কেন, কী ভাবে বেলাইন হল কালকা মেলের ১৬টি কামরা?
রবিবার কানপুর ও ফতেপুরের মধ্যে মলওয়াঁয় ওই দুর্ঘটনা ঘিরে প্রশ্ন অনেক। কিন্তু এ দিন রাত পর্যন্ত কোনও প্রশ্নেরই সঠিক জবাব মেলেনি। রেল কর্তৃপক্ষও অন্ধকারে। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, দুর্ঘটনার সময় ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ ব্যবহার করেছিলেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের চালক। ট্রেনটি পরীক্ষা করে এই তথ্য জানা গিয়েছে বলে উত্তর-মধ্য রেল সূত্রে খবর।
এখন প্রশ্ন হল, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পরে চালক ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ কষেছিলেন, না ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ কষার ফলেই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়?
যিনি মুখ খুললে দুর্ঘটনার কারণ নিমেষে স্পষ্ট হয়ে যেত, কালকা মেলের সেই চালক গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে। রেল সূত্রের খবর, চালকের অবস্থা এতটাই আশঙ্কাজনক যে, তাঁর কাছ থেকে আপাতত কিছু জানার উপায় নেই।
রেল কর্তাদের একাংশের ধারণা, হঠাৎ ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ ব্যবহারের অভিঘাতেই ১০৮ কিলোমিটার বেগে চলা ট্রেনটি এক ঝটকায় থামতে গিয়ে ১৬টি কামরা উল্টে যায়। একটা কামরার ঘাড়ে উঠে যায় অন্যটা। কিন্তু আপৎকালীন পরিস্থিতিতে আচমকা ট্রেন থামানোর জন্যই তো ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ রাখা হয়। তা হলে সেই ব্রেক ব্যবহার করার কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটবে কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। ফলে অনেকে আবার মনে করছেন, ইঞ্জিন বেলাইন হয়ে যাওয়ার পরেই ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ কষেছিলেন কালকা মেলের চালক।
রেল সূত্রে বলা হচ্ছে, কালকার মতো ট্রেন সাধারণত অভিজ্ঞ চালক ছাড়া কাউকে চালাতে দেওয়া হয় না। ফলে কোন পরিস্থিতিতে ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ কষতে হবে, তা দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের চালকের না জানার কথা নয়।
রেল সূত্রের বক্তব্য, মূলত তিনটি কারণে ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ ব্যবহার করা হয়।
• যদি একই লাইনে সামনে অন্য কোনও ট্রেন থাকে।
• লাইন যদি ভেঙে উড়ে গিয়ে থাকে।
• যদি বিপন্ন প্রজাতির কোনও বন্যপ্রাণীকে বাঁচানোর প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু কালকা মেলের চালককে রবিবার এই ধরনের কোনও পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি বলেই রেল সূত্রের খবর।
রেল কর্তারা অবশ্য জানাচ্ছেন যে আরও কিছু কিছু কারণে ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’-এর প্রয়োজন হয়। এক রেলকর্তা বলেন, ইঞ্জিন বা চাকায় হঠাৎ গণ্ডগোল দেখা দিলে যাত্রীদের বাঁচানোর জন্য অনেক সময় ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ দিন কালকা মেলের ইঞ্জিন বা চাকায় কোনও গণ্ডগোল ছিল বলে রেল-কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত জানাননি।
ফলে লাইনচ্যুত হওয়ার পরেই ‘ইমার্জেন্সি ব্রেক’ ব্যবহার করা হয়েছিল, এমন মতের অন্তত প্রাথমিক ভাবে একটা ভিত্তি পাওয়া যাচ্ছে।
রেল কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দু’টো বা তিনটে লাইন যেখানে মিলেছে, কিংবা একটা লাইন যেখানে দু’ভাগ হয়েছে, সেখানে অবাঞ্ছিত ফাঁক থাকলে ট্রেন বেলাইন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। লাইনে ফাটল থাকলেও ইঞ্জিন এবং ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে। ট্রেন বেলাইন হয় জার্নাল অ্যাক্সেল ভেঙে গেলেও। কালকা মেলের ক্ষেত্রে এই সব সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। ওই বিশেষজ্ঞেরা আরও বলছেন, অনেক সময় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সমান্তরাল দু’টি রেল লাইনের দূরত্ব কমে বা বেড়ে যেতে পারে। এই সব ক্ষেত্রেই প্রথমে লাইনচ্যুত হবে ইঞ্জিন। তাঁদের মতে, যে কোনও কারণেই হোক, ইঞ্জিন বেলাইন হয়ে গিয়েছিল ট্রেনটির।
এর পরেই উপায়ান্তর না দেখে কালকার চালক ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন।
যে-হেতু রেল স্টেশনের কাছাকাছি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাই রেল লাইনের পয়েন্ট খারাপ হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না রেল কর্তাদের ওই অংশটি। তাঁদের মতে, কোনও কারণে ট্রেনটিকে মেন লাইন থেকে লুপ লাইনে পাঠানোর সময় ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে থাকতে পারে। এবং সে ক্ষেত্রে ১০৮ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলা ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হলে চালকের ইমার্জেন্সি ব্রেক কষা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
রেল বোর্ডের প্রাক্তন কর্তা সুভাষ ঠাকুরও তা-ই মনে করছেন। তাঁর কথায়, “তীব্র গতির ট্রেনে চালক তো আর এমনি এমনি ব্রেক কষেননি। নিশ্চয়ই তিনি হঠাৎ কোনও
বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এবং বাধ্য হয়েই ইমার্জেন্সি ব্রেক ব্যবহার করেছেন।” সুভাষবাবুর বক্তব্য, টিভি-র ছবি দেখে এবং বিভিন্ন মহলের কথা শুনে মনে হয়েছে, পয়েন্টের কোনও গণ্ডগোলে ইঞ্জিন বেলাইন হয়ে যাওয়ার পরে চালক ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন।
কালকা মেলের অক্ষত যাত্রীরা আবার জানিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন, সামনে লাইন মেরামতি চলছিল। ফলে অনেকে আবার মনে করছেন, লাইনে কর্মরত শ্রমিকদের বাঁচাতেই ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন চালক।
সব মিলিয়ে ব্রেক ব্যবহারের জন্যই দুর্ঘটনা, না দুর্ঘটনায় পড়ার পরে বাঁচার শেষ চেষ্টায় ব্রেক কষা তাই আপাতত ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের। |