|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
সন্ত্রাসজয়ী |
ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বই আবার ক্ষতবিক্ষত। অমানবিক বর্বরতা যাহারাই ঘটাইয়া থাকুক, তাহাদের কাপুরুষতা কোনও আদর্শবাদ বা রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের উপায় হিসাবে বহু কাল আগেই ব্যর্থ সাব্যস্ত হইয়াছে। বিশ্বের কোনও রাষ্ট্রই আজ সন্ত্রাসবাদের কাছে নত হইয়া সন্ত্রাসীদের দাবিদাওয়া মানিয়া লয় না, বরং সন্ত্রাস মোকাবিলার তৎপরতা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। মুম্বইতেও পুলিশ, গোয়েন্দা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এ বারের হামলায় কর্তব্যমূঢ় হইয়া পড়ে না। বরং জনসাধারণকে সজাগ করা, আহতদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, আক্রান্ত জনপদ ও নগরীতে বিপর্যস্ত জনজীবনে অচিরে স্বাভাবিকতা ফিরাইয়া আনার কাজে প্রশাসন ও জনতাকে অনেক পরিণত দেখাইয়াছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও নিয়মিত রাজ্যের সহিত জীবন্ত সংযোগ বজায় রাখিয়া মোকাবিলা ও ত্রাণের কাজে সমন্বয় সাধন করিয়াছেন। এগুলিই সময়ের চাহিদা এবং তাহা পূরণে ভারত পর্যাপ্ত তৎপরতা দেখাইয়াছে।
সন্ত্রাসবাদ একটি প্রবণতা, যাহার সহিত জনসাধারণকে সহবাস করিতে হইবে। এই অনিবার্যতা শিরোধার্য করিয়া লইলে দায়ী কে, তাহা লইয়া অনুমানের ঘুড়ি উড়াইবার প্রয়োজন হয় না। গুজব বা ভিত্তিহীন কল্পনার ভিত্তিতে ধরপাকড় বা জনসাধারণের মধ্যে ভীতি ও বিচলন সৃষ্টিও অপ্রাসঙ্গিক হইয়া ওঠে। হতাহতদের জন্য সমবেদনা থাকুক। আক্রান্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সুবন্দোবস্তও জরুরি। কিন্তু দোষারোপের আঙুল তুলিয়া সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রবণতা বন্ধ হউক। কেননা সন্ত্রাসবাদীরা ইচ্ছা করিলে বিশ্বের যে-কোনও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা-বলয় অনায়াসে ভেদ করিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো সুরক্ষিত দেশগুলির সরকারও তাহা সম্যক উপলব্ধি করিয়াছে। সন্ত্রাসবাদের সহিত ঘর করাই যে আজ বিশ্ববাসীর নিয়তি, তাহা প্রকারান্তরে সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। সজাগ, সতর্ক থাকা, হামলার পর উদ্ভ্রান্ত হইয়া হতাশা ও অবসাদের নিকট আপনাকে সঁপিয়া দিয়া হা-হুতাশ করার পরিবর্তে দৃঢ়তার সহিত সমবেত উদ্যোগে স্বাভাবিক জনজীবনে প্রত্যাবর্তনে শামিল হওয়াই সমীচীন। মুম্বই ও মহারাষ্ট্রের সরকার ও জনগণ কিন্তু বারংবার সেই উদ্যোগের নমুনা পেশ করিয়া চলিয়াছেন এবং প্রতিটি মারণ-হামলার পর যেন তাঁহারা আরও পরিণত। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত দাঙ্গা ও তাহার প্রতিক্রিয়ায় ঘটা মুম্বই-বিস্ফোরণের কাল হইতে এই শহর তো কম সন্ত্রাস দেখে নাই। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রেই মৃত্যু, ক্ষয়, অপচয়ের সঞ্চিত হতাশা ঝাড়িয়া মুম্বই উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। মুম্বইবাসীকে অভিনন্দন।
অবশিষ্ট ভারতবাসীও কি কম সংযম ও পরিপক্বতা দেখাইয়াছেন? প্রায় প্রতিটি সন্ত্রাসবাদী হামলায় বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের বিপথগামীদের দিকে প্রচারের ইঙ্গিত থাকিলেও তাহার কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সেই সম্প্রদায়কে ভোগ করিতে হয় নাই। প্ররোচনার অভাব ছিল না, একটা পর্যায় অবধি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিদের উস্কানিও যথেষ্টই ছিল। কিন্তু আপামর দেশবাসী সেই প্ররোচনার ফাঁদে পা দেন নাই। সন্ত্রাসবাদের সহিত কোনও বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়কে তাঁহারা একাত্ম করিয়া ফেলার প্রমাদে জড়ান নাই। বরং প্রতিবেশী বিধর্মীকে আশ্বস্ত করিয়াছেন, তাঁহাদের সহিত একযোগে ধ্বনি তুলিয়াছেন সন্ত্রাসবাদীর কোনও ধর্ম নাই, তাহারা দুষ্কৃতী ও অপরাধী, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের হত্যার বর্বরতায় লিপ্ত সমগ্র মানবতার শত্রু। ইহা তাৎপর্যপূর্ণ যে, গত দুই দশকে ভারতে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় নাই (গুজরাতের ব্যতিক্রমী ঘটনা কোনও দাঙ্গা ছিল না, ছিল সরকারি মদতে একতরফা সংখ্যালঘু-নিধন)। একদা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিরাও বুঝিয়াছেন, ভারতবাসী এখন সন্ত্রাসবাদীর সম্প্রদায় বা ধর্মকে ঘৃণা করার চেয়ে সন্ত্রাসবাদকে ঘৃণা করার পরিণতি অর্জন করিয়াছে। ইহাই প্রকৃত ভরসা। |
|
|
|
|
|