ভাষাকে ভাবের বাহন বলা হইয়া থাকে। তাহার অর্থ এই নয় যে, ভাষা সতত ভাবকে সৎ ভাবে বহন করে। কথা যেমন মনোভাবকে প্রকাশ করিতে পারে, তেমনই মনোভাবকে তাহা গোপন করিতেও পারে। কথার সত্যতা কাজের মধ্য দিয়া প্রমাণ করিতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নূতন বিধানসভার প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনের ভাষণে বিরোধী দলকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে যাহা বলিয়াছেন, তাহা আপাতত কথামাত্র। কিন্তু যে ভাবে তিনি বিধানসভার অধ্যক্ষকে স্পষ্ট ভাষায় বিরোধীদের প্রয়োজনে বেশি সময় দেওয়ার কথা বলিয়াছেন, তাহা অন্তত প্রাথমিক ভাবে আন্তরিকতার সংকেত দেয়। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় এবং আচরণে যে মানসিকতার প্রতিফলন ঘটিতেছে, তাহা সেই সংকেতকে দৃঢ়তর করে। ‘আমরা বনাম ওরা’-র মনোভাব যেমন বহুলাংশে ভাষার মধ্য দিয়াই মূর্ত হইয়া উঠিয়াছিল, তেমনই সকলকে সঙ্গে লইয়া চলিবার অঙ্গীকারও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে একটি নূতন পরিবেশ রচনা করিয়াছে। বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের ভাষণেও তাহার স্বীকৃতি মিলিয়াছে। ইহার ফলে রাতারাতি সব দ্বন্দ্বের, সকল বিরোধের অবসান হইবে, তাহা নহে। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক হানাহানি চলিতেছে, রাস্তার রাজনীতিতেও হাতের মুঠি পাকাইয়া গলার শিরা ফুলাইয়া আস্ফালন চলিতেছে। আশঙ্কা হয়, চলিবেও। কিন্তু অন্তত সংসদীয় রাজনীতির ধারাটি যদি কিছুটা অমলিন হয়, তাহা গঙ্গা-শোধন অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ হইবে না। ভবিষ্যতে কী হইবে, তাহা ভবিষ্যৎই বলিবে, কিন্তু রাজনীতির ভাষায় একটি পরিবর্তন সূচিত হইতেছে, ইহা কম কথা নয়।
ইহা কেবল শালীনতা বা সৌজন্যের প্রশ্ন নয়। পরিবর্তন যদি সত্যই আনিতে হয়, তবে মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন জরুরি। বিরোধীদের গুরুত্ব দেওয়া নিছক আচরণের ব্যাপার নয়, মানসিকতার ব্যাপার। বস্তুত, ইহাই গণতান্ত্রিক মানসিকতার একটি মূল ধর্ম। সেই ধর্মের সার কথাটি বলিয়াছিলেন ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার। তাঁহার উক্তি ছিল: ‘তোমার একটি কথাও আমি মানি না, কিন্তু তোমার কথা বলিবার অধিকার যাহাতে তোমার থাকে, তাহার জন্য আমি নিজের মৃত্যু অবধি স্বীকার করিতে প্রস্তুত।’ ভিন্নমতের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা থাকিলে তবেই এই ধারণায় সুস্থিত থাকা যায়। সেই শ্রদ্ধাও কিন্তু সহসা আকাশ হইতে পড়ে না, তাহাকে অনুশীলনের মধ্য দিয়া আত্মস্থ করিতে হয়। ঠিক একই ভাবে, দীর্ঘ দিন ভুল অভ্যাসের মধ্য দিয়া মানুষ সেই মানসিকতা হইতে বিচ্যুতও হয়। বামফ্রন্ট জমানায় পশ্চিমবঙ্গে তাহা ঘটিয়াছিল। বিরোধী দলের প্রতি অসহিষ্ণুতার মূলে ছিল ভিন্নমতের প্রতি শাসক বামপন্থীদের অসহিষ্ণুতা, আপন মতকেই একমাত্র যথাযথ মত বলিয়া মনে করিবার অহমিকা, ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য’ ঘোষণায় যে অহমিকার প্রকাশ। বহিরঙ্গে যাহাকে ‘আমরা বনাম ওরা’র দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখা গিয়াছে, তাহার গভীরে ছিল এই মৌলিক বিরোধ। ইহা চেতনার বিরোধ। অন্য ভাবে বলিলে, বিরোধসর্বস্ব চেতনা, যে চেতনা বিরোধ ভিন্ন অন্য কিছু বোঝে না যে কোনও ভিন্নমতাবলম্বীকে সে হয় ধ্বংস করিতে চাহে, অথবা আত্মসাৎ করিতে। বিরোধীকে তাহার নিজস্ব স্থান দিবার সহিষ্ণু মন এই চেতনায় নাই, থাকিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘ কাল এই মনের দ্বারা শাসিত হইয়াছে। শাসকের ধর্ম কালক্রমে সমাজের ধর্মকে প্রভাবিত করিয়া থাকে, দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন একদলীয় শাসনে সেই প্রভাব ব্যাপক এবং গভীর হইবে, তাহা অস্বাভাবিক নয়। শাসক বদলাইয়াছে, চেতনা কি সত্যই বদলাইবে? |