পুস্তক পরিচয় ১...
অসাম্য দূর করার ফর্মুলাটি জোলো
বিয়ন্ড দি ইনভিজিবল হ্যান্ড/ গ্রাউন্ডওয়ার্ক ফর আ নিউ ইকনমিক্স, কৌশিক বসু। পেঙ্গুইন, ৩৯৯.০০
র‌্থনীতি বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞান আছে এমন কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় এই শাস্ত্রের সবচেয়ে পরিচিত শব্দবন্ধনী কোনটা, তা হলে হয়তো একটাই উত্তর শোনা যাবে অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী বাজারই সমাজের ভাগ্যনির্ধারক— প্রত্যেক মানুষের আত্মকেন্দ্রিক ব্যবহারের যোগ-বিয়োগের ফল আর্থ-সামাজিক শৃঙ্খলা আর দক্ষতা। যে রুটির টুকরোটা আমাদের টেবিলে পৌঁছয়, তা বেকারিতে তৈরি হয় আটা থেকে, যে আটা তৈরি হয় গম থেকে যা কিনা চাষির শ্রমগুণ আর বাজার থেকে কেনা বীজ আর সারের মিশ্র প্রক্রিয়ার ফল। স্মিথের মতে, চাষি বা বেকারি বা বীজ-সারের ব্যবসায়ী কেউই দানছত্র খুলে বসেনি। কোনও কেন্দ্রীয় বা অতিজাগতিক মধ্যস্থতা এর মধ্যে নেই (বা, যার দরকার নেই) যা কিনা এই চাকা চালাচ্ছে, অন্য আর কিছু নয়। বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’ ঠিক করে বিনিয়োগকারীরা কোন কারখানায় টাকা ঢালবে, কোন উৎপাদনকারী কী পণ্য তৈরি করবে, কী করেই বা তা পৌঁছবে খদ্দেরের দোরগোড়ায়।
বিগত দুশো পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে উদারপন্থী বা নয়া উদারপন্থী অর্থনীতি চর্চা। এমন নয় যে ‘অদৃশ্য হাত’-এর কোনও সমালোচনা হয়নি। কৌশিক বসু, তাঁর নতুন বইয়ের এক-তৃতীয়াংশ ধরে জানিয়েছেন অসংখ্য অর্থনীতিবিদদের বাজার-অর্থনীতি সম্পর্কে সন্দেহের কথা। যদিও বাজার-অর্থনীতির সবচেয়ে কড়া সমালোচক মার্কস এবং তাঁর ধারায় উদ্বুদ্ধ অর্থনীতিবিদদের ধ্যানধারণাকে তিনি সযত্নে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। বসু নিজে মার্কসীয় ‘ইউটোপিয়া’য় আকৃষ্ট, তবু তিনি মার্কসীয় তাত্ত্বিকতায় আস্থাহীন। বসু মনে করেন অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’-এর ভুল ব্যাখ্যার জন্যই এমন এক বাজার-তত্ত্ব গড়ে উঠেছে, যা নাকি বাস্তবতা থেকে শত হস্ত দূরে। স্মিথ হয়তো নিজেও ‘অদৃশ্য হাত’কে অতটা গুরুত্ব দেননি, যা তাঁর উত্তরসূরিরা দিয়েছেন। ‘ওয়েল্থ অব নেশনস’-এর প্রথম সংস্করণের নির্দেশিকায় ‘অদৃশ্য হাত’ ছিল না, বসু জানান। পরবর্তী সংস্করণে তা যোগ হয়। ফলত এই ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে যে তত্ত্ব গড়ে উঠেছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অবাস্তব বা অতি-সরলীকরণ। তার চেয়েও বড় কথা, আত্মকেন্দ্রিকতাকে মূল মন্ত্র করতে গিয়ে সামাজিক রীতিনীতিকে পাত্তা দেওয়া হয়নি। যদি মনে করা হয় পশ্চিমি উন্নত দেশের অর্থনীতিই হল প্রতিযোগিতার পীঠস্থান, তা হলে এটাও মনে করা দরকার যে এই সব দেশের সামাজিক রীতিনীতির মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে অনুশাসন লুকিয়ে থাকে, যার জন্য বাইরে থেকে সরকার বা অন্য কাউকে নিয়মকানুন আরোপ করতে হয় না। যেমন, বসু জানান, আমেরিকায় কোনও চাষির প্রয়োজন হয় না তার জমির চারি ধারে বেড়া দেওয়ার, কারণ বেআইনি জমিদখল সে দেশের সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে পড়ে না। যেমন, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা স্বাভাবিক ভাবেই দায়িত্ববান; তাঁদের ক্লাস নেওয়ার ওপর খবরদারি করার দরকার হয় না। যে সব দেশে সামাজিক রীতি-নীতি একটু ঢিলেঢালা, সেখানে দরকার বাহ্যিক অনুশাসন, হয়তো সাময়িক ভাবে, যতদিন না তা মজ্জাগত হচ্ছে। পশ্চিমি দুনিয়া কতটা স্ব-অনুশাসিত, তা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত থাকতে পারে। আমেরিকা যখন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলায় তা সে লিবিয়াই হোক বা পাকিস্তান, তা কি ব্যক্তি-আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে খুব আলাদা? বসু জানাননি।
বসু এই বই লেখেন কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক থাকাকালীন, ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হওয়ার ঢের আগে। বিশ্বায়ন, দারিদ্র আর অসাম্য নিয়ে গবেষণার কাজ বসু অনেক দিন ধরেই করছেন। পাঠককে মনে রাখতে হবে যে, এই বই ভারত তথা অনুন্নত বা উন্নতিশীল দেশে সরকারি মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নয়। অর্থাৎ, কোনও কেইনসীয় ফর্মুলা বসুর ঝুলিতে নেই। বাজার অর্থনীতিকে তিনি এক রকম মেনেই নিয়েছেন। অথচ বিশ্বায়ন কী ভাবে অসাম্য সৃষ্টি করছে এবং তার জন্য কী ধরনের সুরক্ষার জাল প্রয়োগ করা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা এই বইয়ে। এমনকী বইয়ের প্রথম অনুচ্ছেদের নাম ‘ইন প্রেইজ অব ডিসেন্ট’। অর্থাৎ, বিশ্বায়নের যে কঠোর সমালোচনা শুনি কানকুনে বা সিয়াটলে, তাতেও খানিকটা সায় আছে বসুর।
তবে বিশ্বায়নসৃষ্ট অসাম্য নিয়ে যত কাজ হয়েছে, তার বেশির ভাগই সংখ্যাতাত্ত্বিক কচকচানি বিভিন্ন দেশের মধ্যে উন্নয়নের ফারাক, রুজি-রোজগারের অসাম্য (অন্তর্দেশীয় বা আন্তর্দেশীয়) ইত্যাদি নিয়ে। বসু তৈরি করেছেন অসাম্য নিয়ে এক জটিল তত্ত্ব, যা কিনা উদারপন্থী অর্থনীতি চর্চার ভিত্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে। আর তার থেকেই উঠে এসেছে জাতীয় বা অতি-জাতীয় শাসনপ্রক্রিয়া বা সরকারি মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয় চরিত্র।
বইয়ের দশটার মধ্যে চারটে অনুচ্ছেদেই আছে নানান ‘গেম থিয়োরি’ মডেল। আর প্রথম দুটো অনুচ্ছেদে আছে ‘অদৃশ্য হাত’ দ্বারা তৈরি প্যারেটো ইক্যুলিব্রিয়ামের ছিদ্রান্বেষণ। বসু নিজেই সাবধান করে দিয়েছেন এ বই শুয়ে-শুয়ে পড়ার নয়, শিরদাঁড়া খাড়া রেখে বসে পড়ার। বইয়ের চেহারা বা প্রাঞ্জল ভাষায় আকৃষ্ট হয়ে বইটিকে সাধারণপাঠ্য মনে করলে দাঁত ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
প্যারেটো অপটিমালিটি, ন্যাশ ইক্যুলিব্রিয়াম ইত্যাদি জটিল সব তত্ত্বের মধ্য দিয়ে ভেসে গিয়ে মোট ফল যা দাঁড়ায়, তা হল বাজার অর্থনীতি সম্পর্কেই গভীর সন্দেহ। নানান গবেষণাপত্রের উল্লেখ করে বসু জানাচ্ছেন, বাজার অর্থনীতিতেও সামাজিক প্রভেদ থেকেই যায়, যার জন্য ‘অদৃশ্য হাত’-এর কারসাজি সব সময় ফলপ্রসূ হয় না। এ রকম একটা গবেষণায় এক জন কালো চামড়ার শ্রমিককে পনেরোটা আবেদনপত্র লিখতে হয় একটা ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়ার জন্য, যেখানে এক জন সাদা চামড়ার শ্রমিককে লিখতে হয় দশটা আবেদনপত্র, যদি তাদের অন্য সব যোগ্যতা একই থাকে, তা হলেও। এ সব ক্ষেত্রে বসুর মতে, সমর্থনবাচক প্রক্রিয়া অনিবার্য। ভারতবর্ষের মতো দেশে শিশুশ্রমিক বা আউটসোর্সিং সংক্রান্ত ধ্যানধারণা যা কিনা বহু ক্ষেত্রেই বিশ্বায়নের সঙ্গে যুক্ত তাও পরিমার্জিত হয়ে যায় সামাজিক প্রভেদ আর সরকারি মধ্যস্থতা নিয়ে আলোচনায়। ‘অদৃশ্য হাত’-এর দয়ায় বসে থাকলে এই প্রভেদ ঘোচানো অসম্ভব।
আত্মকেন্দ্রিক বাজার-মনস্কতা তত্ত্বের আরও ছিদ্র বেরোয় বসুর ‘গোষ্ঠীর রসায়ন’ অনুচ্ছেদে। আচরণ-ভিত্তিক অর্থনীতির মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ সব সময় কেবলই আত্ম-সন্তুষ্টিতে মন দেয়, তাও ঠিক নয়। অপরের ভালর জন্য কাজ করেও অনেকে সুখ পায়। সে ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন আর ব্যক্তিগত বাজেট দিয়েই ইক্যুলিব্রিয়াম না-ও আসতে পারে।
এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্য অবশ্য বাজার অর্থনীতি থেকে সরে আসার জন্য তদ্বির নয়। যদি তা হত, তা হলে বসুর এখনকার সরকারি ভূমিকা, যা অনেকাংশে বাজার অর্থনীতি প্রসারে নিয়োজিত, তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেশ মুশকিল হত। তাঁর মতে, বাজার অর্থনীতির খাঁচার মধ্যেই সুরক্ষার জাল তৈরি করা সম্ভব। এতে সরকারের অভ্যন্তরীণ সমর্থনমূলক কর্মপন্থার সুযোগ থাকবে। অতি-জাতীয় স্তরে দরকার মাল্টিল্যাটারাল সংস্থার আই এম এফ, ডব্লিউ টি ও ইত্যাদি উন্নততর শাসনপ্রক্রিয়া। তবে এটা দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ উপায় বলেই বসু মনে করেন। আন্তর্দেশীয় অসাম্য দূর করার সবচেয়ে ভাল উপায় বিশ্ব-শাসনপ্রক্রিয়া। কিন্তু সে তো আর এক ইউটোপিয়া।
মুশকিল হল এই মাল্টিল্যাটারালিজমের তত্ত্ব নিয়েই। বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই তো ভারত চিনের মতো উন্নয়নশীল দেশ ডব্লিউ টি ও-তে যথেষ্ট সমীহ আদায় করে আসছে। এমনকী দোহা রাউন্ড প্রায় বানচাল হতে বসেছে উন্নয়নশীল দেশের দাবিদাওয়ার চাপে। তার জন্য কি বহুজাতিক সংস্থার দৌরাত্ম্য আর অন্তর্দেশীয় বা আন্তর্দেশীয় অসাম্য কিছুমাত্র কমেছে? বসুর বইয়ের অসাম্য নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা আকর্ষণীয়, অসাম্য দূর করার ফর্মুলাটি যেন খানিকটা জোলো।
First Page Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.