আপনার কলমে


অচিনপুরের পথে
জয়তী বসু চৌধুরী
(লস অ্যাঞ্জেলেস)
গুপি-বাঘার মতো হাততালি দিয়ে হঠাত্ আমরা এমন এক অচিনপুরে পৌঁছলাম, যেখানে কেউ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। সুন্দর সে দেশে অগত্যা তাই হাত-পা ছুঁড়ে অভিনয় দক্ষতার কেরামতি দেখিয়ে অন্যকে নিজের কথা বোঝানো ছাড়া উপায় নেই! চিন যাওয়ার আগে খুব সামান্য কিছু ধারণা ছিল সে দেশ সম্পর্কে। তবে এটুকু জানতাম, প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিনের হাতেই পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারতের থেকে হয়তো একটু বেশিই উন্নত হবে; এমন একটা অগভীর ভাবনা নিয়ে চিন পৌঁছলাম।

কিন্তু প্রথম দর্শনেই ভাষা বিভ্রাটে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা এই ভাষা সমস্যার একটা আভাস আগেই পেয়েছি। তাই সাত দিনের এই পারিবারিক ভ্রমণে ইংরেজি বলতে পারা ট্যুর গাইডের বন্দোবস্ত করেছিলাম। তা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কথার বাইরে কিছু বলতে গেলেই ঠোক্কর খেতে হয়। অচেনা দেশ, তাই উত্তেজনা ভরা মনে অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছে। তবু, ঝাঁ চকচকে বেজিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর থেকে হোটেলের পথটুকু মুখ বুজেই বসে থাকতে হল। দু’পাশের পরিষ্কার রাস্তাঘাট, ঝকঝকে ও অত্যাধুনিক বাড়ি দেখে চোখ ভরে যায়। কিন্তু মন ভরে না। দু’টো কথা না বলতে পারলে যেন শান্তি নেই!
পৃথিবীর সব থেকে জনবহুল এবং আয়তনের দিক থেকে এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র চিন। দেশের উত্তরপ্রান্তে রাজধানী শহর বেজিং, পুরনো নাম পিকিং। বেজিং-এ অনেক দর্শনীয় জায়গা রয়েছে। ঐতিহাসিক ও আধুনিক— দু’ ধরনের জায়গাই রয়েছে সে তালিকায়। শৃঙ্খলা এবং পরিশ্রম একটা দেশকে যে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, ভেবে অবাক লাগে! নিজেদের ঐতিহ্য এবং ভাষা ধরে রাখার প্রচেষ্টা এ দেশের সর্বত্রই চোখে পড়ে। পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে মহিলারাও সমস্ত রকম কাজে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। আমাদের তিন দিনের বেজিং বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবে মহিলা এবং পুরুষ গাইড পেয়েছি।

প্রথম দিন দেখতে গেলাম বিশ্বখ্যাত চিনের প্রাচীর। প্রায় ১৩ হাজার মাইল দীর্ঘ এই প্রাচীর মূলত চিনের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য তৈরি করা হয়। পাহাড়ের উপর এঁকেবেঁকে অজগর সাপের মতো চিনের প্রাচীরের বিস্তার। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য। ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালে এই ‘গ্রেট ওয়াল’কে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য স্থাপত্যের শিরোপা দেয়। পুরো প্রাচীরটাই পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ঘোরা যায়।

আমরাও প্রাচীন এই প্রাচীরের সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা হাঁটলাম। জনশ্রুতি বলে, পাথরের এই সিঁড়ির নীচে পাওয়া গিয়েছে মানুষের হাড়। বিশালাকার এই প্রাচীর নির্মাণের পিছনে হাজার হাজার মানুষের আত্মবলিদানের গল্প সেখানে লুকিয়ে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমণোন্মুখ মানুষে ছেয়ে গিয়েছে পুরো প্রাচীর। তাঁদের মধ্যে ভারতীয় তো বটেই কয়েক জন বাঙালির সঙ্গেও পরিচয় হল। খুব ছোট বয়স থেকে ইতিহাস বইয়ে যে চিনের প্রাচীরের ছবি দেখে এসেছি, মেঘলা দিনে সেই ছবিই হাতের মুঠোয় পাওয়ার পাশাপাশি সেখানে বাঙালির দেখা পেয়ে আমরা তো আনন্দে আত্মহারা!

এর পরের গন্তব্য ‘সামার প্যালেস’। বেজিং শহরের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ছোট একটি পাহাড়ের উপর কুনমিং হ্রদের ধারের এই গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ চিনের অন্যতম এক জনপ্রিয় জায়গা। ১৭৫০ সালে রাজপরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল হিসেবে এই প্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এখন জনসাধারণের প্রমোদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে গেলাম ‘পাখির বাসা’ বা বেজিং ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। স্থাপত্য শিল্পের অত্যাধুনিক নমুনা এই অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ২০০৮ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের সময় স্টেডিয়ামটির উদ্বোধন হয়।
লামা টেম্পল টেম্পল অফ হেভেন পুরনো বেজিং-এর রাস্তা
বেজিং শহরের রাস্তায় প্রচুর গাড়ি এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রয়েছে যানজট। গাইড ভদ্রলোক জানালেন, যানজট নিয়ন্ত্রণে কোন গাড়ি কবে রাস্তায় বেরোবে তার নির্দিষ্ট সময় ও দিন ঠিক করে দেয় সরকার। শুনলাম, সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণেই গুগল ও ফেসবুক-এর মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইট খোলার অনুমতি পায়নি এ দেশে।

চিন ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমরা গেলাম নিষিদ্ধ শহর বা ফরবিডেন সিটি লাসায়। মিং সাম্রাজ্য থেকে কিউং সাম্রাজ্য পর্যন্ত সম্রাটদের বাসস্থান ছিল এই শহর। প্রবেশপথেই পড়ে তিয়ান মেন স্কোয়্যার। ইতিহাসের বইয়ের পাতা থেকে উঠে এল অনেক স্মৃতি। এর পর আমরা গেলাম ‘লামা টেম্পল’-এ। এটি চিনের অন্যতম বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ মঠ। অপূর্বসুন্দর এই মঠে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরি বিরাট এক বুদ্ধমূর্তি। এ ছাড়া এই মন্দিরে রয়েছে আরও তিনটি বুদ্ধমূর্তি। যার মধ্যে প্রায় ২৬ মিটার লম্বা, বিশালাকার একটিমাত্র চন্দনকাঠে নির্মিত বুদ্ধ মূর্তিও রয়েছে। ১৯৯৩ সালে গিনেস বুক এফ রেকর্ড-এ এই মূর্তিটি অন্তর্ভুক্ত হয়।

এ বার পেট পুজোর পালা। এ দেশের মানুষের খাদ্যাভাসের বৈচিত্র পৃথিবীর অন্য যে কোনও দেশকে পেছনে ফেলে দিতে পারে। বিভিন্ন রেস্তোরাঁতে চিনা এবং আমেরিকান— দু’ ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। চিনা মেনুতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, পৃথিবীর কোনও প্রাণী শরীরের কোনও অংশই চিনারা ফেলে দেন না। আরশোলা, বিছে, মাকড়শা ভাজা থেকে শুরু করে হাঙরের জিভ, লেজ, যকৃত— সবই পরম তৃপ্তির সঙ্গে খান এঁরা। চিনা নাগরিকদের খাদ্য-বৈচিত্র দেখলে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ’। এর সঙ্গে অবশ্য বিভিন্ন নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া, চিনের বিভিন্ন রকম চা— লিচু থেকে লেবু, কত রকম স্বাদের যে চা মেলে এখানে! সে স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। চা-রসিক বাঙালিদের কাছে এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

তৃতীয় দিন গেলাম ‘টেম্পল এফ হেভেন’-এ। বেজিং-এর অন্যতম ধর্মীয় আকর্ষণ। চিনের সম্রাটরা প্রতি বছর নবান্নের সময় প্রার্থনা করতে এই মন্দিরে আসতেন। ১৯৮৮ সালে এই মন্দির সংলগ্ন একটি উদ্যান জনসাধারণের প্রমোদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মন্দির সংলগ্ন সেই পার্কে অনেককেই তাস, ক্যারাম, ব্যাডমিন্টন-সহ অন্যান্য খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখলাম।

আমাদের বেজিং সফরের শেষ দিনে এক বার ঢুঁ মেরে এলাম, পুরনো বেজিং-এ। সেখানে তেমন আধুনিকতার ছোঁয়া নেই, অনেকটা আমাদের পুরনো কলকাতার মতো। কলকাতার স্মৃতি আরও জাগিয়ে তুলল ওখানকার ‘হাটং রাইড’ বা রিকশা। চড়তে খুব মজা!
বুলেট বা হাই স্পিড ট্রেন সাংহাইয়ের নজরকাড়া স্থাপত্য
তিন দিন বেজিং ঘোরার পর গেলাম ১৩০০ কিলোমিটার দূরের সাংহাই শহরের দিকে। বেজিং থেকে সাংহাই বুলেট বা হাই স্পিড ট্রেনে করে গিয়েছিলাম। এই ট্রেনের গতি ঘণ্টায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। তাই মাত্র সাড়ে ৫ ঘণ্টায় সাংহাই পৌঁছে গেলাম। গতি ছাড়াও বুলেট ট্রেনের অভ্যন্তরীন সাজসজ্জা খুবই চমকপ্রদ। বসা, খাওয়া ও শোওয়ার ব্যবস্থা দেখার মতো! এমন সুন্দর ভাবে এই জনবহুল ট্রেনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে রাখা হয়েছে, প্রশংসার যোগ্য। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নতুন বা ভাল কিছু দেখলেই মনে হয়, ইস্, আমাদের দেশে যদি এমন হত! তবে এটা ঠিক, রেল পরিষেবায় চিন পেছনে ফেলে দিয়েছে আমেরিকাকেও।

বাণিজ্য শহর সাংহাই চিনের সবচেয়ে বড় শহর। পূর্ব চিনের ইয়াংসি নদীর ধারের এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় ২৩ মিলিয়ন। আকাশছোঁয়া বাড়ি আর তার নজরকাড়া স্থাপত্য চোখের পলক ফেলতে দেয় না! চিনের অর্থনৈতিক উন্নতির নমুনা পাওয়া যায় এই শহরে এলে। আমাদের ট্যুর বাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষে ভর্তি। সবাই এসেছেন তাঁদের কোম্পানির ব্যবসায়িক কাজে। তার ফাঁকেই চলছে শহর দেখা। বেজিং শহরের আনাচে কানাচে শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের যে গল্প ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ছড়াছড়ি তার অভাব বোধ করলাম সাংহাইতে।

সাংহাই থেকে এ বার ফের আমেরিকায় ফেরত আসার পালা। এশিয়ার একটি দেশের এমন অবিশ্বাস্য উন্নতি দেখে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছিল, ভারত আবার জগত্ সভায় কবে শ্রেষ্ঠ আসন লবে?

এক কথায়: চিনের মানুষের খাদ্যাভাসের বৈচিত্র পৃথিবীর
অন্য যে কোনও দেশকে পেছনে ফেলে দিতে পারে।

কলকাতার মেয়ে। স্বপ্নপূরণের ইচ্ছায় আমেরিকা পাড়ি। বিদেশেই আবার নতুন করে পড়াশোনা ও কাজকর্ম। লস অ্যাঞ্জেলেস শহর বর্তমান বাসভূমি হলেও মনের বাসস্থান এখনও প্রিয় কলকাতা। অবসর সময়ে ভাল লাগে কবিতা লিখতে আর গান শুনতে। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে পছন্দের মানুষদের সঙ্গে আড্ডা মারতে।
ছবি: লেখক।
লেখকের অন্য ভ্রমণকথা
• জাদুনগরীতে কয়েক দিন

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ