রেললাইনের উপরে বসে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে কাঁদছিল বছর পাঁচেকের শিশুটি। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না মায়েরও।
সেনাবাহিনীর এক জওয়ান হেঁটে আসছিলেন সে-দিকেই। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিল যাত্রীদের স্যুটকেস, ব্যাগ, জামাকাপড়, বই, খেলনা, খাবার...। তার মধ্য থেকে একটা পুতুল তুলে শিশুটির হাতে দিলেন জওয়ান। বিপর্যয়ের মধ্যেও জীবনে জীবন যোগ করার অন্য ছবি তৈরি হল মলওয়াঁর দুর্ঘটনাস্থলে।
জওয়ানটি তার পরেই ফের ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্ধারকাজে। খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া দেহ, রক্ত আর আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদের মধ্যে অবিচল ভঙ্গিতে প্রাথমিক শুশ্রূষার কাজ করে চলেছেন তাঁর সঙ্গী ফৌজিরা। জওয়ানটি ছুটে গিয়ে হাত লাগালেন তাঁদের সঙ্গেই। স্ট্রেচারে পরপর সাদা চাদরে ঢাকা নিথর দেহ। চার পাশে রক্ত, ঘিলু, মানুষের দেহের মাংসের টুকরো। সমবেত আর্তনাদে বাতাস ভারী। এক-একটা কামরার উপরে অন্য কামরা এমন ভাবে উঠে গিয়েছে যে, যাত্রীদের বার করার জন্য মই বেয়ে উঠতে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের। কোনও মতে ভাঙা জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে বার করে আনা হচ্ছে যাত্রীদের। স্ট্রেচারে শুইয়েই ঝটিতি সেলাই করা হচ্ছে ক্ষতস্থানে। চালু হচ্ছে স্যালাইন, অক্সিজেন। মলওয়াঁর দুর্ঘটনাস্থলই একটা ‘মিনি হাসপাতাল’-এর চেহারা নিয়েছিল রবিবার বিকেলে।
দুর্ঘটনার অল্প কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। তার পরে আসে রেলের উদ্ধারকারী দল। কাজে নেমে পড়ে সেনাবাহিনীও। আসে হেলিকপ্টার। গ্যাস-কাটার দিয়ে জানলা কেটে আটকে পড়া যাত্রীদের বাইরে আনার চেষ্টা শুরু হয়। চারটি দলে মোট ১৩৫ জন হাত লাগান উদ্ধারের কাজে। সকলের লক্ষ্য ছিল একটাই, সন্ধ্যা নামার আগে কত দ্রুত যাত্রীদের বাইরে আনা যায়। কিন্তু ট্রেনের দরজা, জানলাগুলি এমন ভাবে দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে যে, উদ্ধারকাজে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠে যায় সকলেরই।
এরই মধ্যে আবার কয়েকটি কামরার ভিতর থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। কোথাও কোথাও দেখা যায় আগুনের ফুলকিও। কারও নির্দেশের জন্য অপেক্ষা না-করে স্থানীয় লোকজনই বালতিতে জল এনে জানলার ভিতর দিয়ে ঢালতে থাকেন, যাতে আগুন ছড়াতে না-পারে। আহতদের বাইরে আনার পরে তাঁদের পানীয় জল, শিশুদের জন্য দুধও জুগিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই।
ফতেপুর জেলা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক দল দুপুরের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। জেলার চিফ মেডিক্যাল অফিসার বিকেল নাগাদ জানান, মৃতের সংখ্যা ৩৫। আহত দু’শোরও বেশি। আহতদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই কোনও মতে কামরার বেরিয়ে আসেন। বাইরে এসে সংজ্ঞা হারান অনেকেই। অধিকাংশই হাঁটতে পারছিলেন না। তাঁদের কাউকে স্ট্রেচারে, কাউকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তোলা হয়। যাঁদের অবস্থা বেশি সঙ্গিন, তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই খানিকটা সুস্থ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ফৌজি এবং স্থানীয় চিকিৎসকেরা। হাজির ছিল বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল ভ্যানও।
পরিবারের অন্য সাত জনের সঙ্গে কলকাতা থেকে চণ্ডীগড় যাচ্ছিলেন দীপালি প্রধান। আপার বার্থে ছিলেন। ছিটকে নীচে পড়ে যান তিনি। হাতে, পায়ে গুরুতর চোট লেগেছে। ব্যান্ডেজ সামলাতে সামলাতে বললেন, “প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ হল, প্রায় কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। ছিটকে নীচে পড়লাম। তার পরে কিছু ক্ষণ আর কিছু মনে নেই। সম্বিৎ ফিরতে দেখি, জামাইবাবুর মাথা থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। মা আর আমার বাচ্চারাও কাঁদছে। ওদেরও নানা জায়গায় চোট লেগেছে।” এরই মধ্যে সেনাবাহিনী যে কী অপরিসীম দক্ষতায় তাঁদের উদ্ধার করেছে, তা জানাতে ভুললেন না দীপালি। চিকিৎসকেরা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন এক প্রৌঢ়ের। তিনি যে বেঁচে রয়েছেন, সেটাই তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। জানালেন, কয়েক জন গ্রামবাসী তাঁকে জানলার ভাঙা অংশ দিয়ে কোনও মতে টেনেহিঁচড়ে বার করেছেন। হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রৌঢ় বললেন, “ওঁরা সাক্ষাৎ ভগবান। আমাকে নতুন জীবন দিলেন।” অনুপ পটেল নামে এলাকার এক বাসিন্দা জানান, তিনি তিন জনকে বার করেছেন। বললেন, “দুর্ঘটনার কথা জানার পরে এক মিনিটও অপেক্ষা করিনি। আশেপাশে যাকে পেয়েছি, সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছি। হাত লাগিয়েছি উদ্ধারে।” |