|
|
|
|
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ‘ভুলের মাসুল’, জানাল কেন্দ্রীয় কমিটি |
সন্দীপন চক্রবর্তী • হায়দরাবাদ |
প্রত্যাশিত ভাবেই পশ্চিমবঙ্গে দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের জন্য সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ‘ভুল’কে দায়ী করল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। এক সপ্তাহ আগে কলকাতায় দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে গিয়ে জেলার প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে যে মতামত দিয়ে এসেছিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট, হায়দরাবাদে কেন্দ্রীয় কমিটি সেই মতেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সিলমোহর বসাল। সেই সঙ্গে সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমির মধ্যে থেকে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা সিপিএম করবে না বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন কারাট।
দলের একাংশের ব্যাখ্যায়, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে যে ‘ভুল’ হয়েছিল, মমতার জমি ফেরানোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না-করে তারই ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করা হচ্ছে। আলিমুদ্দিন যাতে জমি ফেরানোর সিদ্ধান্তে নীতিগত ভাবে বাধা না-দেয়, হায়দরাবাদে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নিজেও তা নিশ্চিত করেছেন কারাট। তাঁর কথায়, “জমি ফেরানো চলবে না, এমন অবস্থান আমাদের নয়। আমরা সরকারের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছি।”
দুই রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর ময়নাতদন্তের বৈঠক শেষে আজ কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ‘তিন দশকে বামফ্রন্ট সরকারের অনেক বড় বড় কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও কিছু নীতি এবং জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে ভুল ও দুর্বলতা থেকে গিয়েছিল। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের ভুলের চড়া মাসুল আমাদের দিতে হয়েছে’। সাংগঠনিক বিচ্যুতির জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন অংশের মানুষের থেকে দল ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়েছে বলেও কেন্দ্রীয় কমিটির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। খোদ কারাটের মতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জেরে লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের পরে দল পথ সংশোধন করেছিল। তাই পরবর্তী দু’বছরে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে আর বড় কোনও ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের অভিজ্ঞতা মানুষের কাছে এতই ‘ভীতিজনক’ ছিল যে, তার ধাক্কা থেকে দল আর বেরোতে পারেনি। |
রবিবার হায়দরাবাদে।
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিতে যে ভাবে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, লোকসভা ভোটের সময় থেকে এ যাবৎ সিপিএমের লাগাতার নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর্বে ততটা খোলাখুলি ‘স্বীকারোক্তি’ করা হয়নি। এর আগে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতোই দলের সাধারণ সম্পাদকও বলে এসেছেন, নন্দীগ্রামে এক ছটাকও জমি নেওয়া হয়নি। কিন্তু বিরোধীদের ‘অপপ্রচারে’র জবাব দেওয়া যায়নি। তা হলে এখন কেন এই ভাবে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ‘ভুলে’র কথা বলা হল? কারাটের ব্যাখ্যা, “নন্দীগ্রামে জমি নেওয়া হয়নি ঠিকই। কিন্তু জমি নেওয়ার তোড়জোড় হয়েছিল। জমি অধিগ্রহণের ভাবনাটাই |
|
এত ভীতিজনক ছিল যে, মানুষের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। পুলিশের গুলিচালনায় সেখানে মানুষের মৃত্যু তার পরে ঘটেছে। কিন্তু আতঙ্কটা আগেই তৈরি হয়েছিল।”
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত শুধু সে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার নয়, গোটা দলই যে নিয়েছিল, তা কিন্তু অস্বীকার করেননি কারাট। তিনি বলেছেন, “জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতিতে সমস্যা ছিল। এই জন্যই গত বছর বিজয়ওয়াড়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে জমি অধিগ্রহণ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উপরে আমরা আলাদা আলোচনা করেছিলাম। সেখানে পর্যালোচনামূলক সমীক্ষা রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই আমরা চলছি এবং তাতে আর কোনও সমস্যা হয়নি।” কিন্তু জমি অধিগ্রহণের পথ থেকে একেবারে সরে এলে শিল্প করাও তো মুশকিল হবে? কারাটের মতে, “শিল্প করার জন্য ওটাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। গোটা বিষয়টা ভাল ভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।” সিপিএমেরই একাংশের মতে, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার ফলে জমি অধিগ্রহণের ‘আগ্রাসী পথ’ থেকে সরে আসা আপাতত দলের কাছে ‘সুবিধাজনক’। কারণ, আপাতত শিল্পায়নের পথে এগোনোর ‘দায়িত্ব’ মমতা বা উম্মেন চান্ডিদের। সিপিএম বরং পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসে কমিউনিস্ট কায়দায় এই নিয়ে আরও আলোচনার সুযোগ পাবে!
জমি অধিগ্রহণের ‘ভুল’ উল্লেখ করার পাশাপাশিই সিপিএমকে এখন ভবিষ্যতের দিশা খুঁজতে হচ্ছে। সেই মর্মেই বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের জন্য আলাদা পর্যালোচনা রিপোর্ট গৃহীত হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। কারাটের কথায়, “কিছু সংশোধনী পদক্ষেপ আমরা সুপারিশ করেছি। এখন আর সরকার নেই। তাই রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ করতে হবে। তার পূর্ণাঙ্গ নথি প্রকাশিত হওয়ার আগে এই বিষয়ে সবিস্তার কিছু বলতে পারব না। তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মতামত নিয়েই এই পর্যালোচনা রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।” পশ্চিমবঙ্গে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র পথ যে সহজ হবে না, তা-ও অবশ্য কবুল করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। কারাটের বক্তব্য, “সামনে একটা দীর্ঘ এবং কঠিন পথ! কিন্তু পথ চলতে আমরা শুরু করেছি।”
সিপিএমের কাঠামো অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটিই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কমিটি। তাদের বিশ্লেষণাত্মক বিবৃতিতে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের ‘ভুলের মাসুলে’র কথা বলা মানে ইউপিএ-১ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারকে পশ্চিমবঙ্গে দলের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করার তত্ত্ব ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে ফের খারিজ হয়ে গেল। কেন্দ্রীয় কমিটির দু’দিনের বৈঠকেও অধিকাংশ প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণ-সহ প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন। বঙ্গ-ব্রিগেডও তার বিরোধিতা করতে যায়নি। রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের কথায়, “এখন আত্মসমীক্ষার সময়। যা ঘটেছে, তার খোলাখুলি বিশ্লেষণ করেই পথ সংশোধন করতে হবে। টানা ৩৪ বছরের রাজত্বে দলের নজর অনেকটাই সরকারের দিকে সরে গিয়েছিল। এ বার রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে নজর দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।”
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, পশ্চিমবঙ্গে জমি অধিগ্রহণের নীতিকে কাঠগড়ায় তোলার প্রক্রিয়া দলের অন্দরে কারাট সম্পন্ন করেছেন অত্যন্ত ‘গণতান্ত্রিক’ কৌশলে। রাজ্য কমিটির বৈঠকে নিজে উপস্থিত থেকে জেলার নেতাদের বক্তব্য শুনেছেন। তাঁদের কথার সূত্র ধরেই রাজ্য স্তরের প্রশ্নগুলিকে ভোটে হারের জন্য রাজ্য কমিটিতে দায়ী করে এসেছেন। তার পরে আলিমুদ্দিনে বসে রাজ্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পেশ করার জন্য বঙ্গ সিপিএমের রিপোর্ট তৈরিতে ‘যুক্ত’ থেকেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের দিকে আঙুল ওঠার পরে সেই মর্মে পোর্টই গ্রহণ করা হয়েছে। সিপিএম সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় কমিটির জবাবি বক্তৃতাতেও এ দিন সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পরে যে সব সংশোধনমূলক পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল, তার অনেক কিছুই করে ওঠা যায়নি এবং সেগুলো এখনও ‘প্রাসঙ্গিক’। যা আসলে মান বসুদেরও মত। ফলে, সব শেষে কারাট দেখাতে পেরেছেন, ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়ায় ‘আত্মসংশোধনে’র পথে এ কে জি ভবন এবং আলিমুদ্দিন ‘পাশাপাশি’ই আছে! ঘটনাচক্রে, সর্বভারতীয় স্তরে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এই প্রক্রিয়া বুদ্ধবাবুকে হায়দরাবাদে বসে দেখতে হল না। |
|
|
|
|
|