|
|
|
|
হাইকোর্টের রায়ে অস্তিত্বের সঙ্কটে ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজ্যে কি শেষ হয়ে এল ল্যান্ড ট্রাইব্যুনালের দিন? বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের এর রায়ের ফলে কার্যত এই ট্রাইব্যুনালের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ দিন এক রায়ে জমি-জায়গা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে ‘ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল’-এর অস্তিত্বকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে জানিয়ে দিল হাইকোর্ট। বিচারপতি ভাস্কর ভট্টাচার্য, বিচারপতি তপন দত্ত এবং বিচারপতি প্রসেনজিৎ মণ্ডলের বিশেষ বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে।
জমি-জায়গা নিয়ে মামলা করার পরে নিম্ন আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট হলে কোনও ব্যক্তি এত দিন ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল-এর দ্বারস্থ হতেন। ট্রাইব্যুনালের রায় বিরুদ্ধে গেলে হাইকোর্টে যাওয়া যেত। কিন্তু বৃহস্পতিবার হাইকোর্ট জানিয়ে দিল, ‘ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল’ যে আইনের উপরে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা অসাংবিধানিক। এই রায়ের ফলে নিম্ন আদালত থেকে এ বার সরাসরি হাইকোর্টে যেতে হবে। মাঝখানে ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল-এর অস্তিত্বই আর থাকবে না। আইনজীবীদের মতে, ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল উঠে গেলে ক্ষতি হবে রাজ্য সরকারেরই। কারণ, সরকারই ট্রাইব্যুনাল-এর বিচারক ও প্রশাসক নিয়োগ করে।
আদালতের রায়ের খবর বিকেলে মহাকরণে পৌঁছতেই আইন ও ভূমি সংস্কার দফতরের ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। আইনমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে দুই দফতরের অফিসারেরা এই নিয়ে আলোচনা করেন। পরে মলয়বাবু বলেন, “রায়ের প্রতিলিপি এখনও আমরা হাতে পাইনি। তাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা এখনই বলা যাবে না। তবে জমিজমা নিয়ে মামলার ক্ষেত্রে ল্যান্ড ট্রাইব্যুনালের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে সন্দেহ নেই।” রাজ্যের সামনে এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পথ অবশ্য খোলা রয়েছে। আবার হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে কিছু সংশোধনী করে ট্রাইব্যুনাল টিকিয়ে রাখার সুযোগও রয়েছে। রায়ের প্রতিলিপি হাতে পাওয়ার আগে এই নিয়ে কিছুই বলতে নারাজ রাজ্য। তবে তারা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা খারিজও করে দেয়নি। মলয়বাবু জানিয়েছেন, ২ মে আগের সরকারের আমলে এই মামলার শুনানি হয়। তখন রাজ্যের হয়ে সওয়াল করেছিলেন প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বলাই রায়। হাইকোর্ট এ দিন তার রায় ঘোষণা করেছে। রাজ্যের এখন চারটি ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল আছে বলেও জানান ভূমি দফতরের কর্তারা।
প্রফুল্ল কোটেজ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা রাজ্যের ‘ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট’-কে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, ওই আইনটির মাধ্যমে রাজ্য সরকার বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রায় ঘোষণার পরে ওই সংস্থার আইনজীবী সপ্তাংশু বসু বলেন, “সংবিধানের ৫৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাজ্য সরকার এই জাতীয় আইন চালু করতে পারে না। এই সব ট্রাইব্যুনাল-এ বিচারক নিয়োগ করে রাজ্য সরকার। সরকারের পক্ষে এ ভাবে সরাসরি ট্রাইব্যুনাল-এ বিচারক নিয়োগ করা সংবিধানের ৫৪ নম্বর ধারার বিরোধী। এর ফলে বিচার ব্যবস্থায় রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপই প্রমাণিত হচ্ছে।” এই মামলার অন্য আইনজীবী অনন্যা দাস বলেন, “তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ এই রায়ে বেশ কিছু সংশোধনী সূত্র দিয়েছে। একমাত্র সেই সূত্র অনুযায়ী রাজ্য আইন সংশোধন করলে তবেই নতুন করে ট্রাইব্যুনাল-এর কথা ভাবা যেতে পারে।”
কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, কর ট্রাইব্যুনাল-এর মতো রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত আরও অনেকগুলি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এ দিন রায়ের পরে সংবিধান-বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য, “হাইকোর্টের এই রায়কে কেন্দ্র করে কেউ মামলা করলে অন্য ট্রাইব্যুনালগুলিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।” এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে যদি পশ্চিমবঙ্গের ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে অন্য রাজ্যেও তার প্রভাব পড়বে। কারণ, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে অশান্তি হচ্ছে উত্তরপ্রদেশেও। ফলে, কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে সামনে রেখে অন্যান্য রাজ্যেও একের পর এক ল্যান্ড ট্রাইবুনাল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
হাইকোর্টের এই রায়ের ফলে অন্য একটি সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এই মূহূর্তে রাজ্যে ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল-এ জমে থাকা মামলার সংখ্যা লক্ষাধিক। কলকাতা হাইকোর্টে জমে থাকা মামলার সংখ্যা সাড়ে তিন লক্ষ পেরিয়েছে। এই অবস্থায় ল্যান্ড ট্রাইব্যুনাল-এর জমে থাকা মামলা সরাসরি হাইকোর্টে এলে এখানে জমে থাকা মামলার সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক বেড়ে যাবে। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আবেদনকারীদের প্রধান অভিযোগ ছিল, মামলার মীমাংসা হতে একটি প্রজন্ম পেরিয়ে যায়। এ বার সরাসরি হাইকোর্টে গেলে সেই সময়টা হয়তো বাঁচবে। কিন্তু মামলার পাহাড়ে চাপা পড়ে গেলে সেখানেও মীমাংসা হতে হরেদরে একই সময় লাগবে। কারও কারও আশঙ্কা, বেশি সময়ও লাগতে পারে।
অভিযোগ, বারবার বলা সত্ত্বেও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির সংখ্যা বাড়েনি। বাড়েনি আনুপাতিক কর্মচারীর সংখ্যা। বারবার কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং বার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। কলকাতা হাইকোর্টে এখন ৫৮ জন বিচারপতির থাকার কথা। কিন্তু কার্যত চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জনের বেশি বিচারপতি কখনওই থাকেন না। কেন্দ্রে আইনমন্ত্রী থাকাকালীন দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির জন্য বীরাপ্পা মইলি ‘ফাস্ট-ট্র্যাক’ কোর্ট বাড়াতে এবং সান্ধ্যকালীন আদালত চালু করতে অনেক পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু সারা দেশে সান্ধ্যকালীন আদালত এখনও চালু হয়নি। |
|
|
|
|
|