অনশন রুখতে মরিয়া কেন্দ্র
রামদেবকে বোঝাতে ময়দানে চার মন্ত্রী

জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের কোনও ব্যক্তিত্বকে এর আগে কি এতটা গুরুত্ব দিয়েছে মনমোহন সিংহ সরকার?
কালো টাকা ও দুর্নীতি দমন প্রশ্নে অনশন সত্যাগ্রহ থেকে রামদেবকে বিরত করতে আজ তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কবিল সিব্বল-সহ চার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সেই সঙ্গে ক্যাবিনেট সচিব কে এম চন্দ্রশেখর থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষ স্তরের প্রায় সব আমলা। এক কথায় অভূতপূর্ব ঘটনা! এবং এর মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট, আন্না হাজারের অনশন আর সেই অনশনের ফলে উঠে আসা দুর্নীতির অভিযোগ, যাকে ঘিরে ভারত জুড়ে সরকার-বিরোধী বিতর্কের ঝড় উঠেছিল, তার পুনরাবৃত্তি আর চায় না কংগ্রেস। এ ব্যাপারে রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত সরকার।
অবশ্য বিমানবন্দরের বৈঠকের পরেও বলা সম্ভব নয় যে, সঙ্কট পুরোপুরি মিটে গিয়েছে। বরং ভরদুপুরে বিমানবন্দরের ভিভিআইপি ওয়েটিং লাউঞ্জে আড়াই ঘণ্টার বৈঠকের পর যোগগুরু রামদেব জানিয়ে দিলেন, বিদেশের ব্যাঙ্ক থেকে ভারতের কালো টাকা উদ্ধার ও দুর্নীতি দমনের দাবিতে ৪ জুন পূর্ব ঘোষিত অনশন সত্যাগ্রহের কর্মসূচি অব্যাহত থাকছে। তবে প্রণববাবু-সহ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে। কিছু বিষয় সরকার মেনে নিয়েছে। কাল-পরশু আরও আলোচনা হবে। সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পেলে তবেই অনশন প্রত্যাহার নিয়ে বিবেচনা করা হবে।
রামদেবের এই মন্তব্যের মধ্যে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব। সরকারেরই আর এক পক্ষের মত কিন্তু ভিন্ন। তাঁরা মনে করছেন, এই অনশন ঘিরে যে ভাবে রামলীলা ময়দানে আড়াই লাখ বর্গমিটারের প্যান্ডেল হয়েছে (এই তথ্য দিয়েছেন রামদেবের মুখপাত্র জয়দীপ আর্য) এবং এর সঙ্গে বাদবাকি সাজসজ্জা মিলিয়ে বিপুল অর্থ খরচ করা হয়েছে, তাতে রামদেব অনশন সত্যাগ্রহের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেবেন, এমন সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া, এ ক্ষেত্রে তিনি আন্না হাজারের সঙ্গে টক্করও দিতে চাইবেন নিশ্চয়ই।

ফোনেও আছেন। দিল্লির রামলীলা ময়দানের তাঁবুতে রামদেব। পি টি আই
কেন্দ্রের এক শীর্ষ নেতার কথায়, রামদেবও অনশনে বসায় প্রাথমিক ভাবে সরকারের কিছুটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে ঠিকই। বিশেষ করে তাঁকে বোঝাতে প্রণববাবুর মতো সরকারের ‘দু’নম্বর’ ব্যক্তি বিমানবন্দরে চলে যাওয়ার ঘটনা অভূতপূর্ব বইকি। কিন্তু এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। আন্না হাজারে পর্বের মতো ফের কোনও ঘটনা ঘটলে বড় ধরনের অস্বস্তি হত সরকারের। তাই আগেভাগে রামদেবকে বিরত করাই লক্ষ্য। রামদেবকে গুরুত্ব দিলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা যাবে বলেও আশাবাদী সরকারের একাংশ নেতা। তাঁদের মতে, বিজেপি-র হাওয়া এতে অনেকটাই কেড়ে নেওয়া যাবে। বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হলেও সেই স্থান যে অরাজনৈতিক শক্তি নিয়ে নিচ্ছে, সেটা আরও এক বার প্রমাণ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, রামদেবকে গুরুত্ব দিয়ে তথাকথিত নাগরিক সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিও করা যেতে পারে। এর ফলে আন্না হাজারে-প্রশান্তভূষণরা কোণঠাসা তথা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন। যদিও রামদেবের অনশনকে সমর্থন করেছেন আন্না হাজারে। যেমন করেছে আরএসএস। কিন্তু কিরণ বেদি ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে রামদেবের কাছে আন্নার সঙ্গে দেখা করার বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে খারিজ করে দিয়েছেন যোগগুরু। তিনি সাফ জানিয়েছেন, এখন আন্নার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। এই ঘটনায় আশার রুপোলি রেখা দেখতে পাচ্ছে কংগ্রেস।
সূত্রের খবর, গত পরশু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকেই রামদেবের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে রোডম্যাপ তৈরি হয়েছিল। এমনিতে এই যোগগুরুর সঙ্গে দূরভাষে ও দূত পাঠিয়ে সরকারের তরফে যোগাযোগ রাখছিলেন প্রণববাবু। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে স্থির হয়, তাঁর পাশাপাশি কপিল সিব্বল, পবন বনশল এবং সুবোধকান্ত সহায়ও রামদেবের সঙ্গে আলোচনা চালাবেন। সনিয়া গাঁধীও তাতে সবুজ সঙ্কেত দেন। ঝাড়খণ্ডের নেতা সুবোধকান্ত সহায়কে এই ‘টিমে’ রাখার কারণ, রামদেবের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল। রাঁচিতে একটি নির্মীয়মাণ ফুডপার্কে রামদেবের বিনিয়োগ রয়েছে। রাঁচিতে গেলে সুবোধের বাড়িতেই ওঠেন রামদেব। সূত্রের খবর, আজ সন্ধ্যায় রামদেবের সঙ্গে পৃথক বৈঠকও করেছেন সুবোধ।
তবে চার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিমানবন্দরে চলে যাওয়ার ঘটনা সনিয়া-মনমোহন অনুমোদন নিয়ে হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে জানানো হলেও আজ কংগ্রেসের মধ্যে ভিন্ন সুরও শোনা গিয়েছে। দলের শীর্ষ স্তরের কিছু নেতা এই অস্বস্তি মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য, রামদেবের সামনে এমন ভাবে ‘মাথানত’ করা অর্থহীন। অপমানজনক। এ ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের সঙ্গে কোনও আলোচনাই করেননি। এমনটা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে যে কেউ অনশনের হুমকি দিয়ে সরকারকে ব্ল্যাকমেল করবে। তখন কী করবে সরকার?
প্রকাশ্যেই রামদেবের সমালোচনা করেছেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের তরফে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দিগ্বিজয় সিংহ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আবেদন করার পর রামদেবের তখনই অনশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা উচিত ছিল। তাঁর কথায়, “কংগ্রেস গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী বলেই এখনও রামদেবকে খোলা ছেড়ে রেখেছে। না হলে অনশনের হুমকি দেওয়া মাত্র গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে পারত।”
দিল্লিতে রামদেব। এএফপি

সরকার এবং কংগ্রেসের একাংশের মধ্যে এই মতান্তর কতটা আসল আর কতটা কৌশলগত, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, অন্তত আজকের দিনটিতে বিমানবন্দরে চার মন্ত্রীর যাওয়া নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। কংগ্রেসের নেতা-সমর্থকদের অধিকাংশ তা নিয়ে ক্ষুব্ধ। তাই সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে কংগ্রেসের তরফে কিছুটা ভারসাম্য রাখার প্রয়াস করা হয়েছে বলেও অনেকে মনে করছেন। যাতে দ্বিতীয় একটা পথও খোলা থাকে। ঠিক তাই দিগ্বিজয়ও রামদেবের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।
দলের মধ্যে ভিন্ন সুর উঠলেও পরশু কিন্তু চার মন্ত্রী ফের রামদেবের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সে কথা আজ বিকেলে সরকারি ভাবেই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। পরশুর ওই বৈঠকের আগে আজ রাতে ৭ রেসকোর্স রোডে মনমোহন সিংহের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রণব-সিব্বলরা। কাল কোর গ্রুপের বৈঠকে প্রণববাবু শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন। তার পর যা সিদ্ধান্ত হবে তা নিয়ে পরশু তিনি যাবেন রামদেবের সঙ্গে কথা বলতে।
আজ দুপুরে মধ্যপ্রদেশের ইনদওর থেকে একটি বেসরকারি বিজনেস জেটে দিল্লি এসে পৌঁছন রামদেব ও তাঁর সতীর্থ বালকৃষ্ণ। বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে প্রথমে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন সিব্বল, বনশল ও সুবোধকান্ত। পরে যোগ দেন প্রণববাবু। বৈঠকের পর রামদেব বলেন, “অনশন সত্যাগ্রহের কর্মসূচিতে এখনও অনড় রয়েছি আমি। দিল্লির রামলীলা ময়দানে সেই সত্যাগ্রহ শুরু হবে ৪ জুন। দেশের ৬২৪টি জেলায় এক কোটির বেশি লোক তাতে অংশগ্রহণ করবেন। তাতে সমর্থন জানাবেন আরও দশ কোটি মানুষ। আমাদের মূল লক্ষ্য, দুর্নীতি দমন ও কালো টাকা উদ্ধার। এ ব্যাপারে আজ সরকারের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।” তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে দাবিগুলির উল্লেখ করেন। সেগুলি হল, এক, সরকারকে লোকপাল আইন ও পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি আইন পাশ করতে হবে। দুই, দেশের সব শহরে ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গঠন করতে হবে, যেখানে এক বছরের মধ্যে দুর্নীতি সংক্রান্ত সব মামলার নিষ্পত্তি ঘটিয়ে দোষীদের কারাবাস থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো শাস্তি দিতে হবে। তিন, বিদেশের ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত সব কালো টাকা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বলে সরকারকে ঘোষণা করতে হবে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “কখনওই বলিনি প্রধানমন্ত্রী লোকপালের আওতার বাইরে। আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রী এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে লোকপালের আওতায় রাখা উচিত কি না, তাই নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন।”
অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার হওয়া নিয়ে অবশ্য আলোচনাকারীরা আশাবাদী। সিব্বল বলেন, আলোচনা ইতিবাচক পথে এগোচ্ছে। আরও বৈঠক হবে। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, আশা করা হচ্ছে ৪ তারিখের আগেই মীমাংসা হয়ে যাবে। তবে রামদেব অনশন সত্যাগ্রহ কর্মসূচি নিয়ে যতটা সুর চড়িয়ে ফেলেছেন, তাতে তা প্রত্যাহার করা তাঁর পক্ষে সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে হয়তো ৪ তারিখ তিনি অনশনে বসার পর সরকারের তরফে কোনও দূত তাঁর কাছে পাঠানো হবে। তার পর তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন।
তবে এগুলি সবই কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা এবং সম্ভাবনার কথা। আসল কথা হল, জট কাটেনি। তাই সঙ্কট মোচনে মরিয়া প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব।

First Page Desh Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.