জনপদ
কুমোরপাড়ার ইতিকথা
র্ষা এখনও চলে যায়নি বটে কিন্তু বাংলা পঞ্জিকা বলছে, আশ্বিন মাস পড়ে গিয়েছে। আর আশ্বিন মাস মানেই, পুজোর মাস। তবে হিন্দু-বাঙালির সারা বছর ধরেই পুজো! বৈশাখের পয়লায় গণেশপুজো দিয়ে শুরু আর চৈত্রের শেষ দিনে চড়কপুজো দিয়ে শেষ। বারো মাসে অনেক পুজো থাকলেও সেগুলি শুধু সংশ্লিষ্ট দেবতার পুজো, আমজনতার উৎসব নয়। কিন্তু ‘পুজো’ বললে বোঝায় দুর্গাপুজো, যা কোনও ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়, আমজনতার উৎসব।

সব উৎসবেরই কিছু প্রস্তুতি থাকে। দুর্গাপুজোরও আছে। কেনাকাটি, মণ্ডপ নির্মাণ, প্রতিমা তৈরি আরও অনেক কিছু। তার মধ্যে থেকে প্রতিমা তৈরির পাড়ায় একটু ঘুরে আসা যেতে পারে। এই শহরের প্রতিমা তৈরির প্রধান জায়গার নাম কুমোরটুলি। নামেই এর পরিচয়।
কবে তৈরি হয়েছিল এই অঞ্চল?
বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরী বাড়ির পুজোকে সূচনা ধরলে শহর কলকাতার দুর্গাপুজোর ইতিহাস বড় জোর চারশো বছরের। আর কুমোরটুলির ইতিহাস বোধহয় তার কাছাকাছিই। না, সাবর্ণদের মূর্তি তৈরির জন্য নয়, অতীতে এই কুমোরপাড়ার খ্যাতি ছিল হাঁড়ি, কলসি ও অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য বাসনপত্র তৈরির জন্যই।

কলকাতা শহরের প্রকৃত নগরায়ন আরম্ভ হয় পলাশির যুদ্ধের পরে। কোম্পানির কুঠিতে কাজের আশায় গ্রামাঞ্চলের মানুষ তখন ধীরে ধীরে কলকাতায় ভিড় করছে। সে যুগে এখনকার মতো কাঁসা-পিতল-অ্যালুমিনিয়মের বাসন ছিল না, মাটির হাঁড়িকুড়িই ছিল সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের অঙ্গ। তাই প্রাথমিক ভাবে এখানে নিত্য ব্যবহার্য হাঁড়ি, কলসিই তৈরি হত। ইতিমধ্যে ভাগ্যান্বেষণে নদিয়া জেলা, বিশেষত কৃষ্ণনগর থেকে কিছু পুতুলের কারিগরও এসে বসতি গড়েন কুমোরটুলিতে। তাঁরা একটু বড়লোকদের জন্য ঘর সাজাবার পুতুল তৈরি আরম্ভ করলেন জীবিকার প্রয়োজনে। একটা সময়ের পর, যখন দুর্গাপুজো ক্রমে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল, তখন থেকে ছোট্ট সেই কুমোরপাড়া রূপান্তরিত হয়ে উঠতে লাগল প্রতিমা নির্মাণের প্রধানতম কেন্দ্রে।

কুমোরটুলির অবস্থানটা ঠিক কোথায়?
সাবেক কুমোরটুলি ঠিক কোথায় ছিল আজ তা বলা কঠিন। হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাবেক কুমোরটুলিও তার অবস্থান পাল্টেছে বারে বারে। আজকের কুমোরটুলির অবস্থান হল বাগবাজারের ঠিক পাশেই। মূল কুমোরটুলি অংশটি রয়েছে বনমালী সরকার স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে— উত্তরে কুমোরটুলি স্ট্রিট, দক্ষিণে অভয় মিত্র লেন, পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড আর পূর্বে রবীন্দ্র সরণির মধ্যবর্তী জায়গায়। অবশ্য এর বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও অনেকটা জায়গাই এখন মৃৎশিল্পীদের দখলে চলে গিয়েছে। আদিতে ওই সব জায়গাগুলির মালিকানা ছিল গোবিন্দরাম মিত্র, গোকুলচন্দ্র মিত্র, বনমালী সরকার, নন্দরাম সেন প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের। পরে ভাগ্যকুলের রায় পরিবারের কলকাতার বসতবাড়িও তৈরি হয়েছিল ওই অঞ্চলে। তাদের জমির কিছু অংশও এখন কুমোরটুলির অন্তর্গত। ওই সব ব্যক্তিরা কেউই কিন্তু মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন সে যুগের এক এক জন স্বনামধন্য মানুষ।

প্রথমে আসা যাক গোবিন্দরাম মিত্রের কথায়। সে যুগে লোকে তাঁকে বলত ‘ব্ল্যাক জমিনদার’। অসম্ভব দাপুটে ওই জমিদার দুর্নীতিপরায়ণও ছিলেন। ১৭৩০ সালে তিনি চিৎপুর রোডের উপরেই প্রতিষ্ঠা করেন এক বিশাল পঞ্চরত্ন মন্দির ও তাকে ঘিরে তিনটি দো’চালা ও দু’টি নবরত্ন মন্দির-সহ এক ‘মন্দির কমপ্লেক্স’। সাহেবরা ওই বিশাল পঞ্চরত্ন মন্দিরকে বলত ‘প্যাগোডা’। প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মধ্যে ১৭৩৭-এর ঝড়ে ভেঙে পড়ে মন্দিরের চূড়া। আরও পরে আস্তে আস্তে পুরো মন্দিরটিই ভেঙে যায়। পুরনো কলকাতার কয়েকটি ছবিতে গোবিন্দরাম মিত্রের ওই প্যাগোডার উল্লেখ রয়েছে।

এর পাশেই মদনমোহনতলা। ওখানকার মদনমোহন ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র মিত্রর আদি বাড়ি ছিল বালিতে। তিনি বর্গি হামলার সময়ে কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। লবন-ব্যবসায়ী গোকুলচন্দ্র খুব অল্প সময়ে প্রচুর টাকা রোজগার করেন। ও দিকে ওই বর্গিদের হামলাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ জমিদারি রক্ষা করতে এক বিশাল অঙ্কের টাকা ধার নেন গোকুলচন্দ্রের কাছ থেকে। পরিবর্তে বন্ধক রাখেন কুলদেবতা মদনমোহনকে।

বিষ্ণুপুর মল্ল রাজবংশের রাজা দুর্জন সিংহ ১৬৯৪ সালে বিষ্ণুপুরে মদনমোহন বিগ্রহ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, ওই বিগ্রহ ছিল রাজবংশের সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই অবস্থার ফেরে বন্ধক দিলেও, চৈতন্য সিংহ টাকা শোধ দিয়ে কুলদেবতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন।

বাগবাজারের মদনমোহন

বিষ্ণুপুরের মদনমোহন
এ দিকে ঘটনাচক্রে মদনমোহন ঘরে আসার পর থেকে গোকুলচন্দ্রের অবস্থারও উন্নতি হতে থাকে। ধর্মীয় সংস্কার বশে তিনি বিগ্রহ ফেরত দিতে রাজি হলেন না। ঘটনা গড়াল আদালত পর্যন্ত। ইতিমধ্যে চতুর গোকুলচন্দ্র আরও একটি বিগ্রহ তৈরি করিয়ে রাখেন এবং বিচারের সময়ে চৈতন্য সিংহকে আসল মদনমোহন বিগ্রহ চিনে নিতে বলা হল। হুবহু এক রকম দেখতে দু’টি বিগ্রহের মধ্যে থেকে একটি বেছে বিষ্ণুপুরে নিয়ে গেলেন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। আর অন্যটি রইল গোকুল মিত্রের কাছে, মিত্র পরিবারের কুলদেবতা হয়ে।

গোকুলচন্দ্র তাঁর এক বিঘেরও বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি বাড়ির দোতলায় নতুন কুলদেবতার জন্য মন্দির তৈরি করলেন। একতলায় তৈরি হল ঠাকুরদালান, বাড়ির পাশে আলাদা রাসমঞ্চ, দোল, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস প্রভৃতি উত্সব-অনুষ্ঠানে মদনমোহন ও রাধিকার বিগ্রহ ওই দালান-রাসমঞ্চে এনে বসানোর জন্য। গোকুলচন্দ্র মিত্রের সেই ঠাকুরদালান আজও আছে। দোল-রাস উৎসবও হয় সেখানে। পাশাপাশি এই দালানও এখন ছোটখাট এক কুমোরটুলি। পুরো দালান আর উঠোন জুড়ে তৈরি হয় নানা রকমের প্রতিমা।


পরিকল্পনার জের...
পুরো কুমোরটুলিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। কুমোরটুলির প্রায় চারশো শিল্পী-পরিবারকে অন্যত্র সাময়িক পুনর্বাসন দিয়ে ওই জায়গায় তাঁদের পুরনো আস্তানা ভেঙে নতুন ‘জি প্লাস ফোর’ আদলের স্টুডিওপাড়া গড়ে তোলার প্রস্তাব ছিল ওই প্রকল্পে। বলা হয়েছিল, প্রত্যেক শিল্পীকে স্টুডিও এবং ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। তৈরি হবে সুগম রাস্তা, নিকাশি ইত্যাদি। কাজটি রূপায়ণ করার কথা ছিল কেএমডিএ-এর। ২০০৭ সালের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখনও তার কিছুই প্রায় হয়নি। প্রথম পর্বে জনা তিরিশ শিল্পীর অস্থায়ী ঠিকানা হয়েছিল বাগবাজারে, স্বাস্থ্য দপ্তরের গোডাউনে। বাকিদের পুনর্বাসনের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি নানা কারণে। অতএব, উন্নয়ন এখন বিশ বাঁও জলে।

তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক
ছবি: লেখক ও ফাইল চিত্র
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.