পুস্তক পরিচয় ২...
বুদ্ধিমুক্তির সঙ্গে মানসমুক্তির বন্ধন
বিশ শতক, অলোক রায়। প্রমা, ২০০.০০
বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক অলোক রায় রচিত কয়েকটি বই পড়ার-ভাবার সুবাদে যখন এমনতর একটা ভাবনা আক্রমণ করছিল যে, অধ্যাপক রায় উনিশ শতক নিয়ে যতখানি ভাবনা করেন, সাম্প্রতকাল নিয়ে ততখানি নয়। কথাটা সাহসভরে বলতে পারা যাচ্ছিল না, কারণ ইতস্তত তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধের বিষয় দেখা গেল বিশ শতক কেন্দ্রিক। সব লেখা চোখে পড়ে না বিভিন্ন কারণে। এ হেন সময়ে গোটা বিশ শতক নামে তাঁর একখানি বই পড়ার অবকাশ ঘটে গেল।
তেত্রিশটি বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধের বই বিশ শতক। ‘প্রবন্ধ’ শব্দটি প্রয়োগ করতে একটু সঙ্কোচ জাগছিল, কারণ তিনি নিজেই সুকুমার সেন-কথিত ‘এসে’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘প্রবন্ধ’ শব্দটি ব্যবহারে তাঁর ‘সংরক্ষণ’-এর কথা বলেছেন এই বইয়ের একটি রচনায়। সে মতের বিচারের ফলের অপেক্ষা না রেখেও সহজেই বলা যেতে পারেএগুলি প্রবন্ধইএদের বন্ধন প্রকৃষ্ট তো বটেই, অনুমতি পেলে ‘উৎবন্ধ’ শব্দটি প্রয়োগ করতে পারি এমনই উৎকৃষ্ট তারা।
‘বিশ শতক’ শব্দটি সাধারণ অর্থে তিনি প্রয়োগ করেছেন কালের নিরিখে, কিন্তু মেজাজে আর মর্জিতে এরা বাস্তবিকই বিশ শতকের। এ কথা তিনি জানেন হঠাৎ একটা সাল-তারিখ দিয়ে সময়ের মর্জিকে ধরে রাখা যায় না, প্রগতির কতকগুলো লক্ষণ থাকে। কল্লোল যখন তথাকথিত ‘অশ্লীল’ সাহিত্য প্রচার করছিল, তখন ‘প্রগতি’ তাকে অতিক্রম করতে গিয়ে যে নাড়াটা দিয়েছিল তা ‘সবুজ পত্র’র অভীপ্সিত ‘জাগরণী মন্ত্র’ ছিল না কিন্তু সাহিত্যের ভূগোলটা যে বঙ্গভূমি অতিক্রম করে বিশ্বস্পর্শী হয়ে উঠেছিল সেটাকে ধরতে হবে। সেই ধরতাইটাই এই বইয়ের প্রাণ সজনীকান্তের শনি-দৃষ্টিতে বুদ্ধদেবের ক্ষতির চেয়ে বৃদ্ধিটাই বেশি হয়েছিলষাটোর্ধ্ব এক অধ্যাপককে অশ্লীলতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো ব্যাপারটা আঁচ করেই তো রবি ঠাকুরের ‘সাহিত্যধর্ম’ লেখা আর ‘বিচিত্রা’ বাড়িতে বসা সেই অতি-আধুনিকতার বিচারসভায় আধুনিকতার রায় ঘোষণা করা। প্রায়-সত্তর রবীন্দ্রনাথ যে বুদ্ধদেবদের চেয়েও কতখানি আধুনিক ছিলেন তা সে দিন বোঝা গিয়েছিল।
বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যটা আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে বিচিত্র আশ্রয়াশ্রয়ী হয়ে উঠেছিল। সমাজ-দেশ-কাল সংলগ্ন হয়ে ছিল কখনও গদ্য-আখ্যানে সাময়িকপত্র। গল্প-উপন্যাসে, কখনও বা দিনলিপি বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক রচনায়। এক এক সময় আবেগ এসে সাহিত্যকে বেগবতী করে আধুনিকতার অভিমুখী করে দিচ্ছিল। ১৯০৫-এর আবেগ আর ১৯৪২-এর আবেগে ফারাক অনেকখানি। ১৯০৫ নিয়ে সাহিত্যসৃষ্টি তো পরিমাণে-পরিমাপে জায়গা জুড়েছে অনেকখানি। পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধে ছয়লাপ ঘটেছিল, কবিতা ছেয়ে গিয়েছিল, গল্প-উপন্যাস-নাটক পিছিয়ে ছিল না। রবি ঠাকুর আর দ্বিজু রায়ের উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক রায় গতানুগতিকতার চর্চা করেননি। খোঁজ-না-জানা ‘মাদুলি’ আর ‘উকিলের বুদ্ধি’ গল্প বা ‘ত্যাজ্যপুত্র’ উপন্যাস তাঁর রচনার বিষয়বস্তু হয়। বহু চর্চিত বিষয়টির পুনর্বার চর্চায় তাঁর এই অনাগ্রহ তাঁর প্রবন্ধগুলির পাঠানুরক্তি বাড়িয়ে দেয়। এ ভাবেই আমরা যখন ‘ভারতী’ পত্রিকার ইতিহাস জানতে গিয়ে ‘মণিলালের আসর’ ছেড়ে বাইরে আসতে পারি না, তিনি তখন ‘জাদুঘর’ উপন্যাসে ‘কাজিনস আর অলওয়েজ দ্য বেস্ট টার্গেট’ শব্দবন্ধ প্রয়োগে আলোড়নকারী বর্তমান স্বল্পপঠিত নরেন্দ্র দেব-এর সঙ্গে ‘ভারতী’-র সম্পর্কযোগে মানুষটিকে নয় যুগচরিত্রকেই বিশ্লেষণে আগ্রহ
অনুভব করেন।
পত্রপত্রিকার (সবুজ পত্র-কল্লোল-পরিচয়-আদি) চরিত্র নির্ধারণ করার চেয়েও তাই তিনি ব্যক্তি-রচনার মধ্যে যুগধর্মের সন্ধান করেছেন বেশি করে। ধূর্জটিপ্রসাদ, তারাশঙ্কর, শিবরাম চক্রবর্তী (একমাত্র শিশুরাই তাঁকে শিশুসাহিত্যিক বলে চিহ্নিত করার অপরাধ ঘটিয়ে থাকে), প্রবোধকুমার সান্যাল, সতীনাথ ভাদুড়ী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়রা বিশশতকীয় ভাবনায় কতখানি নিমগ্ন ছিলেনতা বহুতর প্রমাণ সহযোগে অধ্যাপক রায় ব্যাখ্যা করেছেন। এই উদাহরণগুলি স্বতই প্রমাণ করে যে তিনি পূর্বনির্দিষ্ট তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় কতখানি বীতরাগ। এস ওয়াজেদ আলি এবং আবদুল জব্বারের সঙ্গে একটা অনতিশায়ী সম্পর্ক স্থাপন, ধূর্জটিপ্রসাদ নিয়ে আস্ত একটা বই তাঁর থাকলেও এখানে তিনি অনেক প্রগতিপন্থী না হলে ‘ধূর্জটিপ্রসাদের গল্প: মাংসাশী মনের পথ্য’ এমনতর ভাবনাপ্রয়োগ ঘটতে পারত না। মানিককে নিয়ে মার্কসবাদী বিতর্কে ক্লান্ত তিনি তবুও দুই দলে বিভক্ত বিতর্ক বিষ্ণু দে সম্পর্কে মানিকের উক্তি দিয়েই তিনি স্পষ্ট করতে পেরেছেন। পাঠককে মূল প্রবন্ধ পড়তে হবে, নইলে বোঝা যাবে না এই স্পষ্টীকরণ কতটা অনিবার্য।
ধূর্জটিপ্রসাদ আর ওয়াজেদ আলি দুজনেই ইংরেজি-বাংলা দুটোতেই চোস্ত। দুজনেই ‘সবুজ পত্র’-এ লিখেছেন এই সংবাদে তিনি থামেন না, টলস্টয় আর রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় মেলবন্ধন ঘটিয়ে যিনি আত্মাশ্রয় পান তিনি এই শতকের গল্প-উপন্যাসে যে নবীনতার অভিমুখী যাত্রা লক্ষ করেছেন-- তা অধ্যাপকসুলভতাকে ছাড়িয়ে রসিকসুলভ হয়েছে। একজন লেখকের সমস্ত প্রবন্ধই অবশ্যপাঠ্য কী ভাবে হয় বইটি তার উদাহরণ। আসলে সব প্রবন্ধেই বুদ্ধিমুক্তির সঙ্গে মানসমুক্তির একটা বন্ধন অনুস্যূত হয়ে আছে।
Previous Item Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.