রাজ্যের চিকিৎসা পরিকাঠামোয় ধনী ও দরিদ্রের চিকিৎসার মধ্যে ভারসাম্য, গ্রামীণ স্তরে পরিকাঠামোর উন্নতি এবং পরিষেবার প্রতিটি স্তরে দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করা। নতুন সরকারের স্বাস্থ্য নীতির মূল লক্ষ্য হতে চলেছে এই তিনটি দিক।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, নয়া স্বাস্থ্য নীতিতে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে তা হল l কলকাতা ও তার আশপাশের তথাকথিত কম গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতাল, যেমন বিজয়গড়, বাঘাযতীন, রামরিক দাস, ইন্দিরা মাতৃ সদন প্রভৃতির পরিকাঠামো বাড়িয়ে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার। বুধবার তিনি আচমকাই বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে যান এবং সেখানকার পরিকাঠামোর করুণ দশা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। l পদোন্নতির প্রক্রিয়া সরল করা, যাতে মেডিক্যাল কলেজ খুললে শিক্ষক-চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো যায় এবং বর্তমান মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা বাড়তে পারে। l সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের উপরে নজরদারি, অর্থাৎ প্র্যাকটিসিং ডাক্তাররা প্র্যাকটিস করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু হাসপাতালে তাঁদের পর্যাপ্ত সময় দিতেই হবে। l জেলা হাসপাতালগুলোর কলকাতা-নির্ভরতা কমানো। এই কারণেই জেলা স্তরে পরিকাঠামো বাড়ানোর উপরে জোর দিয়েছেন তিনি। গুরুত্ব দিয়েছেন পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণের উপরেও। যেমন জেলা হাসপাতাল বা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোথায়, কবে কী যন্ত্র কেনা হয়েছে, তার কোনগুলো অকেজো, বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি (এএমসি) করানো রয়েছে কি না, সেগুলো জেলাস্তরে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে প্রায় নিয়ম করেই আচমকা কোনও না কোনও হাসপাতালে যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝতে চাইছেন অব্যবস্থার শিকড়টা ঠিক কোথায়। মুখ্যমন্ত্রীর সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এ বার তাঁর সরকারের নয়া স্বাস্থ্য নীতি তৈরি হতে চলেছে। সরকার গঠনের তিন মাসের মধ্যে স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পক্ষ কাল কাটার আগেই স্বাস্থ্য নীতি কার্যত তৈরি। কোন কোন দিককে অগ্রাধিকার দেবেন, ইতিমধ্যেই তা স্থির করে ফেলেছেন মমতা। স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তাদের তা জানিয়েও দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের জানিয়েছেন, যা যা করণীয়, তার কিছু স্বল্প মেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্প মেয়াদে অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে গ্রামে পরিকাঠামো উন্নত করার মতো বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য নীতিতে।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, স্বাস্থ্য এ রাজ্যে বিনিয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীও একমত। তিনি চান, বড় বড় হাসপাতাল গোষ্ঠী এ রাজ্যে বিনিয়োগ করুক, কিন্তু সেই পরিষেবা কেনার ক্ষমতা যাঁদের নেই, তাঁদের জন্যও যেন চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকে। তিনি চান, শহরে অত্যাধুনিক হাসপাতালের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রামেও সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত থাক। গ্রামের মানুষ যেন ন্যায্য খরচে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পান। এক কথায়, চিকিৎসার ক্ষেত্রে কলকাতা-নির্ভরতা কমাতে তিনি বদ্ধপরিকর। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, শহরে ঝাঁ চকচকে হাসপাতালে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু মেদিনীপুর বা পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রকোনও কিছুই নেই, এই পরিস্থিতি তিনি বরদাস্ত করবেন না। প্রতিটি স্তরে ভারসাম্য আনতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সরকারের স্বাস্থ্যনীতির প্রতিটি ধাপে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দায়বদ্ধতাও নির্দিষ্ট করে দিতে চাইছেন। এখন কথায় কথায় জেলা হাসপাতাল থেকে রোগীদের কলকাতায় ‘রেফার’ করা হয়। এই প্রবণতা আটকানো না গেলে সাধারণ মানুষের হয়রানি কমবে না বলে মুখ্যমন্ত্রীর অভিমত। জেলা হাসপাতালে পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের ‘রেফার’ করার প্রবণতা আটকাতে দায়বদ্ধতা নির্দিষ্ট করার বিষয়টি কাজে লাগবে বলে মনে করছেন সরকারি কর্তারা। কী ভাবে নির্দিষ্ট হবে দায়বদ্ধতা? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ‘রেফার’ করার সময়ে চিকিৎসককে লিখিতভাবে জানাতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা ওই হাসপাতালে নেই। যদি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তিনি ‘রেফার’ করেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবার সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের প্র্যাকটিসের উপর নজরদারি ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে চান মুখ্যমন্ত্রী। বামফ্রন্ট সরকার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিষিদ্ধ করলেও পরে তা তুলে নেয়। নিয়ম করা হয়, ওই চিকিৎসকরা ২০ কিলোমিটারের বেশি গিয়ে রোগী দেখতে পারবেন না। এবং হাসপাতালের নির্ধারিত সময়ের পরে তাঁদের প্র্যাকটিস করতে হবে। কিন্তু সেই নিয়ম মানাই হয় না। তাই নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে চান মুখ্যমন্ত্রী।
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাতারাতি অলৌকিক কিছু ঘটিয়ে ফেলা যাবে না। কিন্তু মানুষকে তাঁদের ন্যূনতম প্রাপ্যটুকু দিতে হবে, যা এত দিন তাঁরা পেতেন না। এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে বাড়তি জোর দিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকদের গ্রামে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিতে সেখানে যথাযথ পরিকাঠামো তৈরি করাও নয়া স্বাস্থ্য-নীতির অন্যতম লক্ষ্য। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, গ্রামীণ চিকিৎসা পরিকাঠামো যে ডাক্তারের অভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে, তা মুখ্যমন্ত্রী জানেন। ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চান না, সে বিষয়েও তিনি ওয়াকিবহাল। ওই কর্তার কথায়, “নতুন স্বাস্থ্যনীতির লক্ষ্য, চিকিৎসকদের গ্রামে যেতে ‘মোটিভেট’ করা। কী ভাবে তা সম্ভব, তার রূপরেখাও তৈরি হচ্ছে। ”
স্বাস্থ্য সচিব মানবেন্দ্র নাথ রায় স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, জেলা স্তরে সমস্ত রকম পরিকাঠামো বাড়ানোর উপরেই তাঁরা জোর দিচ্ছেন। অন্য বিষয়গুলো পরের ধাপে একে একে আসবে। কবে পেশ হবে এই স্বাস্থ্য নীতি? সে বিষয়ে অবশ্য কর্তারা কেউই মন্তব্য করেননি। তাঁদের বক্তব্য, “ওটা মুখ্যমন্ত্রীই স্থির করবেন।” |