|
|
৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১
|
|
|
|
|
|
|
তিলোত্তমা, স্মৃতির ও-পার থেকে |
প্রিয়ঙ্কা রায় বন্দ্যোপাধ্যায়
(হায়দরাবাদ থেকে) |
কলকাতার কল্লোলিনী রূপটা ছোটবেলা থেকে প্রতি দিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আমার ছোটবেলা যদিও খুব বেশি দিন আগের নয়, এই মাত্র বছর কুড়ি পুরনো! বড় হয়েছি মফস্বলে। বাবার চাকরি সূত্রে থাকতাম সরকারি কোয়ার্টার্সে। এক এক দিন বাবা বাড়ি ফিরে বলতেন, “আজকে অফিসে ফোন এসেছিল কলকাতা থেকে।”— হয়তো কোনও অনুষ্ঠানে নেমন্তন্নের জন্য বা এমনি কুশল সংবাদ আদান-প্রদান। আমিও আশপাশের বন্ধু বা খেলার সঙ্গীদের বলতাম গর্বের সঙ্গে ‘‘আজ দিদার বাড়ি যাচ্ছি, কলকাতায়!” দিদার বাড়ি, যেটা কিনা বরাহনগরে, না-কলকাতা না-মফস্বল একটা জায়গা ছিল, সেটাই আমার মহত্ত্বে কলকাতাই হয়ে যেত। মাঝেমধ্যে অবশ্য কলকাতার উপর বেশ রাগও হত। কিছু ‘অকালপক্ক’ দূরসম্পর্কের ভাইবোন ছিল, যাদের সঙ্গে দেখা হলেই মফস্বল নিয়ে খোঁটা দিত। তখন মনে মনে ভাবতাম কলকাতায় বড় হলেই বুঝি লোকজন এমন নিষ্ঠুর হয়ে যায়! পাশাপাশি একটি আশ্চর্যের বিষয়, আমার এক সহপাঠিনী— যে রোজ বালিগঞ্জ থেকে ট্রেন ঠেঙিয়ে মফস্বলের স্কুলে আসত, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে!
তখন কলকাতা যাওয়া বলতে বিভিন্ন আত্মীয়ের বাড়ি অথবা উপলক্ষ দুর্গাপুজো। আর ছিল কিছু ‘স্পেশাল’ ভ্রমণ, যেমন প্রতি বছর শীতের নরম দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে ট্রেন ধরে বইমেলায় যাওয়া। আরও ছোটবেলায় বড়দিনে যাদুঘর বা চিড়িয়াখানা ঘুরে ক্লান্ত শরীরে নাহুমস-এর কেকের গন্ধ মেখে সারা নিউ মার্কেট চষে নানা রকম লজেন্স কেনা পরবর্তী কয়েক মাসের জন্য। স্কুলে পড়াকালীন কলকাতা যাওয়া মানেই ছিল অনাবিল আনন্দ— নেমন্তন্ন, দেদার ছুটি, দিদার বাড়ি, ঠাকুর দেখা আর বেলুড় মঠের ভোগ। আমরা বোধ হয় রেকর্ড স্থাপন করেছি, এক টানা ন’বছর প্রতি বার অষ্টমীর দিন ঠিক সকাল ন’টায় বেলুড় মঠের পুষ্পাঞ্জলির লাইনে হাজিরা দেওয়ায়। পুজোর সময় আমার কাছে ওই ঘনশ্যাম ঘুসুড়ির খিচুড়ি ভোগ ছিল কলকাতার সমার্থক। আমাদের সময়ে পুজোয় সারারাত্রি ধরে ঠাকুর দেখার এত হিড়িক ছিল না। তাই কোনও বছর সন্ধের ভিড় এড়াতে মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোন আর বড়রা মিলে মাঝরাতে দক্ষিণ কলকাতার সব ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। এই রকমই এক বার ঘুরতে ঘুরতে ম্যাডক্সে স্কুলের প্রিয় ‘মিস’-এর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় সে কী রোমাঞ্চ! ছুটির পর ক্লাসে গিয়ে ঈর্ষান্বিত বন্ধুদের কাছে জাহির করেছিলাম, “জানিস, মিস আর আমি একই জায়গায় ঠাকুর দেখতে গেছিলাম।” কখনও শীতকালে কলকাতায় বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে রাতের ফাঁকা ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে গরম শালের ওমে ঘুমিয়ে পড়তাম।
স্কুল-জীবন শেষ করার পর ঠিক করলাম কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনো করব। মফস্বলের পাট চুকিয়ে সবাই মিলে বালিগঞ্জে চলে এলাম। কলকাতার সঙ্গে ‘সহবাস’ শুরু সেই থেকে। প্রথম দিকে সব কিছু বেশ অচেনা লাগত। ছিলাম মেন লাইনের ট্রেনে চড়া ‘পাবলিক’, সেখান থেকে রোজ বাসে-অটোতে যাতায়াত মোটেও ভাল লাগছিল না। কত লোক, কত গাড়ি, সবাই খালি ছুটেই চলেছে সারা দিন। বাস জিনিসটা আমার বিশেষ পোষায় না, তায় আবার কলকাতার। এক বাস লোকের দৃষ্টির সামনে যখন বার বার স্কার্ট টেনে নামিয়ে বসতে হত, তখন মনে মনে কনভেন্ট স্কুলকে এবং লোকজনকে গালাগাল দিয়েছি অনেক। তবে এ সব তুচ্ছ বিষয়ের থেকে অনেক গভীর সমস্যা ছিল নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া। অ্যাডমিশন টেস্ট, ইন্টারভিউ... ভর্তি তো হয়ে গেলাম, কিন্তু এ যে বেজায় বড়লোকদের স্কুল! প্রথম দিন গেট থেকে ক্লাসরুম অবধি হেঁটে যেতে পা সরছিল না ভয়ে। কলকাতার স্কুল, তাতে সব বড়লোকের মেয়েরাই স্টুডেন্ট (কেন জানি আমার ধারণা ছিল কলকাতার স্কুলে শুধু বড়লোকেরাই পড়ে)। আমার কী আর কোনও বন্ধু হবে এদের মধ্যে! মনমরা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম একটা রোগা মতো মেয়ে এসে পাশে পাশে হাঁটছে। কথায় কথায় জানলাম, সেও মফস্বলের। ব্যস, সেই এক সঙ্গে হাঁটার শুরু। আজ দু’জনে আলাদা মহাদেশে বসেও মনে মনে একে অপরের পাশাপাশিই হাঁটছি। বোর্ডের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার পর চার বন্ধু মিলে প্রথম বার হৃতিক রোশনের সিনেমা দেখতে যাওয়াটা এমনই স্মৃতি, যা বোধহয় এখনও পৃথিবীর চার দিকে থাকা চার জনকে এক করে দিতে পারবে। সম্বৎসরের সবক’টা ঋতুর ভোরে একের পর এক রাস্তা পেরিয়ে স্কুল অবধি সফরটায় আস্তে আস্তে শহরটাকে ঝেড়ে মুছে জেগে উঠতে দেখতাম রোজ!
“এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু...” না, প্রথম সব কিছু না হলেও অনেক কিছুই জানে আমার কলকাতা। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথম বার কলেজের স্বাধীনতা আর অবশ্যই প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি— আমার ধারণা কলকাতা ছাড়া আর কেউ বুঝতও না। শহরের বুকে দূষণে পাঁশুটে হয়ে আসা সূর্যাস্ত কত বার দেখেছে আমাদের লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না। কারও কাছে কলকাতা মানে আড্ডা, কারও কাছে এগরোল, কারও কাছে ভালবাসা— বা আরও নানা কিছু, আমার কাছে কলকাতা মানে কিন্তু শুধুই বন্ধু। কলেজ কেটে সবাই মিলে সিনেমা বা বইমেলায় যাওয়া, নিজে না গেলেও বন্ধুদের অভিসারে সাহায্য করা, ব্যর্থ প্রেম, সফল ভালবাসা, অনাবিল বন্ধুত্ব, সবকিছুরই সাক্ষী শুধুই কলকাতা!
আমাদের কলেজের পেছনের গেটের পাশের গলিতে একটা ফটোকপির দোকান ছিল। সেমেস্টার শুরু হওয়ার কিছু দিন পর থেকে ওটাই আমাদের ‘ঠেক’ হয়ে দাঁড়ায়। সকাল হোক বা সন্ধে, ক্লাসের শুরু হোক বা শেষ, পরীক্ষার আগে হোক বা পরে, ওই এক ফালি দোকান আর তার সামনের বেঞ্চই আমাদের কফি হাউস ছিল। কলেজ ছাড়ার এত বছর পরেও ওখানে গেলে দোকানের মালিক বাড়ি থেকে চা এনে খাওয়ান। আমাদের ব্যাচের প্রত্যেকের নাম-ধাম ওঁর মুখস্ত। এটা আর কোথাও সম্ভব কি না জানি না! তবে কলকাতায় অবশ্যই সম্ভব। ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে, রাত আটটা-ন’টা অবধি আমরা কলেজে বসে থাকতাম প্র্যাক্টিক্যালের নামে! মা-বাবারা কী ভাবতেন জানি না, তবে শিক্ষকরা নিশ্চিত বুঝে গেছিলেন আমরা আড্ডার জন্যই ‘ল্যাবে’ বসে থাকতাম। রোজ যে তুমুল আড্ডা হত তা কিন্তু নয়, তবে ওই বয়সে নিছক চা-মুড়িমাখা সহযোগে বন্ধু-সঙ্গই আমাদের কাছে স্বর্গ ছিল। বাড়ির লোকে খুব একটা চিন্তা করত না— কলকাতার বুকে কলেজ, অনেক রাত অবধি গাড়িঘোড়া পাওয়া যায়। তা ছাড়া বন্ধুরা সব এক সঙ্গেই তো ফিরব। আমার এবং আর এক বন্ধুর মুশকিলটা ছিল আমরা কলেজে আটটা অবধি থাকলেও, তার পরে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির বাসস্টপেই আরও আধঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। কী করব, এমন অনেক ব্যক্তিগত কথা থাকত যা অন্য বন্ধুদের সামনে বলা যেত না! কোনও ভাবে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে, একমাত্র ওই বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আলোচনা করলেই সমস্যাগুলোর সমাধান বেরিয়ে আসবে। এ ভাবে যে কত গূঢ় কথা, গুপ্ত ব্যথার সাক্ষী রয়ে গেছে ওই বাসস্টপ, তা শুধু আমরাই জানি।
কে যেন বলেছিল, কলকাতায় থেকে শহরটাকে যতটা না চেনা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি চেনা যায় কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকলে। প্রবাসে থাকাকালীন হয়তো এমন একটা দিনও যায়নি যখন কলকাতার কোনও না কোনও কথা মনে পড়েনি। একবার বিদেশে বসে কলকাতাগামী এক বন্ধুকে বলেছিলাম, “ফিরে গিয়ে বালিগঞ্জ ফাঁড়িটাকে বলিস যে আমি আবার আসব, শিগগিরই।” ন’তলার ক্যান্টিন থেকে প্রতি দিন দীপাবলীর মতো আলো মাখা দক্ষিণ কলকাতা দেখার সৌভাগ্য কি খুব বেশি লোকের হয়? কলকাতার ওই রূপটা বোধ হয় শুধু আমাদের জন্য তুলে রাখা ছিল। এ রকম আরও কত রূপে, কত অবতারে যে শহরটা প্রত্যেকটা মানুষের কাছে ধরা দিয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। তাই সবার কাছেই কলকাতা কল্লোলিনী! সবার কাছেই কলকাতা তিলোত্তমা!
|
মা-বাবার একমাত্র সন্তান। বড় হয়ে ওঠার বছরগুলো কেটেছে ইছাপুরে, তাই শহর কলকাতাকে ঘিরে ছিল অদম্য আগ্রহ। স্কুলের পাট চুকিয়ে হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য এ শহরেই। ফ্লোরিডায় পিএইচডি করতে গিয়ে ‘রিসেশন’-এর জন্য তা আর শেষ করা হয়নি। আপাতত বিবাহ সূত্রে হায়দরাবাদে বসবাস। লেখালিখি, বই পড়া আর ছবি তোলা প্রায় নেশার পর্যায়ে। |
|
|
|
|
|
|