|
|
|
|
উদ্বিগ্ন মুখের ভিড়ে থমথমে হাওড়া স্টেশন |
আর্যভট্ট খান |
মায়ের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন শ্রেয়সী ঘোষ। চোখের ‘ভাষায়’ যেন আশ্বাস দিতে চাইছিলেন তাঁকে সুস্থই রয়েছে দুই একরত্তি মাসতুতো ভাইবোন।
দিন কয়েক শ্রেয়সীদের শ্রীরামপুরের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে শনিবারই সপরিবার কালকা মেলে নয়াদিল্লি রওনা দিয়েছিলেন তাঁর মাসি। ট্রেন দুর্ঘটনার খবর শুনেই মা সুপ্রিয়া ঘোষকে নিয়ে রবিবার দুপুরে হাওড়া স্টেশনে ছুটে যান ওই কলেজছাত্রী। শ্রেয়সীর মেসোমশাই প্রবীরকুমার দে আর মাসি মৌসুমী ফোনে তাঁদের শুধু এটুকুই জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে খোঁজ মিলছে না তাঁদের ছেলে প্রীতম আর মেয়ে প্রিয়দর্শিনীর। পুরোপুরি উল্টে গিয়েছে তাঁদের এস-৪ কামরাটি। |
|
|
হাওড়া স্টেশনে চিন্তিত পরিজনেরা।রবিবার। |
|
হাওড়া স্টেশনের ‘সহায়তা কেন্দ্র’-এর কর্মীদের কাছে তাই একটা কথাই জানতে চাইছিলেন শ্রেয়সীছোট্ট দুই মাসতুতো ভাইবোনের কোনও খবর এল কি?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। শ্রেয়সীদের মতোই উদ্বিগ্ন আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনদের ভিড়টাও ক্রমশ বাড়ছিল হাওড়া স্টেশনে। কয়েকশো লোকের ওই জটলায় ছিলেন চন্দননগর থেকে আসা মহম্মদ ওসমান, কলকাতার জগন্নাথ ঘোষেরা। ওসমান বললেন, “আমার বোন-ভগ্নীপতি আর ভাগ্নী দিল্লি ফিরছিল। ট্রেনটা উল্টে যাওয়ার পরে কোনওক্রমে বাইরে বেরিয়ে আসে আমার ভাগ্নী। কিন্তু, ওর মা-বাবার কোনও খোঁজ নেই এখনও।” তাঁর অভিযোগ, দুর্ঘটনার খবরাখবর দিতে রেলের তরফে যে সব হেল্পলাইনের নম্বর দেওয়া হয়েছে, তাতে বেশির ভাগ সময়েই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। হাতের মুঠোয় বোন-ভগ্নীপতির ছবি নিয়ে স্টেশনের এ দিক-ও দিক ঘুরছিলেন ওসমান। বললেন, “বিশেষ ট্রেনটায় যেতে চাই ওখানে। বোনদের খুঁজে পেতেই হবে।” দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনে থাকা পরিজনদের খোঁজে আসা অনেকেরই অভিযোগ ছিল, হাওড়া স্টেশনের সহায়তা কেন্দ্রে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হতাহতের তালিকা টাঙানো হয়নি। ভাল ভাবে কাজ করছে না হেল্পলাইনগুলিও।
হতাহতদের নাম সন্ধ্যা পর্যন্ত কেন জানানো হয়নি?
হাওড়া স্টেশনে গিয়ে রেল প্রতিমন্ত্রী মুকুল রায় বলেন, “রেলের উচ্চপদস্থ অফিসাররা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন। আপাতত ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। দেহগুলি শনাক্ত না হলে পরিচয় ঘোষণা করা যায় না। যত দ্রুত সম্ভব তা করার চেষ্টা হচ্ছে। পুরো বিষয়টির তদারকি করছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।” |
|
দুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীদের আত্মীয়দের নিয়ে কানপুর রওনা হল এই বিশেষ ট্রেন। |
রেল প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, কালকা মেলের দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারপিছু ৫ লক্ষ টাকা, গুরুতর আহতদের ১ লক্ষ এবং সামান্য আহতদের ২৫ হাজার করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কানপুর এবং ইলাহাবাদ থেকে দু’টি উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। দুর্ঘটনার খবরাখবর জানাতে হাওড়ার পাশাপাশি, বর্ধমান এবং আসানসোলেও হেল্পলাইন খোলা হয়েছে। বর্ধমানের হেল্পলাইন নম্বর ০৩৪২-২৫৬১৬০১, আসানসোলে ০৩৪১-২৩০৪৬১৪।
হাওড়ার স্টেশন ম্যানেজার সমীরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রীদের পরিজনদের জন্য হাওড়া থেকে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। রবিবার রাত ৮টা ১০ মিনিট নাগাদ সেটি কানপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। হাওড়া স্টেশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২৪ বগির ওই ট্রেনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মোট ১১১৫ জন যাত্রী উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে হাওড়া থেকে ওঠেন ৯৭৮ জন। বাকিরা আসানসোল এবং ধানবাদ থেকে।
বর্ধমান স্টেশন থেকে শনিবার রাতে কালকা মেলে উঠেছিলেন মোট ৭২ জন যাত্রী। হাওড়া থেকে কানপুরগামী বিশেষ ট্রেনটিতে তাঁদের আত্মীয়েরা দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন বলে স্টেশন ম্যানেজার জানান। অন্য দিকে, আসানসোল স্টেশন থেকে ১৩৫ জন দুর্ঘটনাগ্রস্ত প্রথম ১৩টি বগিতে ছিলেন। বিশেষ ট্রেনে রওনা হয়েছেন তাঁদের পরিজনেরাও। রেল সূত্রের খবর, শিয়ালদহ স্টেশনে একটি কন্ট্রোল-রুম খোলা হলেও সেখানে খোঁজখবর নিতে বিশেষ কেউ যাননি। রাতে হাওড়া থেকে যে বিশেষ ট্রেন ছাড়ে, তাতে ওঠার ‘পাস’ বিতরণ করা হয় স্টেশন ম্যানেজারের ঘর থেকে। ওই ট্রেনেই ওঠেন রামকুমার নাগ্রা, যাঁর শ্যালক-শ্যালিকা, আশুতোষ ও মিঠু বর্মা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন বলে শুনেছেন তিনি। রওনা হওয়ার আগে উদ্বিগ্ন রামকুমারবাবু কোনও মতে বলেন, “শুনেছি মিঠু এখনও ট্রেনের তলায় আটকে। আশুতোষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কে জানে, গিয়ে কী দেখব!” |
ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
|
|
|
|
|