|
|
|
|
রুগ্ণ স্বাস্থ্য/১ |
নামেই জেলা হাসপাতাল, চালু হয়নি বহু বিভাগ |
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
একই ছাদের তলায় পাশাপাশি ঘরে ঝুলছে অস্থি, দন্ত, চক্ষু, চর্ম, সার্জারি, মেডিসিন, স্ত্রী ও শিশু বহির্বিভাগের সাইনবোর্ড। প্রতিটি বিভাগের সামনে ঝোলানো ডাক্তারবাবুদের নাম এবং চিকিৎসার দিন-তালিকা। সকাল থেকেই মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভিড়। তমলুকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে ফি-দিনের এই ছবি দেখে বোঝা মুশকিল, রাজ্যের অন্যতম নবীন জেলার সদর হাসপাতালের অসুখ কতটা গভীরে।
বহির্বিভাগের বিভিন্ন শাখায় চিকিৎসক মাত্র এক জন করে। কয়েকটি শাখায় চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে ঢের কম শুরু থেকেই। বহির্বিভাগে এক্স-রে, প্যাথলজি, ইসিজি-র ব্যবস্থা নেই। হয়রানি তাই নিত্যসঙ্গী রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের। চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতির অভাবে এমনকী ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চালুই হয়নি। চালু হয়নি শিশু পরিচর্যায় জরুরি নিও-নেটাল ইউনিটও। এই নাকি জেলা হাসপাতাল!
২০০২-এর পয়লা জানুয়ারি ‘পূর্ব মেদিনীপুর জেলা’ উদ্বোধনের পরেই তমলুক মহকুমা হাসপাতালের সাইনবোর্ড বদলে লেখা হয়, ‘পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সদর হাসপাতাল’। কিন্তু মহকুমা হাসপাতাল থেকে নামে জেলা সদর |
|
শুরু থেকেই বন্ধ আইসিইউ। পার্থপ্রতিম দাস |
হাসপাতালে উন্নীত হলেও পরিকাঠামো ও পরিষেবার মান যে তেমন বাড়েনি, তা দৃষ্টি এড়ায় না। জেলা হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণা হলেও শয্যাসংখ্যা গত দশ বছরে বেড়ে হয়েছে মাত্র ৩৫০। অথচ যে-কোনও জেলা হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা হওয়ার কথা ন্যূনতম ৫০০। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসকের অন্তত ১১টি পদ শূন্য। নার্সের সংখ্যাও যা প্রয়োজন, তার অর্ধেক। এমন পরিকাঠামো নিয়ে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা কেমন চলছে, তা সহজেই অনুমেয়। এর পরেও হাসপাতালে নিযুক্ত এক শ্রেণির চিকিৎসকের কাছাকাছিই প্রাইভেট চেম্বার নিয়ে বেশি ‘আগ্রহ’, বাইরে পরীক্ষা এবং অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীদের ‘উৎসাহিত’ করার অসুখও রয়েছে সমান ভাবে!
বহির্বিভাগে সবচেয়ে বেশি রোগী আসেন চর্ম ও অস্থি বিভাগে। অথচ চর্ম-বিভাগে রয়েছেন মাত্র এক জন চিকিৎসক। সপ্তাহে মাত্র তিন দিন রোগী দেখা হয় এখানে। আর অস্থি-বিভাগে রয়েছেন দু’জন চিকিৎসক। এখানেও রোগী দেখা হয় সপ্তাহে মাত্র তিন দিন। একই ভাবে দন্ত ও নাক-কান-গলা বিভাগে মাত্র এক জন করে চিকিৎসক রয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, এই সব বিভাগে আরও দু’জন করে চিকিৎসক প্রয়োজন। তা না হলে সপ্তাহের ছ’দিন রোগী দেখা অসম্ভব। সার্জারি ও মেডিসিন বিভাগেও আরও চিকিৎসক প্রয়োজন।
বহির্বিভাগের সঙ্গেই এক্স-রে, প্যাথলজি ও ইসিজি-র ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই জেলা হাসপাতালে নেই সেটুকুও। বহির্বিভাগে আসা কোনও রোগীর এই সব পরীক্ষার প্রয়োজন হলে তাঁকে যেতে হবে অন্তর্বিভাগের দোতলায়। কয়েকশো মিটার দূরে এই সব রোগীকে নিয়ে যেতে হয়রানির মুখে পড়েন রোগীর পরিজনেরা। জেলা হাসপাতালের সুপার নিমাই মণ্ডল সমস্যার কথা স্বীকার করেই বলেন, “বহির্বিভাগ সংলগ্ন এক্স-রে, প্যাথলজি, ইসিজি-র ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এখানে তা নেই। এই সব পরীক্ষা করতে হলে তাই অন্তর্বিভাগে পাঠানো ছাড়া উপায়ই বা কী!”
জেলা হাসপাতালে আসা মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চালু করতে ঘর বরাদ্দ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানো হয়েছিল। কয়েক বছর ধরেই সেই ঘরও তালাবন্দি হয়ে রয়েছে। একই ভাবে টেলিমেডিসিন বিভাগ চালু হয়েও কিছু দিন পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সদ্যোজাত কম ওজনের শিশু বা নির্দিষ্ট সময়ের আগে-জন্মানো শিশুর পরিচর্যার জন্য জেলা হাসপাতালে নেও-নেটাল কেয়ার ইউনিট থাকা অত্যন্ত জরুরি হলেও আজও তা চালু হয়নি। অনেক সময়েই ঝুঁকি নিয়েই এ রকম শিশুদের অস্ত্রোপচার-কক্ষে রেখেই চিকিৎসা করা হয়। অন্যথায় অন্যত্র পাঠানোর সুপারিশ করা ছাড়া উপায় থাকে না। জেলা হাসপাতালের ক্যানসার নির্ণয়কেন্দ্র সপ্তাহে তিন দিন খোলা থাকলেও অনকোলজিস্ট নেই। বিভাগটি অন্য চিকিৎসকদের দিয়ে চালানো হচ্ছে অগত্যা। এই কেন্দ্রের জন্য প্যাথলজিস্টও নেই। হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্ক ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানও নেই।
জেলা হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট চালু না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সুপার নিমাই মণ্ডল বলেন, “ওই ইউনিট চালু করার মতো চিকিৎসক নেই, যন্ত্রপাতিও এখনও আসেনি। ফলে ঘর বরাদ্দ থাকলেও ইউনিট-টি চালু করা যায়নি।” তবে, নিও-নেটাল কেয়ার ইউনিট-টি দ্রুত চালু করার চেষ্টা হচ্ছে বলে সুপারের দাবি। সুপারের বক্তব্য, “জেলা হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও কর্মী নিয়োগ দ্রুত করার জন্য স্বাস্থ্য দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এই হাসপাতালে অন্তত ১১ জন চিকিৎসক ও ৯৬ জন নার্স নিয়োগ করা এখনই জরুরি। হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নয়নেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে আরও কয়েকটি বিষয়ে সুপারিশ করা হচ্ছে।”
এরই মধ্যে শনিবার জেলা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা শুভময় দত্তচৌধুরী। জেলা হাসপাতালে চক্ষু বিভাগ চালু না-হওয়া, রেডিয়োলজি বিভাগে কাজের সময়েও চিকিৎসক না-থাকা, বহির্বিভাগের অব্যবস্থা, সুপারের নিজেরই মাঝেমধ্যে অনুপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। পরিকাঠামো উন্নয়নে কী করণীয়, সে ব্যাপারে চিকিৎসক, সিএমওএইচের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকও করেন। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার হাসপাতালে ‘আচমকা পরিদর্শন’ কিছুটা হলেও পরিষেবার মানোন্নয়ন নিয়ে আশাবাদী করেছে আম-আদমিকে। এখন দেখার, জেলা-মহকুমা-ব্লকস্তরের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কতটা বদলায় পালাবদলের রাজ্যে। |
|
|
|
|
|