|
|
শীত এলো
(বিশেষ প্রতিনিধি) |
|
|
|
মানস সরোবরের হাঁসের ঝাঁক আলিপুরের পথে ডানা মেলেছে। ধুনকরের ধনুতে টঙ্কার বেজেছে। নির্বাচনী সভার মত উষ্ণ আঙ্গিনায়ও কোলে কোলে উলের ডেলা দেখা গেছে। পাতা ঝরিয়ে ফুল ফোটানোর দিন এসেছে। এল যে শীতের বেলা।
শীত এসেছে। কাচের আধারে পারদবিন্দু ১৮ সেন্টিগ্রেডে, সুতরাং ষোল আনা না এলেও অচিরেই আসছে। কেননা, গলির মোড়ে জয়নগরের মোয়ার হাঁক শোনা গেছে, কড়াইশুঁটির দিব্যি দানা হয়েছে, ফুলকপির শুধু সৌরভ বিলাবার শৈশব পার হয়েছে,এবং বস্তির ঘরে থলি হাতে টিকাদারকে কড়া নাড়তে দেখা গেছে। সুতরাং, মার্গশীর্ষ অগ্রহায়ণ সবে মাত্র লেপের অনুমতি পেলেওশীত এসেছে, আসছে।
শীত আসছে। চিংড়ির মালাইকারি মনে আছে, নলেন গুড়ের সন্দেশ, খাঁটি পাটালিগুড়ের বিষয়ে গত বছরের অসমাপ্ত আলোচনা এবারও তাই উঠেছে, বাঁধাকপিচিংড়ির মালাইকারি মনে মনে আছে, আপাতত ধনেপাতা ফর্দে উঠেছে,ফেরার পথে টালিগঞ্জের বাঙালী বৈঠকখানা হয়ে গেলে কেমন হয় ভাবছে। কেননা, শীত আসছে। শেষরাতে উত্তরের জানলায় তার মুখ দেখা গেছেদিনে-দুপুরে মনুমেন্টের ছায়া তার আঁচলের হাওয়ায় কাঁপছে। হাজার হোক, কলকাতার বয়েস হয়েছে, বয়স হচ্ছে। মোহিনীকে দিনে দিনে সে যেন এখন ভয় করতে শিখছে।
মোহিনী। শীতের কলকাতা সে যেন সত্যিই মোহিনী, গোপনে বসন্তের বেনামী রাগিণী। কুয়াশার ওড়নার নীচে ধূম্রাবতী আজ যেন সত্যিই নবযৌবনা রূপবতী। অনুরাগে তার গলায় ফুলের হার, ফুলের মেলা। পার্কে পার্কে ডালিয়া, ডেইজী, ক্রিসেনথিয়াম, চন্দ্রমল্লিকা, ছাদের টবে গাদা গাদা গাঁদা, পিঠে বুকে মণিপুরী তাঁতের সুতোয় অজস্র প্রজাপতি, ফুল। বোটানিকস্, হরটিকালচার গার্ডেন, এসেম্বলির উঠোন,কর্তব্য ভুলে রাতারাতি সব যেন মালঞ্চ।
|
|
|
|
চিড়িয়াখানার তোরণে ছুটির দিনের হাতছানি |
এসেম্বলির মালাকার চন্দ্রমল্লিকার সাধক |
|
সে যেন এক আশ্চর্য পরিস্থিতি। কর্কটক্রান্তির দেশে সূর্য যেন নিজেই আজ সূর্যমুখী। নরম, উষ্ণ, রঙ্গীন। কার্জন পার্কের এপ্রেন্টিস অনুচরটিরও ইচ্ছে করে চিৎ হয়ে দিনরাত্তির তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালায় বসা নবীন পরীক্ষার্থী পড়া ভুলে মনে মনে খেলায় মেতে যায়এই আয়তাকার বর্গাকার আলোর টুকরোগুলো যদি কোনমতে ধরে রাখা যায়। ছাদে বসে চুল শুকাতে শুকাতে কি ঘোরে গেরস্থ বৌয়ের ডালনাটা কড়ায় ধরে যায়। উত্তর বায়ের একতারাহিমের সঙ্গে পোড়া গন্ধও ছড়ায়। শীত মোহিনী বৈ কি।
মোহিনীর নব নব বেশনব নব রূপ। বালিগঞ্জের লেকে সম্বরের প্রতিবিম্ব, কলকাতা যেন সহসা ‘ডিজনীল্যান্ড’। বেলেঘাটার খালে তিব্বতের বালি হাঁস, চৌরঙ্গীর ফুটপাথে সুইজারল্যান্ডের টুরিস্ট, বাঁকুরার পোড়ামাটির দোকানে কাউবয়ের বেশে দক্ষিণ আমেরিকার দম্পতি। যাদুঘরের সামনে দেহাতি-বোঝাই ঘোড়ারগাড়ির সারি, চিৎপুরের ট্রামে অনভ্যস্ত পথিক, ফার-মণ্ডিত ভুটিয়া পদাতিক।
পাড়ার শিরা কাঁপিয়ে নিশুতিরাতে ঘুঙুর বাজছে, জলসা হচ্ছে। গুমটির কাছে ফুচকার মেলা বসেছে,অদূরে মনুমেন্টের পাদদেশে নির্বাচনী মেলার প্রস্তুতি চলছে, মাইকে ‘হ্যালো, হ্যালো ওয়ান-টু-থ্রি...!’ আরও দূরে ইডেন উদ্যান, এম সি সি, বেরিংটন, কুন্দরাম ডেক্সটার, স্পীন গুগলি, পিঠে ভূমধ্যসাগরের সূর্য জ্বালিয়ে রেখে নীচে কার্নিভাল, বিকিনি, বাঙ্গালী মন্টকার্লো। ওপারে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে হয়ত হাওড়ার তাঁবু পড়বে, সার্কাস আসবে, বাঙ্গালী মেয়ে বুকে হাতি নেবে। এবার যদি সে ঘটনা না ঘটে, সার্কাস যদি নাই আসে ক্ষতি নেই, মেজর গাগারিণ আসছেন। তাতেও যদি গরম না হয় কলকাতার বুড়ো হাড়, তবে সে মায়াবীর তুণে আরও শর আছে।হ্যাঁ, ফেব্রুয়ারীতেই। |
|
অলস মধ্যাহ্ন— ফুচকার দোকান ঘিরে লম্বত ছায়ার আনাগোনা |
শীত আসছে। ইঁটের শহর ভুবনমোহিনীর রূপ অঙ্গে ধরেছে, ধরতে চলেছে। দিকে দিকে শুরু হয়েছে তারই নানা আয়োজন। আলনায় নব নব আবরণ,কসমেটিকস-এর ফর্দে নব নব আভরণ। স্নো, ক্রীম, গ্লিসারিন, ধোঁয়া, কুয়াশা, মারীগুটিকা মশা। কলকাতা আজ সত্যিই মায়াবীর বেশে এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। মহারাণী নিজের বয়স ভুলে তন্ময় হয়ে ময়দেনের দিকে তাকিয়ে আছেন..... রিক্সাওয়ালার অড়হর ক্ষেতের কথা মনে পড়ছে। পার্ক স্ট্রীটের বুড়ো সাহেবের কেন জানি হঠাৎদেশটাকে ‘হোম’ বলে মনে হচ্ছে।
আলোকচিত্র: স্টাফ ফটোগ্রাফার, আনন্দবাজার
|
ফিরে দেখা... |
|