|
|
৫ পৌষ ১৪১৮ বুধবার ২১ ডিসেম্বর ২০১১
|
|
|
|
|
|
|
মাঠের তালিম মিছিলে মিছিলে |
বহুমুখী প্রতিভার এক অগাধ ভাণ্ডার... মূলত ভাটিয়ালি
ও
লোকগায়ক... গণসঙ্গীতে দিয়েছিলেন এক নতুন রূপ।
গত ১৪ ডিসেম্বর পেরিয়ে গেল তাঁর শততম জন্মবার্ষিকী।
এ বারের ‘অতীতের তাঁরা’য় কবি-গায়ক হেমাঙ্গ বিশ্বাস। |
|
|
‘তোমার কূলকে ভালবেসেই তো
কূল ছাড়া আমি
...ব্রহ্মপুত্র আমার বিস্ময়
পদ্মা আমার শ্রদ্ধা
গঙ্গা আমার ভক্তি
তুমি আমার ভালবাসা...
খোয়াই।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস— লোকগায়ক মানুষটি গণসঙ্গীতে দিয়েছিলেন এক নতুন রূপ। রসদ সংগ্রহ করেছিলেন নিজের দেশের মাটি থেকে। শুধু সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই নয়, আসলে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। গান-কবিতা লেখার পাশাপাশি দারুণ আবৃত্তি করতেন। ছবি আঁকার হাত যেমন ভাল, তেমনই ঘর সাজানোর জিনিস তৈরিতেও ছিলেন এক ওস্তাদ কারিগর। এক কথায় লোকজীবনের সঙ্গে যা কিছু জড়িত তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ।
১৪ ডিসেম্বর ১৯১২। অসমের শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জের মিরাশি গ্রামে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম। পিতা হরকুমার বিশ্বাস ও মাতা সরোজিনী বিশ্বাস। মাঠে-প্রান্তরের শ্রমজীবী মানুষের মাঝেই বড় হয়ে উঠেছিলেন মাটির কাছাকাছি থাকা হেমাঙ্গ। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, মিরাশি গ্রামে ছিল শালি ধানের মাঠ। আশ্বিন-কার্তিক মাসে সড়কের মাথায়, আলের ধারায় ঢেউ খেলত ময়নাশাইল, কার্তিকশাইল, কালিজিয়া, কৃষ্ণচূড়া— ধান। তাদের বিভিন্ন রং, হরেক রকম গন্ধ। ধানের শিষ টেনে কচি ধানের দুধ খেতেন ছোট্ট লালুবাবু ওরফে হেমাঙ্গ। দেখতে পেলে কোনও স্নেহশীল চাষি বলতেন, ‘‘ধানের বুকে অখন ক্ষীর, ছিড় না, পাপ হয়।’’ বহু বছর পার হয়ে যায়। বাংলা দু’ভাগ হয়। কলকাতায় বসে ‘ছিন্নমূল’ কবি হেমাঙ্গ লিখলেন—
কার্তিক মাসে বুকে ক্ষীর ক্ষেতের ধানে ধানে
অঘ্রাণে রান্ধুনি পাগল নয়া ভাতের আঘ্রাণে।
তাঁর কথায়: অঘ্রাণে আমাদের দেশ ভারী সুন্দর হয়ে ওঠে। ধানের দেশে বাড়ি আমাদের। ধানের গন্ধে বড় হয়েছি। এই ধানই আমায় গান দিয়েছে। এই গানই কৃষক আন্দোলনকে আরও স্ফূরিত করেছিল।
সলিল চৌধুরী লিখলেন ‘হেই সামালো ধান হো’। কাকদ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে বিনয় রায় রচনা করলেন ‘অহল্যা মা, তোমার সন্তান জন্ম নিল না’। আর এই সময় হেমাঙ্গ লিখলেন—
‘তোর মরা গাঙে আইল এ বার বান
ওরে ও কিষাণ
তোর মরা গাঙে আইল এ বার বান...’
মিরাশি গ্রামে আউস আর শালি ধানের চাষ হত খুব। আর মাঝে আখ চাষ। কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙত হেমাঙ্গ’র। কখনও বা কাঠের তৈরি পেষা কলে আখমাড়াইদের আওয়াজে। আবার কখনও আহির ভৈরোঁর খুব কাছাকাছি আজানের সুরে। ছোটবেলার ‘মিউজিক’ বলতে তাঁর কাছে ছিল আখমাড়াইয়ের ‘গান’ আর আজানের ডাক!
হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে পাশ করে শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজে পড়ার সময়ই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে লবণের ‘প্যাকেট’ হাতে হেঁটে ত্রিপুরা পর্যন্ত প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩২-এ কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। তার পর কারাবন্দি অবস্থায় যক্ষ্মরোগে আক্রান্ত হলে শারীরিক অসুস্থতার কারণে মুক্তি পান। ১৯৪৮-এ তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময়ে ফের গ্রেফতার হয়ে তিন বছর কারারুদ্ধ রইলেন। কখনও বাইরে, কখনও ভিতরে— নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে জীবনের এগিয়ে চলা।
সে সময়ের ‘কাস্তেটারে দিও জোরে শান’, ‘কিষাণ ভাই তোর সোনার ধানে বর্গী নামে’ ইত্যাদি গান বাংলা ও অসমের প্রাণে বিপুল সাড়া জাগায়। অসমে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিনোদবিহারী চক্রবর্তী, সাহিত্যিক অশোকবিজয় রাহা, সেতার-বাদক কুমুদ গোস্বামী... প্রমুখ। অসমিয়াদের প্রতি ভালবাসা থেকে বাড়ির নাম রাখলেন ‘জিরণি’ অর্থাত্ বিশ্রাম।
চিন-ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। দু’বার তিনি চিনে গিয়েছেন। বাংলায় অনুবাদও করেন চিনা ভাষার অনেক গান। ‘হেমাঙ্গ’ শব্দের চিনা অনুবাদ করেন ‘চিন শিন’।
যাঁর সঙ্গীত সারা জীবন সংগ্রামের শাণিত হাতিয়ার, তাঁর জন্ম শতবর্ষে কে কী বলছেন?
রাণু বিশ্বাস (স্ত্রী): তাৎক্ষণিক গান বাঁধার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ওঁর। আর এ ভাবেই তৈরি হয়েছে বহুল প্রচারিত প্রচুর গান। কী করে নির্মাণ হয়েছিল ‘উই শ্যাল ওভারকাম’-এর বঙ্গ সংস্করণ ‘আমরা করব জয়’? ময়দানে পিট সিগার-এর গানের অনুষ্ঠানে গেলাম ওঁর সঙ্গে। দু’জনে গান শুনছি। এক সময়ে পিট সিগার বলে উঠলেন, ‘‘এখানে এক জন বিশ্ববিখ্যাত লোকগায়ক বসে রয়েছেন। তিনি দয়া করে মঞ্চে আসুন।’’ ওঁকে বললাম, ‘‘তোমাকেই ডাকছেন। যাও, গিয়ে দেখ, কেন ডাক পড়েছে!’’ উনি বললেন, ‘‘আমি আবার এক জন গায়ক!’’ পাশেই ছিলেন জেঠতুতো দিদি। দিদিও বললেন, ‘‘যান হেমাঙ্গবাবু, আপনাকে ডাকছেন।’’ এর পর দু’জন লোক এসে ওঁকে প্রায় পাঁজাকোলা করে মঞ্চে তুলে দিল। করমর্দনের পর পিট শুরু করলেন, ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। উনি তৎক্ষণাৎ বাংলায় গাইলেন, ‘আমরা করব জয়’। এখন এই গান প্রচারের দৌলতে অনেকেরই মুখে।
শিয়াখালায় বেণীমাধব বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষিকা থাকার সুবাদে ওখানেই আমাদের বসবাস। পুত্র মৈনাককে (লু সুন) শান্ত করার জন্য বা ঘুম পাড়ানোর সময় হেমাঙ্গ গাইতেন, ‘‘কচি কচি কলাপাতা লাড়ু চরে, আমার লু সুন ঘুমে ঘুমে ঢলে পড়ে।’’ এ ভাবেই তাৎক্ষণিক গান বেঁধেছিলেন ’৪৩-এর মন্বন্তরের সময়, ‘মন্বন্তরে মরেনি মানুষ, মরেছিল মানবতা’।
গানের জন্য বাড়িতে আসতেন সলিল চৌধুরী, ভূপেন হাজরিকা, প্রেম ধাওয়ান, কল্যাণ সেনবরাট, বিমল দে, রঞ্জন প্রসাদেরা। স্মৃতি বড় দুর্বল। অনেকের নাম আজ আর মনে পড়ে না। বাড়িতে গানের মহড়ার শেষে কখনও ঘুগনি, কখনও বা মুড়িমাখা হত। সেই মুড়ির কথা অনেকেই মনে রেখেছে।
ওঁর জন্মদিনের পছন্দের খাবার ছিল পায়েস, কেক, পুডিং ও রসগোল্লা। এ ছাড়া প্রতি দিন বিকেলে চায়ের আগে বালিগঞ্জের গুইন অথবা লক্ষ্মী স্টোর্সের দু’টি কড়া পাকের সন্দেশ। খেতে ভালবাসতেন পোস্ত-বড়া, ভাজা মুগের ডাল, প্রায় সব ধরনের মাছ, কলেজস্ট্রিটের পাঁঠার মাংস ও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডা।
মৈনাক বিশ্বাস (পুত্র): বাবার বৈশিষ্ট্য ছিল খেটে খাওয়া মানুষের পাশে থাকা। তাঁদের জীবন সংগ্রামের কথা শোনা। সিলেট অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। ওখানকার আঞ্চলিক সুর ভাটিয়ালি ও সারি বাবাকে টানত। শ্রমজীবী মানুষদের সাংস্কৃতিক মঞ্চে আনার এক অক্লান্ত প্রয়াস ছিল তাঁর। মাটির সুরের গান, প্রান্তিক মানুষের লৌকিক আঙ্গিক, তাঁদের বাচনভঙ্গিই তাঁর কাছে এক সময় মানুষের গান হয়ে গেল। এর জন্য অনেক আন্দোলন, অনেক বাধা-বিঘ্নের মধ্যে দিয়ে ওঁর জীবন কেটেছে। কখনও মাথা হেঁট করতে বা মন খারাপ করতে দেখিনি। লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
রঙিলী বিশ্বাস (কন্যা): বাবার কর্মকাণ্ডের এক বিরাট দিক অসমে গণনাট্য ও গণসংস্কৃতি গড়ে তোলা। অসমিয়া সুর ওঁকে খুব আকৃষ্ট করত। ওঁর অবদান নিঃসন্দেহে লোকসঙ্গীত ভিত্তিক গণসঙ্গীত চর্চা। মামাবাড়িতে গানের আবহ ছিল। নানা ধরনের গান শুনতেন। দেশে মেহনতি মানুষের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগিয়ে তুলতে লোকসঙ্গীতের সুরকে নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।
মৃণাল সেন (চিত্র পরিচালক): পঞ্চাশের দশকের শুরুতে কিংবা তারও আগে নিজের লেখা ও সুর দেওয়া গানে তিনি দেশ তোলপাড় করেছিলেন। ‘মাউন্টব্যাটেন’ আমাকেও উদ্বেল করেছিল। ওঁর বিশ্বাস, নিজের আর্দশ থেকে কখনও একচুল সরেননি। এর জন্য শেষ পর্যন্ত অনেক লড়াই করে যেতে হয়েছে! আইপিটিএ-র প্রতিষ্ঠা কালে অনেকেই একটি আদর্শ সামনে রেখে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে বাম রাজনীতিতে এল শত মতানৈক্য, মতবিরোধ। তিনি কিন্তু নিজের বিশ্বাসের প্রতি অটল থেকে কখনও মাথা নোয়াননি।
মহাশ্বেতাদেবী (লেখক): ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় ছিল না। কারণ আমাদের কর্মক্ষেত্র ছিল একেবারেই আলাদা। কিন্তু তিনি ছিলেন সাচ্চা এক সাংস্কৃতিক কর্মী। নিঃসন্দেহে একটি শ্রদ্ধেয় নাম। বহু বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে ওঁর জীবন কেটেছে। কিন্তু কোথাও কারওর কাছে মাথা হেঁট করেননি। সেই সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস অন্যতম। আমরা তাঁকে নিয়ে গর্বিত।
কল্যাণ সেনবরাট: লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে হেমাঙ্গদা ছিলেন একশো ভাগ মাটিতে থাকা মানুষ। বিহু-ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির সুরে গান নানা প্রান্তরের মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। এই লোকসুর ও কথা নিয়ে বিপ্লবের গান, আন্দোলনের গান গেয়েছেন। লোকসঙ্গীত মিশে গিয়েছিল গণসঙ্গীতে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লোকসঙ্গীত ‘হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া’, ‘ও সোনা বন্ধুরে’, ‘আমার মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগ্যা’ ইত্যাদি। হেমাঙ্গদার বিশ্বাস ছিল জাতীয়তাবোধ যখন আর্ন্তজাতিকতাবাদের মোহনায় এসে মেশে তখনই গণসঙ্গীতের জন্ম।
আমি গান শিখতে গিয়েছিলাম ওঁর কাছে। গিয়ে শিখলাম সঙ্গীত কী ভাবে পরিচালনা করতে হয়। পরিচালন ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। অসম গণনাট্য সঙ্ঘের সংগঠক ছিলেন উনি। ওঁর হাত ধরে ভূপেন হাজরিকা, নির্মলেন্দু চোধুরী, মঘাই ওঝা (ঢোল বাদক)-রা গণনাট্যে আসেন। হেমাঙ্গদা কলকাতা থেকে শম্ভু ভট্টাচার্য ও মন্টু ঘোষকে অসমের গণনাট্য স্কোয়াডে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস শেষ জীবনে কলকাতাবাসী হওয়ার পরে লিখেছিলেন ‘ডানা ভাইঙা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর’।
|
|
নিজস্ব বাড়ি ‘জিরণি’তে তাঁর জন্মশতবর্ষ পালন |
সৃষ্টি: কুল খুরার চোতাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের বই, জন হেনরি, শঙ্খচিলের গান, মাউন্টব্যাটনের মঙ্গলকাব্য, আকৌ চিন চাই আহিলোঁ, চিন ঘুরে আসার পরে, চিন থেকে ফিরে, আবার চিন দেখে এলাম, লোকসঙ্গীত সমীক্ষা বাংলা ও আসাম, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান, জীবনশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ, উজান গাঙ বাইয়া-সহ নানা গানের বই, কাব্যগ্রন্থ, আত্মজীবনী ইত্যাদি।
তাঁর সুরে সমৃদ্ধ হয়েছে...
নাটক: তিতাস একটি নদীর নাম, কল্লোল, তীর, লাল লণ্ঠন ইত্যাদি।
যাত্রা: লেনিন।
চলচ্চিত্র: পদ্মানদীর মাঝি, কোমল গান্ধার, লালনফকির ইত্যাদি।
লালনফকির-এ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান গেয়ে জাতীয় পুরস্কার পান।
নিজস্ব সংগঠন: মাস সিঙ্গার্স
|
তথ্য: পাপিয়া মিত্র
নিজস্ব চিত্র ও পিন্টু মণ্ডলের তোলা ছবি |
|
|
|