প্রয়োজনে কথা রাজ্যের সঙ্গে
মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত স্থিতাবস্থা থাকুক সিঙ্গুরে, আর্জি টাটাদের
মামলায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে সিঙ্গুরের জমি নিয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাল টাটা মোটরস। শুক্রবার, মামলার তৃতীয় দিনে টাটা মোটরস-এর পক্ষ থেকে তাদের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সৌমিত্র পালের এজলাসে এই আবেদন জানান। সে ক্ষেত্রে তাঁরা (অর্থাৎ টাটারা) যে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতেও ইচ্ছুক, সে কথাও জানিয়েছেন সমরাদিত্যবাবু। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি সৌমিত্র পাল রাজ্য সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্রর মতামত জানতে চাইলে তিনি জানান, সোমবার এই নিয়ে মতামত দেবেন।
ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে ‘সিঙ্গুর জমি পুনর্বাসন ও উন্নয়ন আইন ২০১১’ তৈরি করে তা প্রয়োগ করে সিঙ্গুরে টাটার জমি ফিরিয়ে নিয়েছে রাজ্য সরকার (সেই প্রয়োগের বিরুদ্ধেই চলছে বর্তমান মামলা)। আইনটির বিধি প্রণয়নও হয়ে গিয়েছে। মামলা শুরু হলেও এই আইনের প্রয়োগের উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ জারি হয়নি। তাই রাজ্য সরকার ইচ্ছে করলে এখনও সিঙ্গুরের জমি বণ্টন শুরু করে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতেই সমরাদিত্য পাল টাটাদের তরফে এ দিন জমিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আবেদন করেছেন। প্রয়োজনে তাঁরা যে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন।

অনিন্দ্য মিত্র

অ্যাডভোকেট জেনারেল

সমরাদিত্য পাল

টাটাদের আইনজীবী
ক্ষতিপূরণের দাবি যেন
জমি আটকে মুক্তিপণ
আদায়ের চেষ্টা।
অধিগ্রহণ করতে হলে জমি
যার হাতে তাকে ক্ষতিপূরণ
দেওয়ার কথা। তা হয়নি।
কিন্তু শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত যা খবর, তাতে রফাসূত্র খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে টাটাদের আলোচনার প্রস্তাব রাজ্য সরকারের মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার নীতি ও লক্ষ্য নিয়েই ক্ষমতায় আসার পরে সময় নষ্ট না করে আইনটি পাশ করিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার টাটারা যে আর্জি জানিয়েছে, তাতে রাজ্য সরকারের আইনজীবী মহলের একাংশ মনে করছে, তারা এক ধাপ পিছু হটল। কিন্তু অন্য এক অংশের বক্তব্য, এটাকে মোটেও পিছু হটা বলা যাবে না। কারণ, সিঙ্গুরের জমি আইনকে অসাংবিধানিক বলে টাটারা যে মামলা করেছে, সেখান থেকে তো তারা এখনও পিছু হটেনি। বরং অনেকের ব্যাখ্যা, সরকার যদি স্থিতাবস্থা বজায় না রেখে মামলা চলাকালীন জমি বণ্টন শুরু করে দেয়, সে ক্ষেত্রে টাটারা কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় চলে যেতে পারে। আদালতের কাছে তারা প্রশ্ন তুলতে পারে, তা হলে আইনটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এই মামলার আর কী অর্থ রইল!
এই আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া ছাড়া এ দিন কিন্তু যথারীতি যুদ্ধং দেহি-ই ছিল দু’পক্ষ। টাটাদের পক্ষে শুক্রবারও সওয়াল করেন সমরাদিত্য পাল। সওয়ালের আগাগোড়াই তিনি আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সিঙ্গুর আইনটি অসাংবিধানিক। তা ছাড়া, এ ভাবে জমি ‘অধিগ্রহণ’ করলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টিও এসে পড়ে বলে জানান তিনি। সমরাদিত্যবাবুর সওয়ালের শেষে এ দিন রাজ্য সরকারের পক্ষে অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্রও পাল্টা সওয়াল শুরু করেন। সেখানে তিনি ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গটি উড়িয়ে দেন। বলেন, এ যেন জমি আটকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা।
এ দিন প্রথমে হাইকোর্টের নির্দেশমতো সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানা এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে একটি রিপোর্ট জমা দেন হুগলির জেলাশাসক। সেই রিপোর্টে বলা হয়, এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় ছ’জন ডিএসপি-র নেতৃত্বে ৫৯১ জন পুলিশকর্মী মোতায়েন আছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে। ২২ এবং ২৩ জুন অজ্ঞাত পরিচয় কয়েক জন ব্যক্তি প্রকল্প এলাকা থেকে কিছু জিনিস নিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। এর পরে টাটাদের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল বলেন, যে সব বিষয় যৌথ তালিকায় রয়েছে, তা নিয়ে যদি কোনও কেন্দ্রীয় আইন এবং রাজ্য আইন থাকে এবং সেই আইন দু’টি যদি পরস্পর বিরোধী হয়, তা হলে কেন্দ্রীয় আইন-ই প্রযুক্ত হবে। সংবিধানের ২৫৪ ধারায় পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা আছে। জমি অধিগ্রহণ বিষয়টি কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকায় পড়ে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় আইন রয়েছে। তাই সম্প্রতি রাজ্য বিধানসভায় যে আইনটি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। জমি পুনর্দখল কতটা অসাংবিধানিক, তা বোঝাতে গিয়ে সমরাদিত্যবাবু জানান, যে কোনও রাজ্য সরকারকে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের সময় দেশের আইন ও সংবিধান নেমে চলতে হবে। গায়ের জোরে কোনও কিছু দখল করে নেওয়াটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিফলন নয়। সিঙ্গুরে জমি যে ভাবে দখল করা হয়েছে তা অসাংবিধানিক।
কী ভাবে? তাঁর ব্যাখ্যা, “২০ জুন বিলটি আইনে পরিণত হল। ২১ জুন বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা জানতে পারলাম, ওই জমি রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করবে। কয়েকটি গাড়িতে চেপে কারখানার গেটের সামনে এলেন হুগলির জেলাশাসকের অফিসের কয়েক জন কর্মী। তাঁরা জানালেন, রাজ্য সরকার ওই জমির দখল নেবে। আমাদের নিরাপত্তা রক্ষীরা তা কলকাতার অফিসে জানালেন। আমরা গোটা বিষয়টি তখনই জানতে পারলাম। তার পরে যা ঘটল তা আরও অসংবিধানিক।”
সমরাদিত্যবাবুর বক্তব্য, রাত সাড়ে আটটায় হুগলির জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপার কারখানার গেটে হাজির হন। একটি নোটিসও তখন সাঁটা হয়। সেটি সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে উদ্দেশ করে লেখা। যাঁর অফিস মুম্বইয়ে। সাধারণত জমি যার হাতে, তাকে তুলতে প্রথমে নোটিস দিতে হয়। তাদের বক্তব্য শোনা হয়। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি হয়। তার পরেও সে না সরলে তাকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু টাটাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাঁর আরও বক্তব্য, অধিগ্রহণ করতে হলে সেই জমি যার হাতে, তাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। প্রশাসন মর্জিমাফিক চলেছে। তাঁর যুক্তি, জোর করে উচ্ছেদ করাটা অসংবিধানিক। তাদের সঙ্গে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে কথা বলতে হবে। সময় নিতে হবে। সেই সুযোগটা টাটাদের দেওয়া হল না।
এর পর এ দিনই সওয়ার শুরু করেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্র। তিনি বলেন, “২০০৬ সালের চুক্তির পরে ইতিমধ্যে যথেষ্ট সময় পার হয়ে গিয়েছে। টাটারা কারখানা চালু করেনি। তিন বছর সময়ের মধ্যে কারখানা চালু না হলে জমি ফিরিয়ে নেওয়া যায়।” অনিন্দ্যবাবুর যুক্তি, ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর টাটারা তৎকালীন রাজ্য সরকারকে জানায়, তারা কারখানার যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিয়েছে। এখন তা হলে সেখানে কী রয়েছে যা ক্ষতিগ্রস্ত বলে অভিযোগ করা হচ্ছে? চুক্তি অনুযায়ী রাজ্য সরকার তো টাটাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল। তা হলে ক্ষতিপূরণ কীসের জন্য? এ যেন জমি আটকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা!
অনিন্দ্যবাবুর বক্তব্য, “ক্ষতিপূরণ বরং দাবি করতে পারে রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগম। টাটারা নয়। টাটারা তো নিগমের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়েছে।” অ্যাডভোকেট জেনারেল আরও বলেন, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে প্রতিযোগিতার বাজারে টাটাদের সব রকম আর্থিক সুবিধা দিয়েছিল রাজ্য। সেই শর্তেই টাটারা এখানে এসেছিল। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, রাজ্যে কর্মসংস্থান এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। কিন্তু তা হয়নি। কোনও একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, বন্ধকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ২০০৮ সালে টাটারা প্রকল্প গুটিয়ে অন্য রাজ্যে চলে যান। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যায়, সে জন্যও অপেক্ষা করেনি। এর জন্য রাজ্য সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগম কোনও ভাবেই দায়ী নয়।
Previous Story South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.