|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
তুড়ি মেরে বয়স তাড়ান |
খালি ভেবে নিতে হবে ‘বুড়ো হব না’। বাকিটা সহজ। কী রকম? লিখছেন দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য |
বুড়ো হওয়ার সংজ্ঞাটাই যে পাল্টে ফেলেছেন অম্লান চৌধুরী, মায়া গুপ্ত, রত্না মিত্র বা রাজীব দত্তরা! সত্যি বলতে ‘বুড়ো’ শব্দটাকেই লোপাট করে দেবার পণ করেছেন যেন। এঁরা কেউ ৬০-এর পরও অবসর নেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। কারও কাছে আবার স্বামী-স্ত্রী মিলে অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়াটাই যৌবনের জিয়নকাঠিসত্তর পেরিয়েও। আবার কেউ ষাটের পরেও খুঁজে নেন দুরন্ত ‘নাইটলাইফ’।
উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের কর্তা অভিলাষ গুপ্ত। অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। সঙ্গী বলতে তাঁর স্ত্রী মায়াদেবী। নিঃসন্তান। তাই বলে জীবনে রঙের অভাব নেই। অভিলাষ ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবন দু’জনের। অভিলাষ এই তিয়াত্তরেও স্বচ্ছন্দে পরেন শর্টস আর রঙিন টি-শার্ট। গিন্নিকেও জিন্স-কুর্তিতে স্বচ্ছন্দ করে তুলেছেন। এটা কি নিছকই ফ্যাশনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা? জবাবটা দিতে গিয়ে হেসে ফেললেন মায়াদেবী। “ও বরাবর ফ্যাশন-দুরস্ত। তবে আমি জিন্স ধরেছি খানিকটা বাধ্য হয়েই। দু’জনে নানা দেশ ঘুরে বেড়াই। সেখানে শাড়ির থেকে জিন্সেই সুবিধে।” চির-যুবা অভিলাষবাবুর কাছে এই ঘুরে বেড়ানোটাই জিয়নকাঠি। তাঁর ব্যাখ্যা, “দারুণ আনন্দে আছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ ভাবেই বাঁচতে চাই।”
গিন্নিবিহীন একেবারে উল্টো জীবনদর্শন প্রাক্তন সেনাকর্তা রাজীব দত্তর। যৌবন অটুট রাখতে বাঁধাধরা ছকে হাঁটেননি কোনও দিন। সেই সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া থেকেই বেপরোয়া। জীবনে বহু নারী এসেছে। কিন্তু গাঁটছড়া বাঁধেননি। চুরুটটা ধরিয়ে তাকাতেই বোঝা গেল এই চোখের আগুন এখনও অনেককে জ্বালাচ্ছে। বললেন, “আমি হলাম রাতের অতিথি। দিনে ঘুমোই। আর গোটা রাত উপভোগ করি,” গলার স্বরে গর্ব। ষাট পেরিয়েও বয়সকে বাগ মানালেন কী করে? রাজীববাবুর সহজ যুক্তি, “আমি মানি, নাইট ইজ স্টিল ইয়ং, লাইফ অলসো ইজ স্টিল ইয়ং।” |
|
হাতের কাছেই সহজ পথ |
‘লাইফ অলসো ইজ স্টিল ইয়ং’এটাই বোধহয় মূল মন্ত্র এই সব চিরতরুণদের। কসমেটিক সার্জন ড. মনোজ খন্না যেমন বলছেন, “বলিরেখা ঢাকা, চোখের তলার মেদ কমানো, এগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি ৫০ থেকে ৬৫ বছরের পেশেন্টদের মধ্যে। ঢুকে যাওয়া গালকে ভরাট করা আর ‘ডাব্ল চিন’ মেরামতের চাহিদাও বেশি। আর বোটক্স তো আছেই। তবে সবচেয়ে বেশি চাহিদা হল হেয়ার গ্রাফ্টিংয়ের।” সে কথাই স্বীকার করে নেন সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়। “বুড়ো বয়সে তারুণ্যের জোয়ার? সমাজ সেটা মেনে নিয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। না হলে ‘চিনি কম’-এর মতো ছবি এত বড় হিট হয়?” বলছেন তিনি।
আর এই তারুণ্যের জোয়ারের প্রমাণ পাচ্ছেন জিম মালিক থেকে বিউটিশিয়ান, ডায়েটিশিয়ান থেকে ডাক্তার সবাই। যত দিন যাচ্ছে, তাঁদের ‘ক্লায়েন্ট’দের গড় বয়স যেন বেড়েই চলেছে। মধ্য কলকাতার একটি জিমের কর্ণধার যেমন জানালেন, তাঁর ওখানে নিয়মিত আসেন ষাটোর্ধ্ব তিন জন। তার মধ্যে এক জন মহিলাও আছেন। যাঁরা অতটা পারেন না, তাঁদের রুটিনে ঢুকেছে ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম, যোগা আর লাইট ডায়েট। শরীরটাকে যে ধরে রাখতেই হবে! ভুঁড়ি কমাতে কেউ যন্ত্রে দৌড়চ্ছেন, কোমর সরু করতে কেউ যোগ দিয়েছেন নাচের ক্লাসে, হাতের থলথলে ভাব কাটাতে কেউ করছেন অ্যারোবিক্স।
বিউটি-পার্লারে পঁচিশ-তিরিশের সঙ্গে পঞ্চান্ন-ষাটরাও দিব্যি আনাগোনা করছেন। আর তাঁদের চাহিদা মেনেই রয়েছে নানা ধরনের ফেশিয়াল, মাসাজ। ত্বক টানটান রাখতে, চোখের তলার কালি ঢাকতে হাজারো রেসিপি। সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ গৌরী বসু বলছেন, “চেহারায় বয়সের ছাপ আটকাতে ত্বক পরিচ্ছন্ন রাখা খুব জরুরি। পলিউশন ও ট্যানিং আটকাতে রোজ ‘রিপেয়ার প্যাক’ ব্যবহার করতে হবে। কোন ত্বকের জন্য কী প্যাক, তা জানতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। এ জন্য দিনে ১৫ মিনিটের বেশি লাগে না। সপ্তাহে এক বার না হলে ১৫ দিনে এক বার ‘রিট্রাম টোনিং’ করা জরুরি। প্রয়োজন মতো ফেশিয়ালও করা যেতে পারে। তা ছাড়া, ত্বকের যত্নে রয়েছে ‘স্টেম থেরাপি’র মতো আধুনিক ব্যবস্থা। এই মাইক্রো রিপেয়ার সিস্টেমে কাটাছেঁড়ার প্রশ্নই নেই। সম্পূর্ণ আরামদায়ক পদ্ধতি। খরচও সাধ্যের মধ্যে, ৫০০-৬০০ টাকা থেকে শুরু।”
|
মর্নিং ওয়াক? সে তো বুড়োরা করে। ষাট থেকে সত্তরের ‘যুবক-যুবতী’রা আজকাল
পাল্লা দিয়ে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশের-এর ভিড়ে ট্রেডমিলে দৌড়চ্ছেন।
|
বিউটি পার্লারগুলোয় শুধু বৌদি নয়। মাসিমাদের ভিড় বাড়ছে। শুধু ২৫ না,
৬৫-ও এখন করাচ্ছে ‘হেয়ার স্পা’ থেকে ‘বডি মাসাজ’। |
কসমেটিক সার্জনদের কাছে দিন-দিন বাড়ছে হেয়ার-উইভিং-এর চাহিদা। টাককে টা টা করাটাই এখন ফ্যাশন। |
|
|
ডায়েটটা দেখে নিন |
তবে যত্ন মানে শুধু গাঁটের কড়ি খসিয়ে জিমে গিয়ে কসরত আর নিত্যনতুন বিউটি-থেরাপি নয়, দরকার জীবনযাত্রায় রদবদলও। ডায়েটেশিয়ান মিতা শুক্লর মতে, “রোজকার স্ট্রেস, টেনশন তো চাইলেই কমিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু নিয়মমাফিক খাওয়াদাওয়া আর হাল্কা ব্যায়াম এতেই অনেকখানি কাজ দেয়।” তবে শুধু বাইরে নয়, শরীরের যত্ন ভিতর থেকেও নিতে হয়। এবং এ ক্ষেত্রে জলের কোনও বিকল্প নেই। ১২-১৪ গ্লাস জল দিনে নিয়ম করে খেতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে ওষুধের পরিবর্তে ইসবগুল, পাকা কলা ও পেঁপে খেলে ভাল। একটু বেশি বয়সে সপ্তাহে এক দিন খালি পেটে চিরতার জল খেলে অত্যন্ত উপকার হয়।
ত্বক বিশেষজ্ঞ সুদীপ দাস জানাচ্ছেন, “বয়স কম দেখাতে মেডিক্যালি ও সার্জিকালি, দু’ভাবে চিকিৎসা হয়। প্রথম ক্ষেত্রে সানস্ক্রিন লোশন ও নানা ধরনের ওষুধ দিয়ে ত্বক টানটান রাখা হয়। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিতে করা হয় অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচার কিছুটা খরচসাপেক্ষ হলেও ভয়ের কোনও কারণ নেই।”
আসল কথা হল বুড়ো না হতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। ইংরেজি অভিধানে তো ‘অ্যামর্টাল’ শব্দটাই ঢুকে গেছে। তার বাংলা কী হবে? অকাল তারুণ্য না অকাল যৌবন? আরে দূর! ‘অকাল’ হতে যাবে কোন দুঃখে? ‘চিরতারুণ্য’ই না হয় ধরে রাখলেন সারা জীবন।
আর কেউ ‘বুড়ো’ বললে? মনে মনে আওড়ে নিন অমিতাভ বচ্চনের আগামী ছবির নাম ‘বুড্ঢা হোগা তেরা বাপ’... |
|
|
|
যৌবন পথ |
চোখের তলায় কালি বা ঝুলে পড়া আই ব্যাগস আর সমস্যা নয়। আছে কসমেটিক থেরাপি-- বোটক্স, হেয়ার গ্রাফ্টিং, বলিরেখা ঢাকা, চোখের তলার মেদ কমানো আর ‘ডাব্ল চিন’ মেরামত।
টাক ঢাকার জন্য অল্প খরচে হেয়ার উইভিং যেমন আছে তেমনি আছে পাকা চুল রঙিন করার জন্য নানা শেডের হেয়ার কালার। কলকাতায় আজকাল ভাল পরচুলাও পাওয়া যাচ্ছে। এমনকী ওয়েব সাইটে অর্ডার দিলে বিদেশি পরচুলাও আপনার দরজায় পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ বুড়ো বয়সের চুলের কোনও সমস্যাই আর সমস্যা নয়।
শেপে থাকতে জিমে ভর্তি হয়ে ট্রেডমিলে হাঁটতে পারেন। ট্রেনারের সাহায্যে আরও নানা রকমের ব্যায়াম করতে পারেন। যেমন বেলুন নিয়ে ট্রেনিং। যোগব্যায়াম এবং নানা ধরনের ফ্রিহ্যান্ডও করতে পারেন।
পেট ঠিক না থাকলে মুখে চোখে যতই মেশিন চালান আর সার্জারি করুন, চালাকিটা ধরা পড়তে সময় লাগবে না। বয়স সত্যি হয়েছে এটা মাথায় রেখে হাল্কা আর পরিমিত খান। রেড মিট, চিনি, কাঁচা নুন, ডিমের কুসুম নয়। ফল আর শাকসব্জির পরিমাণ খাবারে বেশি রাখুন।
রোমান্সের চাহিদাটা জীবন থেকে উধাও হতে দেবেন না। সোস্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটে গিয়ে বন্ধুত্ব করুন। চ্যাট করতে করতে অল্প বিস্তর ফ্লার্টও মন্দ নয়। দেখবেন শরীর আর মন দুই-ই তাজা থাকছে।
জিন্স, টি-শার্ট, স্কার্ট, কুর্তি পরে দেখুন। আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝবেন এক নিমেষে বেশ কয়েক বছর বয়স কমে গেছে। উজ্জ্বল রং-এর পোশাক পরুন।
বয়স হলে চোখের মণি কেমন ঘোলাটে লাগে। পাল্টে ফেলতে রঙিন লেন্স পরে দেখতে পারেন। এক ঝটকায় বয়স অনেকটা কম লাগবে।
চশমার ফ্রেমটা মন দিয়ে বাছুন। বুড়োটে কালো ফ্রেম পাল্টে রঙিন কেতাদুরস্ত ফ্রেম পরুন। আজকাল চশমাটাও তো স্টাইল স্টেটমেন্ট। |
(টিপ্সগুলি নানা ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া) |
|
|
|
|
|