...আর তার নানা চিত্র
হরের নাম লিখতে গিয়েই থামতে হল— কলকাতা, ক্যালক্যাটা, কলিকাতা, কইলকাতা না অধুনা ‘কোলকাতা’? যার যখন যেমন ইচ্ছে হয়েছে, সে তেমনি করেই কলকাতাকে ডেকেছে। কলকাতার তাতে কিছু এসে যায়নি। সে তার সই, গঙ্গার হাত ধরে সময়ের স্রোতে ভেসে চলেছে— আজ এক রকম, কাল অন্য রকম।

কলকাতা বদলে চলেছে। তাকে সব সময় চিনতে পারি না। আজকের কফি কর্নার, বহুতল, মল, উর্দ্ধমুখী অ্যাপার্টমেন্ট সমৃদ্ধ কলকাতা যেন রুপোলি পর্দার চমকে দেওয়া নায়িকা। তবে, আমি যাকে কাছ থেকে দেখেছি, তার পরনে ছিল ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুরের টিপ। দু’জনেই রূপসী, কিন্তু এক জনের সঙ্গে আর এক জনের তুলনা চলে না।

নতুনের আহ্বানে সাড়া দিতে দেশ ছেড়ে রওনা দিয়েছিলাম, অতলান্তিক পেরিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে। প্রবাসে, কোনও মন কেমন করা দিনে, জমা হওয়া স্মৃতির পসরা মাঝে মাঝে খুলে দেখি। আমার মনে ভেসে ওঠে কিছু মনে থাকা, কিছু ফিকে হয়ে আসা কলকাতার ছবি। মনের পুষ্পক রথে উড়ে যাই সেই সুদূরে, যেখানে ছড়িয়ে আছে আমার খেলা-চঞ্চল শৈশব, হাসিতে উচ্ছল কৈশোর আর স্বপ্নামাখা ষোড়শী উত্তীর্ণ দিনগুলি।

চিত্র ১ : প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের দোতলা বাড়ি। বারান্দায় শুকোয় লাল পাড় সাদা শাড়ি। আমি তখন ছোট্ট মেয়ে, জানলায় বসে মানুষের চলমান স্রোত দেখি— বিনুনি দোলানো দিদি, ছোট্ট ছেলে, বুড়ো মানুষ, ফুলঝাড়ুর ফেরিওয়ালা, শিল কাটাইওয়ালা... টানা রিকশার ঠুন ঠুন শব্দ আর মাঝে মাঝে হুস করে চলে যাওয়া মোটরগাড়ি। কুকুরেরা মাটি শুঁকে ঘুরে বেড়ায়। রাস্তায় ঝরে পড়ে রাধাচূড়া গাছের ফুল। থেকে থেকে ভেসে আসে পাশের মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ। আমার দু’চোখে বিশ্বের কৌতূহল। এত লোক কোথায় যায়? কেন যায়? ওদের বাড়ি কোথায়? মনে মনে ভাবি, এক দিন আমিও যাব। হাজরা পার্কের পাশ দিয়ে, যেখানে ঘুগনি আর হাঁসের সেদ্ধ ডিম বিক্রি হয়, সেই সোজা রাস্তা ধরে অনেক দূর গিয়ে বেড়িয়ে আসব। রোজই জানলার ধারে বসে একই ছবি দেখি আর ভাবি! কিন্তু যাওয়া আর হয় না।

এক দিন হঠাত্ এই ছবি বদলে যায়। দলে দলে শীর্ণ ক্ষুধার্ত মানুষ কাতর হয়ে ‘একটু ফ্যান দাও মা’ বলে পথে ভিড় করে। তাদের কোলের ছোট্ট শিশুদের কান্নায় মন্দিরের ঘণ্টাও ম্লান হয়ে যায়! চারিদিকে কি যেন এক আশঙ্কার ছায়া! দিনের আলো নিভলেই জানলায় পড়ে কালো পর্দা, ভেতরের একটুও আলো যেন দেখা না যায়! কাকা বলেন, ‘‘যুদ্ধ লেগেছে। তাই জাপানিরা বোমা ফেলেছে কলকাতায়। সময় খুব খারাপ!’’ জাপানি কারা? তারা কেন এসেছে? বোমা কী? এ সব জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘‘যাও খেলা করো গিয়ে।’’ অনেক পরে জেনেছি পঞ্চাশের মন্বন্তরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ ও জীবজন্তু মারা গিয়েছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রসদ যোগাতে। পরাধীনতার শেকল পরা সুজলা সুফলা বাংলা মা, শীর্ণ হাত দু’টি তুলে সে দিন ফ্যান চেয়ে ফিরেছিল পথে পথে।

চিত্র ২: এ বারের ছবিটা কিছুটা আনন্দের, হাসিতে উজ্জ্বল; কিছুটা নিরানন্দের, অশ্রুজলে সজল।

স্বাধীনতা দিবস। ভোর হতেই প্রভাতফেরী। সারা কলকাতা জুড়ে উত্সব। সবার হাতে ভারতের গেরুয়া-সাদা-সবুজ পতাকা। কেউ আর ঘরে বসে নেই। ট্রামে চড়ে লাটসাহেবের বাড়ি যাওয়া হবে। ছোটদের বলা হল, ‘‘আজ থেকে এখানে আর সাহেবরা থাকতে পারবে না। তাদের আমরা হারিয়ে দিয়েছি। আমরা এখন স্বাধীন।’’ স্বাধীনতা যে কী, তখন তার মানে বুঝিনি। সে দিন আনন্দে মাতাল জনতাকে দেখে আমার ছোট্ট মনেও আশার এক টুকরো আলো জ্বলে উঠেছিল। ভেবেছিলাম আর আমাদের কষ্ট থাকবে না, ছোটরা কাঁদবে না, বড়রা মুখ গম্ভীর করবে না। আমরা স্বাধীন! কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই কলকাতার বুকে আবার নেমে এল কালো এক ভয়ের ছায়া। শোনা গেল জান্তব চিত্কার, মানুষের শেষ আর্তনাদ! অন্ধকার ঘরে মামার কোলে বসে থরথরিয়ে কাঁপতাম। আর একটু বড় হয়ে শুনেছিলাম দেশ ভেঙে দু’খান হয়েছে— ভারত আর পাকিস্তান। কলকাতার এই বীভত্স দাঙ্গার রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল গঙ্গার জল। হাওড়া স্টেশনে অগুনতি লোকের অসহনীয় উপস্থিতি। তাদের দেশ নেই, পুঁজি নেই, আশা নেই। আমার তখন এ সব বোঝার বয়স হয়নি। আমি শুধু খোঁজ করতাম আমাদের বুড়ো ডিমওয়ালার, যে আর কোনও দিন আসেনি। শুনেছিলাম সে আর নেই। মৃত্যুর সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয়।

দিন কাটে, কলকাতায় ফেরে শৃঙ্খলা। তখন আমরা থাকি ভবানীপুরের বসন্ত বোস রোডে। সামনেই ২৩ পল্লির মাঠ। বন্ধুদের সঙ্গে হরিশ মুখার্জি রোড ধরে স্কুলের বাসে চলেছি গোখলে স্কুলের উদ্দেশে। লাল টিউনিক, সাদা ব্লাউজ। লম্বা লম্বা দেবদারু গাছের ছায়া ঢাকা ফুটপাথ। দু’ধারে দোতলা-তিনতলা বাড়ি, মিষ্টির দোকান, ছাপাখানা। পথে তেমন ভিড় নেই। রাস্তাগুলো বেশ চওড়া মনে হত তখন। স্কুলের সামনে পি জি হাসপাতাল। হলুদ ট্যাক্সি, টানা রিকশার সারি। আর একটু এগোলে, নীল আকাশের নীচে, সবুজ ঘাসের ফ্রেমে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। শীতকালে ফুলে ফুলে ভরে থাকত বাগান। খোলা ঘোড়ার গাড়িতে আশে পাশে টগবগ করে ঘুরে আসা যেত। স্কুলের ছুটিতে বেড়াবার জায়গা ছিল মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, ইডেন গার্ডেন, রেড রোড, গড়ের মাঠ আর মনুমেন্ট। গাড়িগুলো গায়ে গায়ে ঠেসে থাকত না, চলত হেলে দুলে। বাস ট্রামেও সহজে ওঠানামা করা যেত।

হাওয়ায় শিরশিরে ভাব। ২৩ পল্লির মাঠে বাঁশের স্তূপ। শিউলি ফুলের আলপনা ঘাসের উপর। পুজো এল বলে। বিকেলে কখনও গড়িয়াহাট, কখনও নিউ মার্কেট। দোকানে ঘুরে জামা, জুতো, রিবন কেনার ধূম। মহালয়ায় রাত থাকতে আধো ঘুমে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদ্দাত্ত গলায় ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে...’ আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ‘জাগো তুমি জাগো’ শুনে শুরু হত পুজোর উত্সব। ঢাকের বাজনা, ধূপ ধুনোর গন্ধ ভরা পুজো প্যান্ডেলে ছেলে মেয়ে আর লজ্জাবতী কলা বৌ সঙ্গে নিয়ে টানা টানা চোখের মা দুর্গা, পায়ের নীচে অসুর। যাওয়ার জন্য ছটফট করত মন। টিভি তো ছিল না, তাই ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা। নতুন জুতোয় পায়ে ফোস্কা। তবু হাঁটছি আর হাঁটছি। আজকাল সবাই বাড়িতে আরামে বসে ঠাকুর দেখে— কাছের ঠাকুর, দূরের ঠাকুর। ভালই! কিন্তু তাতে পুজোর গন্ধ, আরতির প্রদীপের শিখার উত্তাপ তো নেই। কিছু পেলে কিছু ছেড়ে দিতে হয়, এই তো নিয়ম!

সময় চলতেই থাকে। তার দৌলতে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি, স্কুল শেষ করে কলেজ। দু’হাতে বইয়ের বোঝা। গোল পার্ক থেকে আলিপুরের বিহারীলাল কলেজ অনেকটা পথ। হেঁটে গড়িয়াহাটের মোড়, ট্রামে কালীঘাট ডিপো। সেখান থেকে আলিপুরের ট্রাম, তার পর কলেজ। এনএম-এর ইকনমিক্স, এনবিসি-র ইংরিজি। ক্লাস কেটে প্রিয়াতে উত্তম-সুচিত্রার নতুন ছবি। টিকিটের দাম ১টাকা ২৫ নয়া! আজকালকার টিকিটের দাম দেখে চক্ষু স্থির। কফির দাম শুনে হেঁচকি ওঠে। রাস্তার ধারের ফুচকা যদিও আছে, কিন্তু ভিড় সাউথ সিটির ফুড কোর্টেই। লেকের গা ঘেঁষে সাদার্ন অ্যাভিনিউ আছে কিন্তু সেই সুন্দর বাগানওয়ালা বাড়িগুলো নেই। কাননদেবীর বাড়ি, জাহাজ বাড়ি এখন ইতিহাস। তার জায়গায় সঞ্চয়িতা থেকে নাম নেওয়া, আকাশে হাত বাড়ানো ফ্ল্যাট বাড়ির সারি। লেকের পাড়ে ঘাসের উপর বসে, শ্যামলের গানে কেউ আর প্রেম নিবেদন করে না। এসএমএস মারফত বারিস্তাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করে। আমাদের সময় ‘নিউ ইয়ার ডে’ ছাড়া অন্য কোনও ডে-র চল ছিল না।

কলেজ শেষ করে, কলকাতা ছেড়েছিলাম, তার পর দেশ। আজ ফিরে গেলে দেখি, প্রকৃতির নিয়মে, যা ছিল তার অনেক কিছুই বদলে গেছে। আমিও তো সেই আমি নেই। তবু অনেক কিছু আছে— কিছু বাস্তবে, কিছু স্মৃতিতে, কিছু স্বপ্নে।

কলকাতায় জন্ম। পড়াশোনা কলকাতা, শান্তিনিকেতন, দিল্লি ও বোম্বেতে। ১৯৬৯ সালে ছাত্রী হিসেবে নিউ ইউর্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পাড়ি। কর্মক্ষেত্রে কাউন্সেলিং ও অধ্যাপনা। থেকেছেন ইরান, ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকোতেও। পৃথিবীর অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। হবি— ভ্রমণ ও বই পড়া। ভালবাসার ভাষা বাংলা। আদর্শ ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ।
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.