দলীয় নেতৃত্বে বদল নয়, জানালেন কারাট
শ্চিমবঙ্গে বাম-দুর্গ পতনের জন্য সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ‘ভুল’-কে দায়ী করলেও প্রকাশ কারাট কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বে বদলের কথা বললেন না। আর তা না-বলে অন্তত আগামী বছর এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত নিজের গদি ‘সুরক্ষিত’ রাখলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক। বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির জন্য দলের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য স্তরে নেতৃত্ব বদলের প্রশ্ন আজ সাফ খারিজ করে দিয়েছেন তিনি।
কারাটের যুক্তি, “নেতৃত্ব বদলের কোনও প্রশ্নই নেই! কারণ, সিপিএমের নেতৃত্ব নির্বাচনের ফলাফলের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে দলীয় নীতি এবং দলের রাজনৈতিক রণকৌশলের উপর। তার কোনও বদল হচ্ছে না।” কারাট বুঝিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে হারের জন্য পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার দায়ী নয়। বিজয়ওয়াড়ায় বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেই এই বিতকের্র অবসান হয়ে গিয়েছিল। আজ বৈঠক শেষে দলের বিবৃতিতেও তাই এই বিষয়ের কোনও উল্লেখ নেই। রাজ্য কমিটিতে এ বিষয়ে দলের একাংশের তরফে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষে আজ গোটা ব্যাপারটাই ‘ধামাচাপা’ দিতে চেয়েছেন কারাট।
লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর বিজয়ওয়াড়া সম্মেলনে ‘কিছু ভুল তোমার। কিছু ভুল আমার। কিছু আমাদের দু’জনের’ বলে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে ‘সন্ধি’ করে নিয়েছিলেন কারাট। পরমাণু চুক্তি নিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার মানুষকে বোঝানো যায়নি বলে যেমন ভুল স্বীকার করা হয়েছিল তেমনই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতাও মেনে নেওয়া হয়েছিল। বিধানসভায় ভরাডুবির পর কলকাতায় রাজ্য কমিটির বৈঠকে গিয়ে ‘আসুন সকলে বাঁচি’ বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। হায়দরাবাদে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকেও সেই পথেই হেঁটে সন্ধির চেষ্টা করেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক।
কারাটের ‘কাঁটা’ ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্ময় অনুপস্থিতি’। সেই ‘অস্বস্তি’ এড়াতে তাঁকেও বুদ্ধবাবুর ‘শারীরিক অসুস্থতা’-র কথা বলতে হয়েছে। প্রশ্নের জবাবে কারাট বলেছেন, “বুদ্ধদেব কেন আসতে পারছেন না, তা দলকে জানিয়েছেন। ওঁর শরীরের এখন এমন অবস্থা যে দিল্লি-হায়দরাবাদ দূরস্থান, কলকাতার বাইরে যাওয়াও বারণ!” এবং পাশাপাশি নিজের স্বার্থেই বুদ্ধবাবুকে যথাসম্ভব ‘আড়াল’ করে ফের বলেছেন, “দলে কেউ কাউকে পদত্যাগ করতে বলেনি। কেউ পদত্যাগের ইচ্ছাও প্রকাশ করেননি।” বস্তুত, বুদ্ধবাবুর ‘গুরুত্ব’ বোঝাতে দলে তাঁকে নতুন দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলেছেন কারাট।
নির্দিষ্ট করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে কী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা না-জানালেও কারাট জানান, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর নেতাদের মধ্যে দায়িত্ব পুনর্বণ্টনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রাজ্যের জেলাওয়াড়ি কর্মীদের মন জয়ের চেষ্টায় গোটা দলকে পশ্চিমবঙ্গের ‘আক্রান্ত’ পার্টিকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক। তৃণমূলের ‘হামলা’ নিয়ে প্রচারের সঙ্গে ঘরছাড়া ও হতাহতদের পরিবারের অর্থ সাহায্যের জন্যও সারা দেশে চাঁদা তোলা হবে।
প্রশ্ন হল, আপাতত গদি বাঁচালেও তাঁর আমলে প্রথমে লোকসভা, তার পর দুই বাম-রাজ্যে পতনের দায় কি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কারাট এড়িয়ে যেতে পারবেন?
দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে আগের বক্তব্য খারিজ করে দিয়ে নতুন কোনও প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সমর্থন প্রত্যাহারেরর সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, তা-ও এখন বলা সম্ভব নয়। কারণ আনুষ্ঠানিক ভাবে, সিপিএম খুব কমই ভুল ‘স্বীকার’ করে থাকে (প্রয়াত জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ব্যতিক্রমী ঘটনা)। কাজেই পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহারটাই ভুল ছিল এখন তা বলা অসম্ভব। বিজয়ওয়াড়ার বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের দলিলে বলা হয়েছিল, সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। তবে তা মানুষকে বোঝানো যায়নি। সমর্থন প্রত্যাহারের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কংগ্রেস-বিজেপির থেকে ‘সমদূরত্ব’ বজায় রাখার কৌশল নেওয়া হয়। কারাটের যুক্তি, “বিজয়ওয়াড়ার সেই রাজনৈতিক কৌশলগত লাইনের কোনও বদল হচ্ছে না। পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ নিয়ে কোনও আলোচনারও প্রয়োজন দেখা দেয়নি।” সেই যুক্তিতে নেতৃত্ব বদলেরও কোনও প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন কারাট। তাঁর যুক্তি, এ কথা কেন্দ্রীয় বা রাজ্য নেতৃত্ব থেকে শুরু করে দলের সব স্তরেই প্রযোজ্য।
শুধু দলের মধ্যে নয়, নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির তরফেও ফ্রন্টের নেতৃত্ব বদলের দাবি উঠেছিল। যা পরোক্ষ ভাবে ফ্রন্টের প্রধান দল সিপিএমের নেতৃত্ব বদলেরই দাবি। আজ সেই প্রশ্নের জবাবে দৃশ্যতই ক্ষুণ্ণ কারাট বলেছেন, “আমি বুঝি না, কী ভাবে একটা দল অন্য দলের নেতৃত্ব বদলের বিষয়ে কথা বলে! আমরা যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করি, সেই কংগ্রেসকেও নেতৃত্ব বদলের পরামর্শ দিই না!” তাঁর রাজনৈতিক লাইন যে অভ্রান্ত ছিল, তা বোঝাতে কারাট আজ বরং পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, “পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিলেও ইউপিএ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কেরল-তামিলনাড়ুর ভোটে মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যার সুবিধা পেয়েছে বামেরাও। আগামী দিনেও অন্য বাম দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রের দুর্নীতি, উদারনীতি, খাদ্যসুরক্ষা আইনের দাবিতে আন্দোলন চলবে।” যা থেকে স্পষ্ট যে, দলের নিজস্ব গণভিত্তি বাড়াতে স্বাধীন ভাবে যথাসম্ভব বেশি ‘জনমুখী’ আন্দোলন গড়ে তোলাই আপাতত সিপিএমের রাজনৈতিক কৌশল।
তবে কারাট-বিরোধী গোষ্ঠীর নেতারা মনে করিয়ে দিয়েছেন, দলের নেতৃস্তরে এই ‘স্থিতাবস্থা’ আগামী বছরের এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত। সেখানে ফের গোটা বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা হবে। সে ক্ষেত্রে ফের কারাটের দিকে আঙুল ওঠারই সম্ভাবনা। কারাটও তা খুব ভাল করেই জানেন। তিনি নিজেও বলছেন, পার্টি কংগ্রেসে ফের রাজনৈতিক রণকৌশলের পর্যালোচনা হবে। তা বদলাতে হলে সেই যুক্তিতেই আসবে নেতৃত্ব বদলের প্রসঙ্গও। দলের একাংশের মতে, সেই কারণেই পার্টি কংগ্রেসের আগে সর্বস্তরের কর্মীদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে আজ বারবার পশ্চিমবঙ্গে ‘তৃণমূলের হামলা’র কথা বলেছেন তিনি। বিধানসভা ভোটের পর থেকে দলের কর্মীদের উপর হামলার খতিয়ান ও তার কারণ বিশ্লেষণ করে একেজি ভবনের তরফে সচিত্র প্রচার-পুস্তিকা তৈরি হয়েছে। কারাটের প্রতি ক্ষুব্ধ ‘বেঙ্গল-লবির মুখ’ সীতারাম ইয়েচুরিকে দিয়ে সেই পুস্তিকার আনুষ্ঠানিক প্রকাশও করানো হয়েছে।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সারা দেশে প্রচার-কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
ইয়েচুরি বলেন, “আজকে বামেদের উপর এই ভাবে হামলা হলে কাল দেশের অন্য গণতান্ত্রিক শক্তির উপরেও আক্রমণ আসবে। এই বলেই আমরা সারা দেশে প্রচারে যাব।” পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় দলের নেতা-কর্মীদের মন জয় করতে আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারেরও কড়া সমালোচনা করেছেন কারাট। বলেছেন, “তৃণমূল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় এলে কোনও রাজনৈতিক হামলা হবে না। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকার এ বিষয়ে উদাসীন। হামলা রোখার কোনও সদিচ্ছা তাদের নেই।”
এখন দেখার, কারাটের এই ‘পাশে দাঁড়ানোর’ চেষ্টা পশ্চিমবঙ্গের জেলা স্তরের নেতাদের ক্ষোভ কতটা প্রশমিত করতে পারে!
Previous Story Desh Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.