|
|
|
|
ঠাকুরদার কাছে আর যাওয়া হল না লতিকার |
প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায় ও অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় |
রাত সাড়ে ৮টা। ১০এ মোমিনপুর রোডের দোতলা বাড়ির একতলার ছোট্ট ঘরের বাসিন্দাদের চোখ তখন টিভি-র পর্দায়। মাঝেমধ্যেই বেজে উঠছে মোবাইল। কালকা মেলের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রতিবেশীদের ভিড় ধীরে ধীরে বাড়ছে ঘরের ভিতরে। কেমন আছে বিনোদ এবং মায়ার ছোট মেয়ে লতিকা? |
কালকা মেল দুর্ঘটনায়
মৃত লতিকা। |
টিভি চ্যানেলের ‘ব্রেকিং নিউজ’-এ যে-তরুণীর মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হচ্ছে, তাঁর নামের সঙ্গে মিল নেই গিলবার্ট পরিবারের ছোট মেয়ের। অথচ মিলে যাচ্ছে বাড়ির ঠিকানা। ফলে রাত পর্যন্ত কলকাতায় গিলবার্ট পরিবারের বিশ্বাস ছিল, লতিকা আহত। কিন্তু কানপুরে তাঁর আত্মীয়স্বজন তত ক্ষণে জেনে গিয়েছেন, লতিকা আর নেই।
শনিবার হাওড়া-নয়াদিল্লি কালকা মেলে এস-২ কামরার বছর বাইশের লতিকা যাচ্ছিলেন একাই। ইংরেজি স্নাতকোত্তরের প্রথম বর্ষের ছাত্রী লতিকা তিন বছর পরে যাচ্ছিলেন ঠাকুরদার বাড়িতে। |
|
তাঁকে ট্রেনে তুলে দিতে স্টেশনে গিয়েছিলেন পরিজনেরা। রবিবার কানপুর স্টেশন থেকে তাঁকে ঠাকুরদার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কাকা ডেভিড গিলবার্টের। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর এক ঘণ্টা আগে মলওয়াঁয় ট্রেন দুর্ঘটনা যে পরিবারের ছোট মেয়েটিকে কেড়ে নেবে, রবিবার রাত পর্যন্ত সেটা ভাবতেই পারছিলেন না কেউ। রাত সাড়ে ৮টায় লতিকার বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিতেই তাঁর দিদি অ্যাঞ্জেলিনা জানান, তাঁর কাছে খবর বোন ফতেপুর হাসপাতালে অচৈতন্য অবস্থায় রয়েছে। তাঁর কথায়, “বোনের সঙ্গে কাকা দেখা করতে পারেননি। ওখানে প্রচণ্ড ভিড়। বোন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।”
হাসপাতালে ছোট মেয়েকে দেখতে রাতেই কানপুরের জন্য বিমানের টিকিট কাটতে যান লতিকার বাবা বিনোদ গিলবার্ট। আজ, সোমবার তাঁরা সপরিবার কানপুর উড়ে যাবেন। লতিকার মা মায়া বললেন, “অনেক দিন ধরেই বলছিল, ঘুরতে যাবে। কিন্তু একা মেয়েকে কোথায় ছাড়ব! শেষে ও বলল, কানপুরে ঠাকুরদার বাড়ি যাবে। লেখাপড়ায় খুব ভাল আমার ছোট মেয়ে। কলেজের শিক্ষক হতে চায় ও।” মা এবং দিদি তখনও জানেন না, লতিকা আর নেই। জানেন তাঁর বাবা। |
|
মোমিনপুরের বাড়িতে দিদি অ্যাঞ্জেলিনা এবং মা মায়া গিলবার্ট। |
ফতেপুর হাসপাতাল থেকে রুবি (লতিকার ডাকনাম)-র কাকা ডেভিড গিলবার্ট জানালেন, এ দিন দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে কানপুরে পৌঁছনোর কথা ছিল কালকা মেলের। ভাইঝিকে স্টেশন থেকে আনার জন্য সাড়ে ১১টাতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ডেভিড। গিয়ে শুনলেন, ট্রেন এক ঘণ্টা দেরিতে চলছে। তখনও জানেন না, ভাইঝির সঙ্গে আর দেখা হবে না। এর পরে আচমকাই রুবির বাবা বিনোদের ফোন। ডেভিডের কথায়, “দাদার মুখেই প্রথম দুর্ঘটনার কথা শুনি। দাদা বলল, ঠিক কী হয়েছে, আমি যেন খোঁজ নিয়ে জানাই।” দেরি করেননি ডেভিড। পরিচিতদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, মলওয়াঁ স্টেশনের কাছে বেলাইন হয়েছে রুবির ট্রেন।
রোজ যে-ভ্যানে তুলে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে পৌঁছে দেন ডেভিড, তাতে চড়েই ঘটনাস্থলে যান তিনি। গিয়ে কী দেখলেন?
ডেভিড বললেন, “একটা ট্রেন যে এ ভাবে দুমড়েমুচড়ে যেতে পারে, তা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না! চিৎকার-কান্না মিলিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ ভেসে আসছিল।” ভাইঝির কামরা খুঁজতে খুঁজতে এক সময় তার সামনে পৌঁছলেন তিনি। তখনই চোখে পড়ল, টি শার্ট-জিন্স পরিহিত যে-তরুণীকে উদ্ধারকর্মীরা নিয়ে হাঁটছেন, তিনিই রুবি। তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন ওই তরুণী। ভাইঝিকে বাঁচানোর চেষ্টায় ডেভিড ও তাঁর সঙ্গীরা যখন ফতেপুর হাসপাতালে পৌঁছলেন, তত ক্ষণে সব শেষ। ডেভিডের কথায়, “ডাক্তারবাবু যে ভাইঝিকে মৃত ঘোষণা করবেন, তা ভাবতেও পারিনি।”
|
ছবি: দেবাশিস রায় |
|
|
|
|
|