এই ‘ঘিঞ্জি’ শহরেও লুকিয়ে
আছে আমার ‘ভাল লাগা’ লোপামুদ্রা মিত্র সঙ্গীত শিল্পী
স্বপ্ন সব সময় তো বাস্তব হয় না। তাই কাজের ফাঁকে কোনও কোনও দিন একটু সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ি অ্যাকাডেমি বা অন্য কোথাও ভাল নাটক দেখতে। ইচ্ছে হলে দক্ষিণ কলকাতার কোনও শপিং মলে কেনাকাটাও করি। এক এক সময়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়েও যাই। বেশ মজা লাগে। কেউ কেউ আমাকে চিনেও ফেলেন। তাঁদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মারি। আমার অনেক ফ্যান চিঠি লিখে জানান, আমি এখনও কেন সকলের সঙ্গে এত সহজ সরল ভাবে মেলামেশা করি। আসলে অনেকেই জানেন না, মানসিক ভাবে আমি সেই মানুষ, যেখানে ‘আমি’ আমাতেই রেখেছি। ‘অহং’বোধ গ্রাস করেনি।
এই তো সে দিন ‘গীতবিতান’-এর পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে টপাটপ ফুচকা মুখে পুরছিলাম। দারুণ ফুচকা! হঠাৎ পাশে দেখি অনেকগুলি কৌতূহলী মুখ আমায় মাপছে। এক জন বলেই ফেললেন, ‘‘আপনি প্রায়ই এখানে এসে ফুচকা খান। ভাবতাম আপনি লোপামুদ্রার মতোই কেউ এক জন হবেন!’’ এমন হেসেছি যে তাঁরাও বেশ লজ্জা পেয়ে গিয়েছেন। এখানে ফুচকা খেতে প্রায়ই আসি। কখনও আবার চলে যাই দক্ষিণাপনের পাশের গলিতে। অনেকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। ওরাও হয়তো এমনটাই ভেবে থাকেন। কে জানে!
জানেন তো এই শহরকে এত ভালবাসি, কিন্তু একটা ব্যাপারে খুবই অভিমান আছে। এই শহরে কোথাও প্রেম করার জায়গা নেই। নিরিবিলি নেই। চার দিকে শুধু মানুষের জটলা। কৌতূহলের চোখ ঘুরছে। শহরটা ক্রমশ কেমন ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে। তাই প্রেম জমছে না। সত্যিই তো, প্রেমহীন জীবন কারই বা ভাল লাগে। আমার তো মনে হয়, প্রেম করা ভাল। শরীর ও মন দুই-ই ভাল থাকে। আমার বিয়ে একটা, প্রেম কিন্তু অনেক। অনেকেই প্রেম কথাটার অর্থ ভীষণ বিকৃত করেন, আমি তাঁদের ওই কথার প্রতিবাদ করি।
তবুও এই ‘ঘিঞ্জি’ শহরটাকে ভীষণ ভালবাসি। বিদেশে অনুষ্ঠান করতে গেলে কয়েক দিন পর থেকেই কলকাতার জন্য মন খারাপ হতে থাকে। বারবার মনে হয় কী যেন মিস করছি। প্রেম করলে তার জন্য মন খারাপ হবে না? আমার অনেক প্রেমের মধ্যে অন্যতম হল— লেক, আমার প্রিয় প্রেমিক। যাকে মনে মনে আদরও করি। উফ্, শুধু মনে হয়, সারা দিন ওই লেকের কোলে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। কথা বলি। গান শোনাই। আমাকে পাগল ভাববেন না যেন! লেকের একটা নিজস্ব প্রাণ আছে। আমি দেখতে পেয়েছি। তাই এখনও স্বপ্ন দেখি— ওই উঁচুতলায় আমি থাকি। যেখান থেকে সারা দিন শুধু লেক দেখতে পাই।
আমার অনেক প্রেমের মধ্যে আরও দু’টি হল, শ্রীহরির হালুয়া-কচুরি,আর রাদুবাবুর ওমলেট-পাউরুটির সঙ্গে চা।
আমি হাজরার মেয়ে। এখানে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় ঘুম ভাঙত রাস্তা ধোওয়ার শব্দে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতাম, কালো পিচের রাস্তা যেন ঝাঁ-চকচকে হয়ে ভীষণ হাসছে। ভোরের সেই ধোওয়া রাস্তায় একা একা কত দূর হেঁটে গেছি। এখন সকালে তো সময় পাই না। সেই দুঃখ কাটাতে চলে যাই দক্ষিণেশ্বর-বেলুড়ে। সন্ধেয় দক্ষিণেশ্বর ব্রিজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীচের ওই গঙ্গার নীরবতা আমাকে নিয়ে যায় এক অন্য জগতে। গেয়ে উঠি, ‘বলো কলকাতা তুমি এখন কার’।
কী অনুভূতি! এমন আনন্দে সারাটা জীবন কাটবে তো?
জানি না। আনন্দের মাঝে তো দুঃখও আছে। কী সেই দুঃখ, একটু বলব?
রাস্তায় চলতে চলতে যখন দেখি কোনও গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এমন নির্মম দৃশ্য মানতে পারি না। কোনও দিনও পারিনি। পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার তো ওরও আছে। এমনও হয়েছে, রাস্তার গাছ কাটা দেখে বাড়িতে এসে কয়েক ঘণ্টা ‘অফ মুডে’ কাটিয়েছি। মাঝে মধ্যে এমন হয় অন্য একটা কারণেও। এখন কলকাতায় বাংলা কথাটা খুব কম শোনা যায়। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোও ইংরেজিতে কথা বলছে, গল্প করছে। সবাই যেন ইংরেজির দিকেই ঝুঁকছে। তা হোক। কিন্তু একটু বাংলায় কথা বললে ক্ষতি কী?
আমার ভাল লাগা বা না লাগা— কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি কলকাতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই। ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে গাইব সেই গান, ‘উড়ছি আমি, কলকাতার প্রেমিকা’।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.