ছোট আঙারিয়া এখন/৩
তপন-সুকুরকে বাঁচান, একটাই আর্তি আতঙ্কে কাঁটা বাবা-মায়ের
কেউ মারধর করেনি। কেউ ঢিল-পাটকেল ছোড়েনি। কেউ হুমকিও দেয়নি। তবু সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ নির্মল ঘোষ ছলছল চোখে হাতজোড় করে বলছেন, “আমাদের দয়া করুন। আমাদের ক্ষেতি করবেননি।” গড়বেতায় সিপিএমের ‘দলের সম্পদ’ তপন ঘোষের ফাঁকা বাড়িতে বসে, তাঁর বাবা এখন ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছেন। আর এক ‘সম্পদ’ সুকুর আলির মা আনুরা বিবি, বিবাহিতা বোন সাহানারা মণ্ডল বারবার সবাইকে বোঝাচ্ছেন, সুকুর কত জনের উপকার করেছেন। তিনি কেন গ্রামে আসতে পারবেন না? কেন স্বস্তি পাবেন না?
গড়বেতা কেন্দ্রে সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ জিতলেও গড়বেতা এখন সিপিএম-শূন্য। অন্তত দলের সাংগঠনিক শক্তির প্রকাশ্য প্রমাণ যদি শাখা, লোকাল ও জোনাল কমিটির দফতরগুলো হয়, তবে গড়বেতায় ১১টি লোকাল কমিটির দফতরই বন্ধ। শাখা কমিটির দফতরগুলোর অধিকাংশই দখল করে নিয়েছে বর্তমান শাসক পক্ষ। গড়বেতা জোনাল দফতরের ভিতরে এক জনও পার্টি সদস্য বা কর্মী নেই। বাইরে পাহারায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর কয়েক জন জওয়ান। গড়বেতা থানার ওসি মহাকাশ চৌধুরী বলেন, “চার দিকে সিপিএমের দফতরে হামলা হচ্ছে বলে আমরা সেখানে পাহারার ব্যবস্থা করেছি। বাকিগুলোয় পাহারা সম্ভব নয়।”

তপনের বাবা নির্মল ঘোষ।
- সৌমেশ্বর মণ্ডল
ভোটের ফল বেরনোর পর দিনও জোনাল অফিসের অদূরে পঞ্চায়েত সমিতির দফতরে এসেছিলেন সভাপতি ও জোনাল সদস্য আদিত্য সাহা। তার পর থেকে তিনি কলকাতায়। ফোনে শুধু বললেন, “আমার চিকিৎসা দরকার।” মেদিনীপুর শহরে রয়েছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার। তিনিও কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে নারাজ। তবে সিপিএমের আর এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা সুশান্ত ঘোষ বলেন, “ভোটের ফল বেরোনোর পর দিনই আমাদের দলের এক নেতা জিতেন নন্দী খুন হন। তার পরই গড়বেতা, গোয়ালতোড়, চন্দ্রকোনার সব ক’টি দলীয় দফতর বন্ধ করে দিই।
এমনকী শাখা অফিসও হামলার ভয়ে বন্ধ করা হয়েছে।” যদিও তৃণমূলের স্থানীয় নেতা অসীম ওঝার বক্তব্য, “আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে শান্তি বজায় রেখেছি। আমরা বদলা চাইনি। বদল চেয়েছি।”
গড়বেতার দুই নেতা তপন ঘোষ, সুকুর আলি খান ছোট আঙারিয়া হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত। তাঁরাও এখন নিপাত্তা। ফোন ধরছেন না। না-ধরুন, তাঁদের বাড়িঘর তো দেখে আসা যায়। সেই উদ্দেশ্যে মেদিনীপুর শহর থেকে গড়বেতা শহরে ঢোকার আগে ডান দিকে খড়কুশমা রোডে ঢোকা গেল। তার আগে দেখা গিয়েছে, মেদিনীপুর থেকে রাজ্য সড়ক ধরে আসার পথে ময়রাকাঁটার কাছে বাঁ দিকে বিশাল পেট্রোল পাম্পটি বন্ধ। সেটি তপনবাবুর।
গড়বেতা বিধানসভা কেন্দ্রের এই এলাকা কিছু দিন আগে পর্যন্ত সিপিএমের দুর্গ বললেও কম বলা হত। বিধানসভার ভোটে জিতেওছেন সিপিএমের সেই সুশান্তবাবুই। তবু রাজ্য সড়ক থেকে খড়কুশমা গ্রাম অবধি প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তায় একটাও লাল পতাকা দেখা গেল না। অধিকাংশ পতাকা হাত চিহ্নের তেরঙা। কিছু তেরঙা জোড়াফুলের। মাটির দেওয়ালে কোথাও কোথাও কাস্তে-হাতুড়ির উপর সাদা চুনকাম করা হয়েছে। এখানে ভোটে লড়েছিল কংগ্রেস। পিছনে প্রধান শক্তি অবশ্যই তৃণমূল।
তপনের বাড়ি
প্রথমে পড়ল ধোবাবেড়িয়া গ্রাম। খড় ও টিনের চালার ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে চাষের মাঠ পেরোতে গিয়ে দেখা গেল, সমুদ্রে পথ দেখানোর লাইটহাউসের মতো মাথা উঁচু করে রয়েছে একটি বাড়ির চূড়া-ঘর। পৌঁছে দেখা গেল, প্রায় ৬ কাঠা জমির সবটা নিয়ে তৈরি এক দুর্গসদৃশ বাড়ি। চারপাশে ১৫ ফুট উঁচু কংক্রিটের প্রাচীর। বিশাল লোহার গেট। পাশের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকে দেখা গেল পাকা উঠোনে এক জন ভাগচাষি বস্তায় ধান তুলছেন। বাঁ দিকে কেয়ারি করা বাগান পেরিয়ে মূল দোতলা বাড়ি।
পিছন দিকে টানা অংশে সার সার ঘর, প্রায় ৮-৯টি। বাড়ির ছাদের অংশে সিমেন্টের লাল
বাহারি টালির নকশা। মূল বাড়িতে ঝুল বারান্দার লাগোয়া ঘরের উপর থেকে নীচ অবধি কালো ঘষা কাচে ঢাকা। বাইরে থেকে দেখা গেল, দোতলাতেই প্রায় ১২টা ঘর। সব জানলা বন্ধ। উঠোনের
ডান দিকে বিরাট সিমেন্টের সামিয়ানার নীচে রাধামাধবের ছোট্ট মন্দির। প্রতিদিন পুজো হওয়ার চিহ্ন ছড়িয়ে তার সামনে। চার দিক নিঃঝুম। কারও সাড়াশব্দ নেই। কেউ আছেন কি না জিজ্ঞাসা করায় ওই চাষি ইঙ্গিত করে সামনে এগিয়ে যেতে বললেন। নীচের একটি ঘরে কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন নির্মলবাবু। খালি গা, হাঁটুর উপরে লুঙ্গি তোলা। সিলিং ফ্যান চলছে। তার মধ্যেও দরদর করে ঘামছেন। সামনে একটি চৌকি। সেখানে বসার অনুমতি নিতেই তিনি হাতজোড় করে অনুনয় করতে লাগলেন। যত বোঝাই জানতে এসেছি, কেন তপনবাবু বাড়িতে বা এলাকায় নেই, কোনও রাজনৈতিক দল বা অন্য কেউ হুমকি দিয়েছে কি না, বা হাঙ্গামা করেছে কি না, বৃদ্ধ কিছুই শুনবেন না। করুণ স্বরে বলে যাচ্ছেন, “আমাদের কোনও ক্ষেতি করবেন না, বাবা। তপনকে বাঁচান। সে কিছু করেনি।”
এত বড় বাড়ি হল কী করে? বৃদ্ধের আর্ত ব্যাখ্যা, “বিশ্বাস করুন, আমি করেছি। স্কুলে মাস্টারি করতাম। অবসরের পর পেনশন না-নিয়ে এক সঙ্গে টাকা নিয়ে নিই, ১৫ লাখ টাকা মতো হবে। সেই দিয়েই বাড়ি করেছি।” আর পেট্রোল পাম্প, কাঠকলগুলো? নির্মলবাবু বলেন, “তপন মংলাপোতা স্কুলে মাস্টারি করে। ও মাইনে জমিয়ে জমিয়ে এ সব করেছে। কোনও অন্যায় পথে হয়নি। আমি বলছি।” তিনি বলে চলেন, “তপন মানুষের উপকার করত। খুন-জখম কেন করবে? ওর নিজেরও দুই ছেলে আছে। তারা পড়াশুনো করে বাইরে। ও কেন অন্যের ছেলে মারবে বলুন তো?”
সুকুরের বাড়ি
কিন্তু তিনি বাড়িতে নেই কেন? কেউ কি হামলা করেছে? বৃদ্ধ পিতা জবাব দেন, “না-না, এখনও সে সব কেউ করেনি। তবে অন্য দল ক্ষমতায় এসেছে বলে তপনরা ভয় পেয়ে চলে গিয়েছে।” পাশের মাটির বাড়ির বাসিন্দা পঞ্চানন ভুঁইয়া অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে রাজি হলেন না।
তপনবাবুর সঙ্গী ছিলেন সুকুর আলি। সিপিএম নেতা এবং বাস, ট্রাক, ট্রেকার, বাড়ি তৈরির সরঞ্জামের ব্যবসায়ী। প্রায় ৬ কিলোমিটার এগিয়ে খড়কুশমা বাস স্ট্যান্ডে, রাস্তার ডান দিকে দেখা গেল আর এক বিশাল আধুনিক, সুদৃশ্য বাড়ি। সামনে একতলায় বিরাট সোনালি অক্ষরে লেখা ‘খড়কুশমা হার্ডঅয়্যার্স’। ১৩ তারিখ ভোটের ফল ঘোষণার পর, দিনের আলো থাকা অবধি সুকুর এখানেই ছিলেন। তার পর দু’টি ট্রাকে করে ‘প্রয়োজনীয়’ জিনিসপত্র ও পরিবার সঙ্গে করে চলে যান। জানালেন উল্টো দিকে মনিহারি দোকানের সামনে বসা মস্তান আলি মণ্ডলরা।
আরও এগিয়ে খড়কুশমারই মণ্ডলপাড়া গ্রামে থাকেন তাঁর মা আনুরা বিবি। অত্যন্ত অপরিষ্কার ও সরু পথের পাশে দুর্গন্ধময় নর্দমা, গোবর, পচা খড় পেরিয়ে পৌঁছনো গেল সেই বাড়িতে। সাংবাদিক এসেছেন শুনে চলে এলেন সুকুরের বোন সাহানারা। মা ও মেয়ে দুজনেই জানালেন, কেউ হামলা করেনি এখনও। কেউ কটু কথা বলেনি। ইট-পাটকেল ছোড়েনি। তবু রাজনৈতিক পালাবদলের পর ‘জীবননাশের আশঙ্কা করেছেন’ বলেই পরিবার নিয়ে চলে গিয়েছেন সুকুর আলি খান, ভাই রাজেশ আলি খান। তবে সুশান্তবাবুর বক্তব্য, “দলের কাজ পরিচালনা করার জন্য তপন ও সুকুরের যেখানে থাকা দরকার, সেখানেই আছেন। এর বেশি বলব না।”
ছবি সৌমেশ্বর মণ্ডল
(শেষ)
First Page Medinipur Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.