যাত্রী যেন নেই! অথবা যাত্রী শুধু আশা আর নিরাশা, উদ্বেগ আর আতঙ্ক! হাওড়া থেকে ফতেপুর দীর্ঘ পথে এই ট্রেনের যাত্রীদের একমাত্র সম্বল দমবন্ধ দুশ্চিন্তার প্রহর। মলওয়াঁয় লাইনচ্যুত কালকা মেলের যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন রবিবার হাওড়া থেকে দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিলেন এই বিশেষ ট্রেনে। কেউ জানেন, স্বজনবন্ধুর কী হয়েছে। কেউ বা জানেন না। জানেন না, আর দেখা হবে কি না প্রিয়জনের সঙ্গে।
দিনভর হাওড়া স্টেশনের কন্ট্রোল রুমে কালকা মেলের যাত্রীদের খোঁজে হন্যে হয়ে দৌড়েছেন এই আত্মীয়েরা। অনেকেই খোঁজ পাননি প্রিয়জনের। রাতে বিশেষ ট্রেন যাচ্ছে শুনেই একবস্ত্রে তাতে উঠে পড়েন তাঁরা। অন্তত ১২৪ জন। কেউ বা ছেলেমেয়ের খোঁজে, কেউ বা ভাই, কেউ বন্ধুর খোঁজে।
রাত ৮টা ১২ মিনিটে ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ল বিশেষ ট্রেন। যাত্রীদের অনেকের কাছেই নেই রাতে খাওয়ার মতো টাকা। দুপুর থেকে ভাল করে খাওয়া হয়নি অনেকেরই। ট্রেনে উঠে অনেকেই ক্লান্তিতে-উদ্বেগে গা এলিয়ে দেন আসনে। অনেকেই অক্লান্ত ভাবে রেলের দেওয়া স্যাটেলাইট ফোনে কালকায় থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন। যদি কিছু জানা যায়, এই আশায়। কেউ বা বারবার মোবাইলে আত্মীয়বন্ধুর ছবিটি পাশের সহযাত্রীদের দেখাচ্ছিলেন। কেউ বা ছবি হাতে নিয়ে কেঁদেই চলেছেন।
অনেক চেষ্টা করেও দুপুর থেকে ছেলে, দুই মেয়ে, জামাইয়ের খোঁজ পাননি এই বিশেষ ট্রেনের যাত্রী মহম্মদ উসনান। প্রৌঢ় উসনান নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন। বললেন, “মেয়ে, জামাই, ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলাম। ছেলেমেয়েরা শনিবার দিল্লি রওনা দেয়। আমি আর স্ত্রী থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু এ ভাবে যে ওদের খুঁজতে যেতে হবে, শনিবারেও তা জানতাম না। জানি না, ওদের কী অবস্থায় দেখব!” কাঁদতে কাঁদতে ঝিমিয়ে পড়লেন দিল্লিবাসী প্রৌঢ়।
দাদা বেঁচে আছেন, শুধু এটুকুই জানতে পেরেছেন আয়ুষ ঝুনঝুনওয়ালা। দুপুরেই বেরিয়েছেন দাদার খোঁজে। হাওড়া কন্ট্রোল রুম থেকে জেনেছেন, সাড়ে তিন ঘণ্টা কামরায় আটকে ছিলেন দাদা রাজীব। “শুনলাম, গ্যাস-কাটার দিয়ে কামরা কেটে ওকে বার করা হয়েছে। পায়ে আঘাত লেগেছে। আর কিছু জানি না,” উদ্বিগ্ন গলায় বললেন আয়ুষ।
রাত ১১টা নাগাদ দুর্গাপুরে ট্রেনে ওঠেন দীপঙ্কর ঘরামি। তাঁর বড় ছেলে সৈকত এমবিএ পড়তে দিল্লি যাচ্ছিলেন। দাদাকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন দুই ভাই চিরঞ্জীব ও শুভঙ্কর। তিন ছেলেই হাসপাতালে, এটুকু জানতে পেরেছেন দীপঙ্করবাবু। সৈকত আছেন ফতেপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, অন্য দুই ছেলে কানপুরের হাসপাতালে। “তিন ছেলেকে সুস্থ শরীরে ফিরে পেতে চাই,” সারা রাত বারবার এটাই বলছিলেন দুর্গাপুরের এই বাসিন্দা।
আজ, সোমবার ফতেপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল সাড়ে ৯টা বেজে যাবে। সেখানে নেমে শুরু হবে আতঙ্ক-অনিশ্চয়তায় থাকা এই মানুষগুলোর স্বজন-সন্ধান। আত্মজনকে ফিরে পেতে আঁতিপাঁতি খোঁজ। |