আপনার কলমে...
১৮ চৈত্র ১৪১৮ রবিবার ১ এপ্রিল ২০১২


স্থাপত্যের বিহ্বলতা আর টিউলিপ-এর সৌন্দর্য
নে মনে প্ল্যান করছি বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে কী ‘সারপ্রাইজ’ দেওয়া যায়, এমন সময় আমার বস টেলিফোনে বললেন, “একটা ক্রিটিকাল অ্যাসাইনমেন্ট এসেছে, আমস্টারডাম আইটি সিস্টেম আমাদের মালয়েশিয়া ডাটা সেন্টারে মাইগ্রেট করতে হবে। তুমি এক সপ্তাহের জন্য ওখানে যাও, আর টেকনিক্যাল টিমকে সেট করে চলে এসো।” শুনে মনে হল যাব্বাবা, এ বছরও বিবাহবার্ষিকী চৌপাট! শেষমেশ কোনও রকমে ‘বস’কে রাজি করালাম, বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন ফেরত চলে আসব।

আমাদের উড়ান ‘ক্যাথে পেসিফিক’ মালয়েশিয়া থেকে সন্ধে ছ’টা পঁয়তাল্লিশে ছেড়ে হংকং-এ পৌঁছল রাত সাড়ে দশটায়। এখান থেকে আবার রাত একটায় ওড়া শুরু করে আমস্টারডাম পৌঁছবে ভোর সাড়ে ছ’টায়। আমার এ রকম দীর্ঘ উড়ান একেবারেই পছন্দ নয়! কিন্তু উপায় নেই। তবুও ভাল, আমার টিকিট ‘বিজনেস ক্লাস’-এর। অন্তত পা-টাকে একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা যাবে, আর খাতিরও পাওয়া যায় ভাল।

আমস্টারডামে নির্ধারিত সময়ে নামলাম। নেমেই সাইফল বিমানবন্দরের পরিবেশটা এত ভাল লাগল যে বলার নয়! শীতের সকালে কুয়াশা ঘেরা বন্দর মুচকি হেসে যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ‘লাগেজ’ ঠেলে বাইরে আসতেই, ৩ ডিগ্রির হিমেল হাওয়া হাড় কাঁপিয়ে দিল। একটা প্রিপেড ট্যাক্সি নিয়ে কোম্পানির ঠিক করা হোটেলে পৌঁছলাম। এখানে থাকতে প্রতি দিনের ঘর ভাড়া ১৪৫ ইউরো! আমস্টারডামের হিসেবে খুবই দামি। আমার কাজের জায়গা এই হোটেলটির একদম গায়ে লাগানো বলে সুবিধা। সাধারণত ৭০-৭৫ ইউরোর মধ্যে মোটামুটি ভাল হোটেল পাওয়া যায় এখানে।

হোটেলে ‘চেক ইন’ করে, ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন ভারী হয়ে গেল! শহরটা শীতের সকালে পরম আবেশে ঘুমোচ্ছে। সে দিন রবিবার। আমার সঙ্গী রামিশের ঘরে ফোন করে বললাম, ‘‘স্নান করে রেডি হয়ে নে, চল বেরোই।’’ কাছাকাছি কী কী দেখার আছে, জিজ্ঞেস করায় সুন্দরী রিসেপশনিস্ট মুচকি হেসে বললেন, “পারলে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসুন, আর কোকেনহলফটা মিস করবেন না।” লক্ষ করলাম, এরা আর ইউরোপীয়দের মতো ‘স্নবিশ’ নেই, বেশ হাসিখুশি আর ‘হেল্পফুল’।

পুরো শহরটা ছোট ছোট ক্যানালে ঘেরা।
হোটেল থেকে শহরের একটা মানচিত্র সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম। বাইরে বেরিয়েই প্রথমে চোখে পড়ল সাইকেল। কলকাতাতেও বোধহয় এত সাইকেল দেখা যায় না। আমস্টারডামে জনপ্রিয় পরিবহন ব্যবস্থা বলতে— ট্রাম, সাইকেল আর ক্যানাল বাস। ও, বলতে ভুলে গেছি, আমস্টারডাম শহরটাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ মিটার নীচে! আর পুরো শহরটা ছোট ছোট ক্যানালে ঘেরা। ইতিহাস অনুযায়ী আমস্টারডামে আগে অ্যামস্টেল নামে একটাই নদী ছিল। জল নিয়ন্ত্রণ করতে তাকে ঘিরেই প্রথমে একটা ড্যাম তৈরি হয়। তার পর আস্তে আস্তে সেই জায়গাটা ঘিরে একটা জনবসতি গড়ে ওঠে। অঞ্চলটি তাই প্রথমে অ্যামস্টেলড্যাম এবং পরে আমস্টারডাম নামে পরিচিত হয়েছে।


মাদাম তুসো’র মিউজিয়াম

প্রদর্শনী ও সভাগৃহ, আরএআই
হোটেলের ঠিক গায়েই আমস্টেল ক্যানাল। ৫ মিনিট হাঁটার পর চোখে পড়ল শহরের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী ও সভাগৃহ, আরএআই। তার পাশেই এখানকার সবচেয়ে পুরনো রিজক্স জাদুঘর। আমস্টারডামে ৫০টিরও বেশি জাদুঘর আছে। ভ্যানগঘ, মাদাম তুসো, আনা ফ্রাঙ্ক-সহ আরও অনেক বিখ্যাত জাদুঘরে শহরটা মোড়ানো। আমরা ১২ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে রিজক্স জাদুঘরের ভিতরে ঢুকলাম। স্থাপত্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিছু কিছু ‘পেইন্টিং’ এত জীবন্ত, মনে হয় এই যেন বেরিয়ে এসে কথা বলবে!

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে সামনের ক্যানাল স্টেশন থেকে ১৩ ইউরোর একটা ‘ডে পাস’ কেটে আমরা সেন্ট্রাল স্টেশনের বাইরে সাইকেলস্ট্যান্ড দেখে আবার অবাক হয়ে গেলাম। বিশ্বাস হয় না, এত সাইকেল এখানে থাকতে পারে! শহরটার পরিবহন ব্যবস্থাটা এখানকার বাতাসকে এখনও এত শুদ্ধ রেখেছে! আমাদের মতো বাতাসে পেট্রোল-ডিজেলের গন্ধ ভাসে না। কিছু জায়গা পায়ে হেঁটে ঘুরেফিরে ঠিক করলাম আগে কিছু খেয়েনি, তার পর কোকেনহলফ যাব। ‘কেএফসি’তে ৭ ইউরো দিয়ে বার্গার খেয়ে কোকেনহলফের বাস ধরতে গেলাম। এখানেও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতন খাওয়া দাওয়া মানেই বেশির ভাগই ‘ফাস্ট ফুড’।


কোকেনহলফ

‘কানেকশন’ কোম্পানির বাস ধরে কোকেনহলফের দিকে রওনা দিলাম। কোকেনহলফ আমস্টারডাম থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে লিসে বলে একটা ছোট গ্রামের মধ্যে অবস্থিত। ২১ ইউরোতেই ‘রিটার্ন’ টিকিট ও কোকেনহলফের ‘এন্ট্রি’ টিকিট পাওয়া গেল। এটাকে ‘কম্বি টিকিট’ বলা হয়। বাসে উঠে জানলার পাশে বসতেই বাইরের ফুরফুরে হাওয়ায় চোখ বুজে গেল। কত ক্ষণ ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই, হঠাত্ করে অনেকের ‘ওয়াও, ওয়াও’ শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই দেখি বাইরে যেন রঙের মেলা। মাইলের পর মাইল জুড়ে লাল-হলুদ রং দিয়ে কারা যেন রাঙিয়ে দিয়েছে। চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

বাস থামার পর তাড়াতাড়ি নেমেই সোজা ‘প্রবেশ পথ’ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঢোকার পর মনে হল এ কোন স্বপ্নপুরীতে চলে এসেছি! যে দিকে তাকাই, শুধু ফুল আর ফুল। টিউলিপ যে এত বর্ণময় আর সুন্দর হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! প্রায় ৮০ একর জমি নিয়ে এই পার্ক। টিউলিপ মাত্র তিন মাসের জন্য ফোটে। এপ্রিল থেকে জুন। কিন্তু কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন এঁরা প্রত্যেকটি টিউলিপকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য! এখানে না আসলে বুঝতাম না, কেন টিউলিপ এত দামি! আমার দৈহিক ক্নান্তিও যেন অবাক বিস্ময়ে টিউলিপের অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কাছে হার মেনেছে! নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত উইন্ডমিলের কিছু স্থাপত্য-নমুনা এই টিউলিপ গার্ডেনে রয়েছে। পার্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, আসতে মন না চাইলেও বেরোতে হল। কোকেনহলফকে ফেলে আমাদের বাসটা যখন আমস্টারডামের দিকে ফিরে যাচ্ছে, তখন কেমন যেন অদ্ভুত বিচ্ছেদ-বেদনা অনুভূত হচ্ছিল। মনে মনে বললাম, আবার আসব, তবে সপরিবারে।

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

হোটেলে ফিরে শরীরটা কোনও রকমে বিছানায় ঠেকিয়ে দেওয়া মাত্রই, সমস্ত ক্লান্তি যেন আমাকে পরম মমতায় ঘুমের দেশে নিয়ে গেল।

পরের দু’দিন অফিস আর হোটেল করেই কেটে গেল। কোনও সময় পেলাম না নিজের জন্য। অফিসে শুনলাম, ৩০ এপ্রিল ছুটি, কারণ সে দিন ‘কুইন্স ডে’। ২৯ এপ্রিল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। সেই দিন বিকাল বিকাল আমরা কয়েক জন শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। ঠিক হল আমরা হেঁটেই ঘুরব। রাস্তায় নামার পর মনে হল, কলকাতায় ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি। চার দিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। সবাই খুব আনন্দ আর মজা করছে। প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে ভীষণ জোরে গান বাজছে আর সবাই উন্মাদের মতো নাচছে। শব্দের উচ্চমাত্রা যে এত সুন্দর হতে পারে, ধারণা ছিল না। চার দিকে শুধু বিয়ারের ছড়াছড়ি আর ভীষণ জোরে গান আর নাচ। সাধারণত নেদারল্যান্ডসের মানুষদের খুব সুন্দর দেখতে হয়। মনে হচ্ছিল যেন গ্রিক দেবদেবীদের মাঝে এসে পড়েছি! আমরা পায়ে হেঁটে পুরো আমস্টারডাম শহরটা ঘুরে ফেললাম।


‘কুইন্স ডে’
মাদাম তুসো’র মিউজিয়ামের ঠিক সামনে একটা বিশাল মঞ্চে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। এ দেশের ‘ন্যাশনাল টেলিভিশন’ সেই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করছিল। এত ভিড় কিন্তু কি সুশৃঙ্খল! কোথাও কোনও রকম ধাক্কা নেই, কোনও চিৎকার নেই, কারও কোনও গলাবাজি নেই! সবাই উদ্দাম আনন্দে বিভোর। দেখে এত ভাল লাগল!

রাত দুটোর সময় হোটেলে ক্নাম্ত হয়ে ফিরে শুয়ে পড়লাম। ঘুমই আসতে চাইছে না! পুরো বিকেল আর সন্ধের ‘ইভেন্ট’গুলো ‘ফ্ল্যাশব্যাক’-এর মতো বারে বারে মনে ফিরে আসছিল। ভাবছিলাম আমরা এ রকম সুশৃঙ্খল আমুদে হয়ে থাকতে পারি না!

পরের দিন সকাল সাডে় ন’টায় আমার সহকর্মীদের ফোনে ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি উঠে, নীচে ‘বুফে ব্রেকফাস্ট’-এ চলে গেলাম। সবাইকে কেমন যেন অন্য রকম দেখতে লাগছে! সবাই কমলা রঙের পোশাক পরে। ১১টা নাগাদ যখন হোটেলের বাইরে পা রাখলাম, মনে হল এক্কেবারে আলাদা এক আমস্টারডামে এসে পৌঁছেছি। সবাই কমলা রঙের পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তায় প্রচুর কাগজ পড়ে আছে, গত রাতের উদ্দাম ‘পার্টি’র স্মৃতি নিয়ে। জানলাম এই দিন নেদারল্যান্ডসবাসীরা তাদের পুরনো জিনিস বিক্রি করতে পারে রাস্তায় বসে। বিক্রি করা এদের পেশা নয়। এরা শুধুই আনন্দের জন্য বিক্রি করে।

আমরা যখন ‘সেন্ট্রাল লোকেশন’-এ পৌঁছলাম, দেখা গেল সবাই নিজেদেরকে কমলা রঙে রাঙিয়ে এখানকার বিখ্যাত ভেঁপুর আওয়াজে আকাশ বাতাস ভরিয়ে দিচ্ছে। সবাই নাচ-গান করছে, কিন্তু কি অদ্ভুত সুশৃঙ্খল অবস্থায়! মাদাম তুসো’র মিউজিয়ামের বাইরে গত রাতের অনুষ্ঠানের জায়গাটা ছেঁড়া খবরের কাগজে ভর্তি। অনেক পুলিশকর্মীও আছেন।

আমরা ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এলাম, যেখানে গানের সঙ্গে একটি দল আনন্দ করছে। কাছে গিয়ে দেখি ওটা সমকামীদের দল। চার দিকে এত সৌন্দর্যের মাঝে, ছেলেরা ছেলেদের চুম্বন করছে দেখে একটু বিসদৃশ লাগল। হয়তো আমরা মানসিক ভাবে এখনও তৈরি হইনি! এই দেশ ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খুব শ্রদ্ধা করে। এখানে ‘কফি শপ’গুলো আইনি পথেই ড্রাগ বেচে!

অফিসের কাজ শেষে ফিরে আসার দিন সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, বেদনা মিশ্রিত আনন্দ! বিমানবন্দরে পৌঁছে ‘ডিউটি ফ্রি শপ’ থেকে স্ত্রীর জন্য ‘পারফিউম’ আর বাইরে থেকে একটা হার ও কিছু টিউলিপ কিনে আস্তে আস্তে মালয়েশিয়াগামী ‘ক্যাথে পেসিফিক’-এর ‘বিজনেস ক্লাস’-এর লাইনে ‘চেক ইন’ করার জন্য দাঁড়ালাম।

এক কথায়: এত ভিড় কিন্তু কি সুশৃঙ্খল! কোথাও কোনও রকম
ধাক্কা নেই, কোনও চিৎকার নেই, কারও কোনও গলাবাজি নেই!
 
সন্দীপ সামন্তর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এ বঙ্গেরই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ায়। পেশায় ‘সিনিয়র আইটি ম্যানেজার’। বর্তমানে একটি লজিস্টিক কোম্পানির মালয়েশিয়ার ‘গ্লোবাল ডাটা সেন্টার’-এর ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার টিম’কে ‘ম্যানেজ’ করাই তাঁর কাজ। ২০০১ সাল থেকেই মালয়েশিয়ায় বসবাস। ঘুরে বেড়ানো একটা পারিবারিক নেশা। ফোটোগ্রাফির শখও আছে।

ছবি: লেখক

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি স্বাদবদল পুরনো সংস্করণ