বর্ষার শুরুতেই ত্রাহি ত্রাহি রব আরামবাগ মহকুমায়।
দ্বারকেশ্বর নদীতে সবে মাত্র ২৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে কংসাবতী ব্যারাজ থেকে। কিন্তু তাতেই বাঁধ ভাঙার উপক্রম প্রায় ১৪টি জায়গায়। এই বাঁধটি দেখভালের দায়িত্ব সেচ দফতরের। আরামবাগ ব্লকের মোবারকপুর, রায়পুর, সালেপুর, মানিকপাট, বসন্তবাটি, ভাবাপুর, শেখপুর, রাংতাখালি, বেড়াবেড়ে এবং ডহরকুণ্ডু গ্রাম ছুঁয়ে এই নদীটি খানাকুলের পশ্চিমের গ্রামগুলির পাশ দিয়ে রূপনারায়ণে মিশেছে। আরামবাগ ব্লকের নদী-সংলগ্ন গ্রামগুলির বাঁধের পলকা অংশ থেকে যে সব জায়গায় জল চোঁয়াচ্ছে, সেখানে সেচ দফতর বালির বস্তা ফেলছে। কিন্তু রায়পুরের দীর্ঘ বছর ধরে অকেজো স্লুইস গেট কাজ না করায় প্রচুর জল ঢুকছে রায়পুরের মাঠে। গ্রাম ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করে বিক্ষোভও দেখান মানুষ। প্রশাসনের কর্তারা এবং সেচ দফতরের বিশেষজ্ঞেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। আরামবাগ মহকুমা সেচ দফতরের আধিকারিক প্রিয়ম পাল জানান, আপাতত বাঁশের ঝাড় দিয়ে স্লুইস গেট সিল করা হচ্ছে। |
২০০৯ সালের ৮ জুন এই নদী বাঁধের ১৪টি জায়গাকে দুর্বল বলে চিহ্নিত করে অবিলম্বে সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল আরামবাগ ব্লক প্রশাসনের তরফে। তার মধ্যে স্লুইস গেটটিরও উল্লেখ ছিল। সুপারিশ সত্ত্বেও কেন সেটি মেরামত করা গেল না? এ বিষয়ে মহকুমা সেচ আধিকারিকের বক্তব্য, কাজ হয়েছিল। কিন্তু জলের তোড়ে গেট নামানো যাচ্ছে না। ঘটনাস্থলে হাজির থেকে কাজ তদারকি করছেন মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী। তিনি বলেন, “সকালে ৪০০ বস্তা বালির বস্তা দিয়ে জল আটকানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সে সব ধুয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা স্লুইস গেট সিল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।” মহকুমাশাসক জানান, স্লুইস গেটের এই অবস্থার কারণ খতিয়ে দেখা হবে। বিকেলের দিকে ঘটনাস্থলে আসেন হুগলির জেলাশাসক শ্রীপ্রিয়া রঙ্গরাজনও।
এ তো গেল সেচ দফতরের অধীনে থাকা বাঁধের হাল। ২০০৯ সালে বন্যার পরে পঞ্চায়েত সমিতির দেখভাল করার কথা ছিল যে সব বাঁধগুলির, সেগুলির অবস্থা আরও করুণ। আরামবাগ, খানাকুলের দু’টি ব্লক এবং পুড়শুড়ার উুপর দিয়ে যাওয়া আরও দু’টি নদী মুণ্ডেশ্বরী এবং দামোদরের বাঁধের মোট ১৮১ জায়গায় ভাঙন হয়েছিল ২০০৯ সালে। সেগুলির বেশ কিছু জায়গায় এখনও এক ঝুড়ি মাটিও পড়েনি বলে অভিযোগ। ২০১০ সালে বন্যা হয়নি আরামবাগ মহকুমায়। কিন্তু বাঁধের অবস্থা এখনও তথৈবচ। পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ নির্বিকারে বসে আছে বলে অভিযোগ বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষের। ডিভিসি জল ছাড়লেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আতঙ্কে ভুগছেন তাঁরা। আশঙ্কার কথা অস্বীকার করছেন না পঞ্চায়েত প্রধানেরাও।
আরামবাগের মলয়পুর ২ পঞ্চায়েত প্রধান সহদেব সামন্ত, আরান্ডি ২ পঞ্চায়েত প্রধান সুলেখা পাল, খানাকুলের শাবলসিংহপুরের পূর্ণিমা ঘোড়ুই, পুড়শুড়ার কেলেপাড়ার অনুপ মান্না প্রমুখের বক্তব্য, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কিছু কাজ হলেও তা দল ধরে রাখতে পারবে না। মাটি বিশেষ পাওয়া যায়নি। বালি দিয়ে বাঁধ মেরামত হয়েছে। শালবল্লা-বোল্ডার না দেওয়া হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বাঁধ সংস্কারের নামে সামান্য জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পুড়শুড়া পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা কিঙ্কর মাইতি বলেন, “চিলাডাঙি, পুড়শুড়া ২, শ্যামপুর পঞ্চায়েত এলাকার ২৮টি বাঁধ জোড়াতালি দেওয়া হলেও ভাঙামোড়া এবং কেলেপাড়া পঞ্চায়েতের ৬টি ভাঙনের ক্ষেত্রে এক ঝুড়ি মাটিও পড়েনি।” |
দ্বারকেশ্বরের জলে প্লাবিত বাঁধপাড়া। |
সংশ্লিষ্ট বিডিওদের বক্তব্য, উপযুক্ত তহবিলের অভাবে নদীবাঁধ ভাঙন রোধে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করা যাচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হলেও একশো দিনের কাজের প্রকল্পে সাময়িক ঠেকা-টুকু দেওয়া হচ্ছে মাত্র। হুগলির জেলার পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ দিলীপ বেরা বলেন, “আরামবাগ মহকুমায় নদীবাঁধগুলি সঠিক ভাবে মেরামত করতে হলে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা দরকার। সরকারি টাকা যেমন যেমন পাওয়া যায়, তেমন তেমনই কাজের ছাড়পত্র পায় পঞ্চায়েত সমিতিগুলি।”
আরামবাগ মহকুমায় সাধারণত বন্যার সময় সেপ্টেম্বর মাস থেকে অক্টোবর মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত। ২০০৯ সালের বন্যায় আরামবাগ ব্লকের মুণ্ডেশ্বরী নদীতে বাঁধ ভাঙে ৫৪টি জায়গায়। মেরামতির জন্য সে সময়ে খরচ ধরা হয়েছিল ৪ কোটি টাকা। পুড়শুড়া ব্লকে দামোদরের ভাঙন হয়েছিল ৩৫টি জায়গায়। জঙ্গলপাড়ার বড় একটি ভাঙন ছাড়া মেরামতির খরচ ধরা হয়েছিল ৮০ লক্ষ টাকা। খানাকুলের ২টি ব্লকে প্রবাহিত মুণ্ডেশ্বরী এবং দামোদর নদীর বাঁধ ভাঙার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪৮ এবং ৪৪টি জায়গায়। আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল ৬ কোটি টাকা। দু’টি ব্লক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, খানাকুলের নদীবাঁধ সঠিক ভাবে মেরামত করতে হলে কম পক্ষে ১৬ কোটি টাকা দরকার। একওশো দিনের কাজের প্রকল্পে সঠিক ভাবে বাঁধ সংস্কার হওয়া কার্যত অসম্ভব।
২০০৯ সালের পরে মাঝে এতকা বছর কেটে গেলেও কেন বাঁধের ১৮১টি জায়গায় মেরামতির কাজ সম্পূর্ণ করা গেল না? বিডিওদের বক্তব্য, বাঁধগুলি একশো দিনের কাজের প্রকল্পে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় জেলা পরিষদ। কিন্তু রাজনৈতিক ডামাডোলে এবং ভোট প্রক্রিয়ার কাজ সামাল দিতে গিয়ে একশো দিনের প্রকল্পও গতি পায়নি। তা ছাড়া, বহু ক্ষেত্রে বাঁধ মেরামতির মাটি পেতে অসুবিধা হয়েছে। জমির মালিকেরা মাটি দেননি। বালি দিয়ে বাঁধ বাঁধতে হয়েছে। যার ভবিষ্যৎ ২৫-৩০ হাজার কিউসেক জল ছাড়লেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ডিভিসি জল ছাড়ে এক থেকে দেড় লক্ষ কিউসেক। সে রকম পরিস্থিতিতে ফের বন্যার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
|
আরামবাগে মোহন দাসের তোলা ছবি। |