের শিকারা এসে
আংটি, চুড়ি, হার, পাথর থেকে শাল, আখরোট, বাদাম, ভুট্টা, ফলমূল মায় ধূম, পানীয় বিক্রি করতে চাইবে। এক সময় জল ছেড়ে ডাঙায় উঠতেই হয়। কারণ মোগল বাদশাহের দানে ও তত্ত্বাবধানে করা মুঘল গার্ডেন্স ও পরিমহল না দেখে শ্রীনগর দর্শন শেষ কেন, শুরুই হয় না। আগের দিন হলে শ্রীনগরের পর গুলমার্গ, সোনমার্গ হয়েই ফিরে আসতে পারত বাঙালি। গুলমার্গে কেব্ল কারে চড়ে হিমবাহে আচ্ছন্ন গিরিশিখর দেখছি যখন, তখনও ভাবতেই পারছি না এই গ্লেসিয়ার বা তুষারনদীর কী আশ্চর্য চেহারা অপেক্ষায় আমাদের লেহ্-লাদাখের পথে। অতএব কাশ্মীর ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব কার্গিল ও লেহ্ যাত্রা।
বাড়িয়ে বলছি না, কমিয়েও বলব না। কার্গিলের পথে জোজিলা পাসের আগেপিছে বিশ কিলোমিটার পথ যথার্থই বিপদসঙ্কুল। বেদম চড়াই উতরাই। এত দিন অবধি দ্রাস ছিল খবরের কাগজে প্রায়ই পড়া এক যুদ্ধক্ষেত্র মাত্র, সেখানে পৌঁছে জানলাম, কার্গিল থেকে ষাট কিলোমিটার দূরের এই ছোট্ট নগরী সাইবেরিয়ার পর পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম স্থান। শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে! কার্গিল থেকে লেহ্ কিন্তু বড় সুন্দর, প্রায় অভঙ্গুর রাস্তা। কাশ্মীরের মতো লাদাখ যাত্রাটাই পরম উপভোগের। প্রতি বাঁকে আকাশ ও পাহাড়ের নতুন চেহারা খোলে। তুষার হয়ে থাকা নদী চার ধারে। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে আপনি গ্লেসিয়ার ভেঙে হাতে তুলে নিতে পারেন। এবং আমাদের মতো আপনিও চমকে উঠবেন লেহ্ পৌঁছে। এগারো হাজার ফুট উচ্চতায় কী ছড়ানো বিছোনো, প্রাচীন-আধুনিক, জটিল লাবণ্যময় শহর!

কী ভাবে এগোবেন
বেড়ানোর খরচ: কাশ্মীর পর্যটন দফতরের নিজস্ব প্যাকেজ আছে। কাশ্মীরের সঙ্গে লেহ্-লাদাখ ঘুরতে অন্তত ১০-১১ দিন লাগবে। শ্রীনগরে নানা ধরনের হোটেল আছে। সব বাজেটের সঙ্গেই মানানসই। দেড় লাখ টাকার মধ্যে চারজনের ট্যুর হয়ে যাবে। এর মধ্যে হোটেল ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, সাইট-সিয়িং, যাতায়াত সব কিছু ধরা। কেবল কাশ্মীর ঘোরার জন্যও নানা প্যাকেজ আছে। এক সপ্তাহ থেকে চার দিন, নানা ব্যবস্থা। খরচ আরও কম
ঘোরাঘুরি: প্যাকেজের মধ্যেই সব ব্যবস্থা আছে। সুতরাং এক বার জম্মু পৌঁছতে পারলেই হল।
মাথায় রাখুন: যথেষ্ট গরম জামা নিতে ভুলবেন না। কাশ্মীর থেকে কার্গিলের পথ বেশ খারাপ। সুতরাং শক্তপোক্ত, পাহাড়ে চড়া যায়, এমন গাড়িতেই যাবেন। এমনিতে কাশ্মীর এখন শান্ত, কিন্তু তা-ও সঙ্গে পরিচয়পত্র রাখুন। সঙ্গে শক্তিশালী টর্চ রাখবেন। পাহাড়ি রাস্তায় অন্ধকারে পথ হাতড়ানো বিশেষ সুবিধের নয়।
আরও জানতে:
www.kashmirtourism.org-এ লগ ইন করতে পারেন। এটা কাশ্মীর পর্যটন দফতরের নিজস্ব ওয়েবসাইট।

কোথায় যাবেন ভাবছেন
• দড় লাখে চার জনের কাশ্মীর
• সফর হয়ে যাবে। যাতায়াত মিলিয়ে।
• হিমালয়। চিনারের বাগান। ওপর-ওপর শান্তিপূর্ণ।
কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে চাপা টেনশন থাকছেই।
• যাতায়াতের কিছু কিছু রাস্তা বিপদসঙ্কুল।
ছবি: সত্যম রায়চৌধুরী
First Page Patrika Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.