|
|
|
|
হারিয়ে গিয়েছে
বাবুই-কোকিল, বাড়ছে কাক
কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি |
আমার শিলিগুড়ি |
|
|
কী ভাবে দূষিত হচ্ছে ‘আমার শিলিগুড়ি’। শহর ও লাগোয়া এলাকার আকাশ-বাতাস, নদী-নালা-পুকুর
যেন রোগের উৎস হয়ে উঠছে। নিঃশব্দে মারণ রোগ-ব্যাধির জীবাণু বাসা বাঁধছে শরীরে। কী ভাবে এই শহরকে
দূষণের হাত থেকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে, পরিবেশপ্রেমী, বিশেষজ্ঞ সহ আমজনতা কী ভাবছেন
তা নিয়ে আনন্দবাজারের ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজ পঞ্চম ও শেষ কিস্তি। |
এ কোন শিলিগুড়ি!ভরা বসন্তেও কোকিলের দেখা মেলা মুশকিল। ক্রমশ বিরল হচ্ছে প্যাঁচা, বাবুই, চন্দনা, খঞ্জনারা। প্রায় হারিয়ে গিয়েছে শকুন, হাড়গিলে। নগরায়নের প্রয়োজনে উপনগরী, বহুতল গড়ে ওঠার জেরে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পুরানো সব গাছ। ১৫-২০ বছর আগেও পাড়ায়-পাড়ায় তেঁতুল, জামরুল, কামরাঙা, আমলকী, ডুমুর, আম, কাঁঠাল গাছের অভাব ছিল না। এখন প্রায় দেখা যায় না। আবর্জনা ও দূষণে ভারাক্রান্ত শহরে বাড়ছে কাক।
এ সব তথ্য-পরিসংখ্যান মিলেছে হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) সমীক্ষায়। গাছ ও পাখি গণনার ওই কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে । এ যাবৎ যা তথ্য মিলেছে তাতেই শঙ্কিত পরিবেশপ্রেমীরা। শহরের বিদ্বজ্জনেরাও উদ্বিগ্ন। বাঘা যতীন পার্ক থেকে শুরু করে দেশবন্ধু পাড়া, আশ্রমপাড়া, হাকিমপাড়া, চম্পাসারি, শান্তিনগরপ্রায় সব জায়গা থেকে যে ভাবে মাঠ ও সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে তাতে এখনই কিছু করা দরকার বলে ভাবছেন প্রায় সকলেই।
শ্যামা চৌধুরীর কথা ধরা যাক। যিনি শিলিগুড়িতে ‘বাঁকাদা’ নামেই বেশি পরিচিত। হিলকার্ট রোডে তাঁর দোকান রয়েছে। সেখানে কেনাকাটার জিনিস সামনে থাকলেও দোকানের অন্দরে ছোট্ট গুদামে বোঝাই অসুস্থ পশু-পাখি। কারও ইঞ্জেকশন চলছে। কাউকে ‘ড্রপার’ দিয়ে খাওয়ানো হয়। কিং কোবরা, প্যাঁচার ছানা, ডানায় চোট পাওয়া বাদুড় সহ অসুস্থ প্রাণীকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করে চলেছেন ‘বাঁকাদা’। সমমনস্কদের নিয়ে তাঁদের একটি সংগঠনও রয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ‘বাঁকাদা’র অভিজ্ঞতা শোনা যাক। তাঁর কথায়, ‘‘চোখের সামনে ন্যাড়া হয়ে গেল হিলকার্ট রোড। কত গাছ ছিল সেবক রোডে! সব অদৃশ্য। পাড়ায়-পাড়ায় ফ্ল্যাট-কালচারের দাপটে কোপ পড়ল
হাজার-হাজার গাছে। পাখি, পোকামাকড় কোথায় যাবে! শহর ছেড়ে সব প্রথমে চা বাগানের দিকে কিংবা বৈকুণ্ঠপুরে ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। যে করেই হোক শহরে গাছ
বাড়াতেই হবে।”
সবুজ বাড়ানো ছাড়া যেউপায় নেই সেটা বোঝেন না এমন মানুষ শহরে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ কাজের কাজ হচ্ছে না। জনসংখ্যার চাপে নগরায়নের ধাক্কায় শহরের উপকণ্ঠে চা বাগান, গাছপালায় কোপ পড়ছে। বস্তুত পরিকল্পনা যাঁরা করেন, তাঁরা জানেন, এটা উন্নয়নেরই অঙ্গ। কিন্তু, উন্নয়নের জেরে যে সমস্যা হতে পারে তার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা জরুরি।
পরিকল্পনায় গলদ রয়েছে বলেই শহরের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে। এমনটাই মনে করেন হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের অন্যতম মুখপাত্র অনিমেষ বসু। অনিমেষবাবু বললেন, “কী সবুজ ছিল আমাদের শিলিগুড়ি! ভাবা যায় না। সেই তুলনায় এখন হতশ্রী। আশেপাশে এত উপনগরী গড়ার কাজ চলছে, পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা হচ্ছে। কিন্তু, কোনওদিন শুনিনি গাছপালা, ঝোপঝাড় উপড়ে ফেলার পরে পাখি, পোকামাকড় কোথায় যাবে, কী ভাবে বাঁচবে তা নিয়ে স্পষ্টভাবে কিছু ঘোষণা হয়েছে। উপনগরী গড়ে শহরের জনসংখ্যার চাপ ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হলে গোটা শহর যে এক দিন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তা পরিকল্পনার সময় মাথায় রাখা হচ্ছে না। এটাই আমাদের শহরের দুর্ভাগ্য।”
উদ্বেগ-হতাশার মধ্যে আশার আলোও আছে। কিছুদিন আগেই শহরের গা ঘেঁষে তৈরি হওয়া হিমাঞ্চল বিহার উপনগরীর বাসিন্দারা জোট বেঁধে গাছ লাগিয়ে পাখি ফেরানোর কাজে নেমেছেন। তাতে সামিল হয়েছেন শহরের একাধিক পরিবেশপ্রেমী সংস্থা। শিলিগুড়িতে পাড়ায়-পাড়ায় যে ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অসংখ্য সদস্য রয়েছেন, তাঁরা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ বর্জনে যে ভাবে সামিল হয়েছেন, সে ভাবেই শহরের দূষণ ঠেকাতে চাইছেন।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, শহরে বিদ্বজ্জনেরাও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে থাকায় ভীষণ উদ্বিগ্ন। যেমন বাঘা যতীন পার্কের বাসিন্দা গীতাংশু করের কথাই ধরা যাক। যিনি সাহিত্য জগতের সঙ্গে যুক্ত। গীতাংশুবাবুরা বাঘা যতীন পার্কের সবুজ ফিরিয়ে দমবন্ধ করা পরিবেশের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছেন। ওই
কাজে বাসিন্দারা তো বটেই, শহরের প্রবীণ আইনজীবী, বর্ষীয়ান সাহিত্যক, খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদদের সামিল করে এগোচ্ছেন। তাতে অনেক সময়ে হোঁচট খেলেও
দমতে রাজি নন তাঁরা। গীতাংশুবাবু বলেন, “বাঘা যতীন পার্কে পরিবেশ ফেরাতে বদ্ধপরিকর। এ কাজে শহর আমাদের পাশে।”
এ দৃষ্টান্ত আরও আছে। ডাবগ্রাম, আশ্রম পাড়া, মহানন্দা পাড়া, হাকিম পাড়া, চম্পাসারি, শান্তিনগর, সূর্যনগর, ভারতনগর, দেশবন্ধুপাড়া সহ শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দূষণ রুখে শিলিগুড়ির জৌলুস ফেরানোর জন্য জোট বাঁধছেন বাসিন্দারা। কোথাও পার্কের, কোথাও বা মাঠের হাল ফেরাতে। আবার কোথাও অটো, গাড়ি দূষণ ঠেকাতে নানা মহলে ছোটাছুটি করছেন তাঁরা।
দূষণ রুখতে শহরবাসীর জোট বাঁধার খবর পৌঁছেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছেও। তিনি বলেছেন, “আগে যা হওয়ার হয়েছে। শহরের পরিবেশের বিপর্যয় হতে পারে এমন কোনও পরিকল্পনা আর নেওয়া হবে না। এ আমার নিজের শহর। আমরা যা
করার করছিই। এ ব্যাপারে সকলের পরামর্শ নিচ্ছি। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
দলমত নির্বিশেষে শহরের প্রতি এই টান থাকলে ‘আমার শিলিগুড়ি’র জৌলুস ফিরতে অবশ্য খুব দেরি হওয়ার কথা নয়।
|
এ কোন শিলিগুড়ি |
একনজরে |
৪৭টি ওয়ার্ডে ফি মাসে ১০টি ফ্ল্যাটের ভিত হয়। তাই গড়ে ৫০টি পুরানো গাছ কাটা পড়ে।
বহুতলের কোপে বিপন্ন তেঁতুল, জামরুল, কামরাঙা, আমলকী, ডেউয়া, ডুমুর, আম, কাঁঠাল গাছ। |
পরিণতি |
বেঘর হচ্ছে প্যাঁচা, বাদুড়, অসংখ্য পোকামাকড়। |
হারিয়েছে
হাড়গিলে ও শেয়াল। |
বাড়ছে
কাক-শালিক-চিল। |
হারাচ্ছে
বাবুই, কোকিল, ময়না, চন্দনা, খঞ্জনা, লক্ষীপ্যাঁচা, চামচিকে, ভাম, বাদুড়। |
সূত্র: পুরসভা ও ন্যাফ |
|
(শেষ) |
|
|
|
|
|