মাথা খাওয়াও বিশেষ আর্ট
থিত আছে, এক দেশবিখ্যাত চিত্রতারকা না কি তাঁর অভিনেতা-পুত্রের মনখারাপ হলেই চাঙ্গা হতে একবারটি কলকাতা ঘুরে আসার উপদেশ দেন। পাবলিকের উচ্ছ্বাস-আদিখ্যেতায় মিইয়ে থাকা মুড চাঙ্গা করার ‘অব্যর্থ’ টোটকা। সাদা বাংলায় এ হল নিজের মাথা খাইয়ে আসা। ঠাট্টা নয়, এই মুড়ো বা মাথা খাওয়া একটি বিশেষ আর্ট আর তাতে বঙ্গজদের পারদর্শীতা বহু যুগের ঐতিহ্য। এ বিষয়ে কোনও মেমসাহেবের লেখা প্রাচীন ও বিস্মৃত বইয়ে বাঙালির মুড়ো-আস্বাদনের বহুল উদ্ধৃত ফিরিস্তি আওড়ানোর লোভ সামলানো কঠিন। If you are an adept you will know just how to hold your lips to the tiny cerebral cavity and with one suck of the breath have the taste of gods on your tongue. বাংলা তর্জমায় বলাই যায়, পোড়খাওয়া খাইয়ে সেই বিশেষ চুমুতে সিদ্ধ-ওষ্ঠ। কাঁটার প্রতিরোধ তুচ্ছ করে মাছের ঘিলুর কুঠরি ঠোঁটে চেপে এক নিঃশ্বাসে তার সুধারস শুষে নেওয়ার মুষ্টিযোগে না কি সাক্ষাৎ ঈশ্বর জিহ্বায় অধিষ্ঠান করেন। বিদেশিনী অবশ্য বাঙালির হেঁসেলের কুলপতি ইলিশের supremely tasty part মস্তিষ্ক নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু খানদানি মুড়ো-অনুরাগীদের কাছে রুই-কাতলার মোটা মাথাই পরম আদরের। রবীন্দ্র-উপন্যাস নৌকাডুবির রমেশ পাতে রোহিত মৎস্যের ‘উত্তমাঙ্গ’ দেখে বিহ্বল হয়েছেন তো ঝুম্পা লাহিড়ির গপ্পে ছিন্নমূল প্রবাসী বাঙালি বৌদি মার্কিন দেশের মেছো-বাজারে মুড়ো কিনতে গিয়ে ‘আওয়াজ’ খেয়ে অস্থির। কিছুটা অবাক আমেরিকান মাছওলার টিপ্পনি: অঃ বুঝেছি, বাড়িতে নির্ঘাত পোষা কুকুর আছে! অর্থাৎ, মাছ খেলেও তার ঘিলুসুদ্ধ শ্রীবদনও যে মনুষ্যের খাদ্যবস্তু হতে পারে দুনিয়ায় বাঙালি ছাড়া খুব বেশি প্রাণী তা বুঝে উঠতে পারেনি।
এই মুড়ো-মহিমার মাথার মুকুট বাঙালির মুড়ি ঘণ্ট। বোধ হয় মুড়ো থেকেই মুড়ি ঘণ্ট নাম। এই গোবিন্দভোগ চাল ও মুড়োর তরকারিতে ভাতকেও কেমন মুড়ি-মুড়ি দেখায়। ফি-দুপুরে ঘটিবাড়ির অন্দরমহলে সকড়ি পাতে ধ্যানগম্ভীর বেড়ালিনীর মতো চোখ বুজে মুড়োর কন্টকরাজি যারা থেঁতো করে ছাড়তেন সেই গিন্নিবান্নিরাও কিন্তু এই মুড়ো ঘণ্ট-শিল্পে পুবদেশীয়দের থেকে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে। কলকাতার শ্বশুরবাড়িতে বহুকাঙ্খিত মুড়ি ঘণ্টের চেহারা দেইখ্যা এক বাঙাল মাইয়ার তীব্র কালচারাল শক-এর কথা শুনেছি। মাগ্গোঃ মুড়ার গায়ে ঝরঝরে খটখটে ভাত। অনেক এ দেশি বাড়িতে মুড়ি ঘণ্ট পোলাওয়ের মত একটি সম্পূর্ণ পদ। সে-বস্তু চামচেয় তুলে শুধু-মুদু খাওয়া যায়। বাঙালরা আবার ভাতের সঙ্গে চটকে অ্যাত্তোটা ঘণ্ট না-খেয়ে শান্তি পাবেন না। মুড়ি ঘণ্টের চালটা রান্না হবে, মাছের প্রেমে মাখো-মাখো কিন্তু গলা-গলা নয়। পাস্তা প্রসঙ্গে ইতালিয়ানরা যেমন বলেন, আল দন্তে (al dente)। মানে কোমল কিন্তু দন্তোপযোগী (ইতালিয়ান শব্দটাও কেমন বাংলা-বাংলা শুনতে, ওদের নিশ্চয়ই কোনও বং-কানেকশন আছে)। তা ছাড়া, ঘটির দেশে মুড়ি ঘণ্টের দৌড় গোবিন্দভোগের সঙ্গেই। বাঙালদের ভাজা মুগের ডালযোগে মুড়ি ঘণ্টও বেশ উপাদেয়।
সেই মুড়ো আর বাঙালি কোনওটাই আজ নেই। মুড়োর স্বত্ব নিয়ে একান্নবর্তী বাড়ির রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতন ঘটেছে। আইবুড়োভাতে পাতে মুড়ো সাজিয়ে দিতে ক-ত মা-মেয়ের চোখ সজল হয়েছে। কিন্তু গেল ভোটের ইস্তেহারে কোনও পার্টিই মাছ কুটলে মুড়ো দেওয়ার কথা লেখেননি। বাঙালি পুরুষ ধুতি পরতে ভুলে যাওয়ার মত অবলীলাক্রমে মুড়ো কব্জা করতে পারেন এমন বং নারী-পুরুষ আজ সংখ্যালঘু। বৌদি হোন বা দাদা, এ কালে ভরদুপুরে ওই বেড়ালের মত মুড়ো চিবোনর অবসর গুটিকয়েক ভাগ্যবানের আছে। পুঁইশাক দিয়ে মুড়োর চচ্চড়ি, লাউযোগে আড়-পাঙাশের মুড়োয় খেশ্চান বাঙালি-ঘরের ঝোল-ঝোল কালতো কারির মত বহু মুড়ো পদ তাই ক্রমশ দুর্লভ। মুড়ি ঘণ্ট তবু উজান ঠেলে লড়ে যাচ্ছে। বাঙালি বিয়ে-বাড়ির মেনুতে বাঙালিয়ানা অনেক বছরই হল, ডিনার থেকে লাঞ্চ-পর্বে নির্বাসিত। সেই দ্বিপ্রহরে মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। একেলেরাও ঘণ্টের সেই মেছো স্বাদে আয়েশ করেন। কিন্তু মুড়োর কাঁটার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে অনেকেই অক্ষম। আবার রাজকীয় মুড়ি ঘণ্টের টানে দুপুরেই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে বর বা কনেকত্তাদের কারও কারও মনে হয়, উফ্ সন্ধের ইভেন্টটা একটু পিছিয়ে দিয়ে দুপুরটা লম্বা হতে পারলেই বেশ হত।
সিঙ্গাপুরে দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীতে রাঁধা ঝাল-ঝাল ফিশ হেড কারি নিয়ে বেশ আহা-মরি আছে। কিন্তু তা মুড়ি ঘণ্টের পাশে নস্যি। ক্যারিবিয়ন দেশে ভাত-মুড়োর সঙ্গে রাজমা, থাইমাদি সুগন্ধি হার্বস মিশিয়ে কী যেন নামের যে রান্নাটি হয় তা বোধ হয় এ গ্রহে মুড়ি ঘণ্টের সব থেকে কাছের জন। কিন্তু সে-ভাতেও চিকেন স্টক মেশে, আয়োজন ঢের বেশি। গোবিন্দভোগ চালটুকু বাদ দিলে বাঙালির মুড়ি ঘণ্ট নিতান্তই নিরাভরণ। ঘি, গরম মশলা ও ভাতের সুঘ্রাণের সঙ্গে পেঁয়াজের টক্করটাও বেশি হলে উচ্চকিত ঠেকে। বাঙালদের আবার মিষ্টি দেওয়া নিয়ে গোঁড়ামি আছে। কিন্তু শিল্পী-রাঁধুনের হাতে মুড়ি ঘণ্টের চালে মটরশুঁটি-কিসমিস পড়লে দিব্যি হয়। লীলা মজুমদারের প্রেসক্রিপশনেও এ কথা বলা আছে।
নেতা-নেত্রী, ফিল্মস্টার, ক্রিকেটার আর সর্বাধিক নিজের মাথা খাওয়া বাদ দিলে এই মুড়ি-ঘণ্টে আমাদের বিশেষ মস্তিষ্ক-চর্চা।
Previous Item Utsav Next Item



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.