|
|
|
|
উষ্ণায়ন রুখবে কে |
পরিবেশরক্ষক ম্যানগ্রোভের দল নোনার বিষে কোণঠাসা |
মিলন দত্ত • কলকাতা |
এত দিন তারা প্রাণপণ লড়েছে। উষ্ণায়নের আগ্রাসন রুখে রক্ষা করেছে পরিবেশকে।
কিন্তু এখন তাদের পিছু হঠার পালা। স্রেফ সংখ্যাল্পতার কারণেই দূষণ-যুদ্ধে হার মানতে হচ্ছে পরিবেশের পরম মিত্র সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে।
এত দিন জানা ছিল, বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝঞ্ঝার সামনে পাঁচিল হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য বা বাদাবন। এ বার জানা গেল, একই সঙ্গে আরও একটা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ কাজ তারা করে চলেছে। বায়ুমণ্ডল থেকে অহরহ প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে পরিবেশে লাঘব করছে দূষণের ভার। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে বেড়ে ওঠে নোনা জলের উদ্ভিদরাশি। অথচ জল-মাটির বাড়তি নুনেই সেই বাদাবন দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনের বিপুল জীব-বৈচিত্র্যের পাশাপাশি অরক্ষিত হয়ে পড়ছে পরিবেশও।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের লবণাম্বু উদ্ভিদগুলোর কার্বন শোষণক্ষমতা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র-বিজ্ঞান বিভাগ ২০০৯-এ গবেষণা শুরু করেছিল। কেন্দ্রীয় ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের অর্থ সাহায্যপ্রাপ্ত গবেষণা-প্রকল্পটির প্রধান, তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অভিজিৎ মিত্র বলেন, “লবণাম্বু উদ্ভিদ কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে গ্লুকোজে রূপান্তরিত করে নেয়। গ্লুকোজ হল যে কোনও গাছের খাদ্য। তার কিছুটা শর্করায় পরিণত হয়। সেই শর্করাও গাছে আবদ্ধ থাকে।” |
|
কার্বন ডাই অক্সাইড হল সেই গ্যাস, যা প্রতি দিন বিশ্ব উষ্ণায়নকে ত্বরাণ্বিত করছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কল-কারখানা, যানবাহন ও রান্নাবান্নায় ব্যবহৃত কয়লা-পেট্রোল-ডিজেলের মতো জীবাষ্ম-জ্বালানির দহনে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলকে নিত্য কলুষিত করে মানবসভ্যতার সামনে সঙ্কট ডেকে আনছে। এবং এই বিষ-গ্যাসকেই খ্যাদ্যে রূপান্তরিত করে বেড়ে উঠে অন্যতম পরিত্রাতার ভূমিকা পালন করে ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
কোন গাছ কতটা কার্বন শুষতে পারে?
অভিজিৎবাবু জানিয়েছেন, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ৩৪টি প্রজাতির গাছ আছে। তাঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু এর পাঁচটি তিন প্রজাতির বাইন, এক প্রজাতির কেওড়া ও এক প্রজাতির গেঁওয়া। গবেষণায় প্রকাশ, এদের মধ্যে কেওড়া গাছ সর্বাধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড তার শিকড়, কাণ্ড, ডালপালা ও পাতায় আবদ্ধ করে রাখতে পারে। অভিজিৎবাবুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক হেক্টর কেওড়াবন বছরে ১৭০ টন পর্যন্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আবদ্ধ করতে পারে। বাইনের ক্ষেত্রে তা ১১৫ টন, গেঁওয়ার ২৩ টন। তাঁর কথায়, “২০০৯ থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর লবণাম্বু উদ্ভিদের কার্বন ধারণক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করতে
গিয়ে দেখেছি, গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ক্ষমতা কমতে থাকে।”
তবে ঠিক কোন বয়সের গাছ কতটা কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষতে পারে, তা জানতে আরও সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন অভিজিৎবাবু। ঝড়খালিতে বন দফতরের গড়ে তোলা ম্যানগ্রোভ নার্সারিতে তাঁদের গবেষণার কাজ চলছে। সমুদ্র-বিজ্ঞান বিভাগের আর এক গবেষক তপনকুমার জানা দিলেন আর এক বিস্ময়কর তথ্য ‘‘আমাজন অরণ্যের চেয়ে অনেক বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধারণের ক্ষমতা রাখে আমাদের বাদাবন। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড! এর সঙ্গে ফি বছর জুড়ছে আরও ৩৮ লক্ষ টন।” আবদ্ধ বিষ-গ্যাসের একাংশকে শর্করায় পরিণত করার সুবাদেই বছর বছর আরও গ্যাস আবদ্ধ করতে পারছে তারা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য হল সুন্দরবন। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে আয়তন ১০ হাজার ২৩০ বর্গ কিলোমিটার। এর ৪২০০ বর্গ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গে। এই বাদাবনের অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। কেন?
অভিজিৎবাবুর ব্যাখ্যা, “সুন্দরবনে জলে-মাটিতে নোনাভাব বাড়ায় অনেকগুলো প্রজাতির গাছ হয় একেবারেই হচ্ছে না, কিংবা বৃদ্ধি সাংঘাতিক হ্রাস পেয়েছে। যেমন, সুন্দরী বা গোলপাতা। অথচ সুন্দরী গাছের দৌলতেই এই অরণ্যের নাম সুন্দরবন।” কিন্তু লবণাক্ততা বাড়ছে কেন?
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, মূলত বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওখানে মিষ্টি জলের জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নোনার তেজ বেড়েছে। তবে যে পাঁচটি প্রজাতির গাছ নিয়ে তাঁদের গবেষণা, সেগুলো এখনও সুন্দরবনে যথেষ্ট সংখ্যায় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অভিজিৎবাবু। বিশেষত বাইন গাছ সুন্দরবনের সর্বত্রই ভাল হয়। উপরন্তু এখন জানা যাচ্ছে, উষ্ণায়ন রোধে বাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাই অরণ্যসৃজনে বাইনের উপরে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি বলে অভিজিৎবাবুরা মনে করছেন।
আর ওঁদের গবেষণা এ-ও জানাচ্ছে যে, সুন্দরবনের নোনা মাটিও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভাণ্ডার। অভিজিৎবাবু বলেন, “সুন্দরবনের মাটির কার্বন-ডাই-অক্সাইড ধারণক্ষমতা নিয়েও আমরা একই সঙ্গে কাজ করছি। এর ফলাফল জানতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।” |
|
|
|
|
|